শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০০ অপরাহ্ন

কবি ওমর আলী: একটি কবিতা দিয়েই চেনা যায় তাঁকে

শিহাব শাহরিয়ার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২

আমার পাঠে পৃথিবীর সেরা কবিতা কোনটি জানেন? জীবনানন্দ দাশের ‘হায় চিল’। আপনারা হয়তো অনেকেই দু’এক বার পড়েছেন। কিন্তু আমি পড়েছি শত শত বার। যত পড়ি ততই মুগ্ধ হই, ততই মন নড়ে নড়ে ওঠে।
আসলে কী আছে কবিতাটিতে? শব্দ, উপমা ও বিষয়আহা, ‘হায় চিল! সোনালি ডানার চিল বা বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে কিম্বা কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে’সর্বশেষ চরণটি আমার কাছে কবির সেরা একটি চরণ মনে হয়। প্রেমকে এভাবে খনন করা যায়, যা কেবল জীবনানন্দের পক্ষেই সম্ভব।
চিলির বিশ্বনন্দিত কবি পাবলো নেরুদার একটি কবিতাও আমাকে দারুণভাবে টানে। যেমন:
‘তোমার আঙুল আমার চোখের ওপর
তোমার আঙুল আমার চোখের ওপর দিয়ে উড়ে যায়, দিনের দিকে।
আলো এসে থরে থরে গোলাপের সম্ভার খুলে দেয়।
বালি আর আকাশ একাকার হয়ে ফিরোজা মৌচাকের মতো ধুক্পুকিয়ে ওঠে।
তোমার আঙুল যে বর্ণমালা ছোঁয়, তারা রিনরিনে বেজে ওঠে ঘণ্টার মতো
সেই এক হাত পরপর ছুঁয়ে যায় পেয়ালা, সোনালী তেল ভরা পিপে,
ফুলের পাঁপড়ি, ঝরনা, প্রধানত, প্রেম।
ভালোবাসা: তোমার হাত প্রেমের ভান্ডার পাহারা দেয়।
দুপুর আশ্চর্য নিথরতায় জেগে থাকে। রাত পিছলে চলে যায়
একটি ঘুমন্ত পুরুষের চোখের ওপর দিয়ে, একটি ছোটো স্বর্গীয় আধারের মতো।
মধুমালতী তার আদিম বিষণ্ন ঝাঁঝ বাতাসে ছড়ায়।
তখনই তোমার হাত পাখির মতো কেঁপে উড়ে আসে আবার,
যে পালক হারিয়ে গেছে, কল্পনায় ভেবেছি আমি,
সেই ডানা দুটি গুটিয়ে রাখে আমার চোখের ওপর, যে চোখ দুটিকে আঁধার গ্রাস করেছিল।’
(অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার)
তেমনি, ‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ কবিতাটিও দেশপ্রেমের একটি সেরা বাংলা কবিতা বলে আমার কাছে মনে হয়। কবিতার কবিÍওমর আলী। গাঁয়ের সোদা-গন্ধ যখন আমার গায়ে ছড়ানো, তখন ‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতায় রূপময় বাংলাদেশকে পেয়েছি। এদেশের কী যে অপূর্ব রূপ কবি সৈয়দ আলী আহসান (পরবর্তীতে তাঁর রাজনৈতিক কৃতকর্মের জন্য এতো বড় প-িত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ঘৃণা করেছি) তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন, তা এখনো আমাকে টানে। যেমন কয়েকটি চরণ:
‘আমার পূর্ব-বাংলা এক গুচ্ছ স্নিগ্ধ
অন্ধকারের তমাল
অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায়
একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ
নিকুঞ্জের তমাল কনক-লতায় ঘেরা
রাশি রাশি ধান মাটি আর পানির
কেমন নিশ্চেতন করা গন্ধ… তিনটি ফুল আর একটি পাতা নিয়ে
কদম্ব তরুর একটি শাখা মাটি
ছুঁয়েছে আরও অনেক গাছ পাতা লতা
নীল হলুদ বেগুনি অথবা সাদা
কাকের চোখের মতো কালোচুল…।’
তৎকালীন পূর্ব বাংলার চেহারা-চিত্র আর কীভাবে নান্দনিক হতে পারেবলুন?
‘আমার পূর্ব বাংলা’ কবিতায় এক অর্থে শুধু বাংলার প্রকৃতির রূপ বর্ণিত হয়েছে কিন্তু আলোচ্য ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ ওমর আলীর এই কবিতায় প্রকৃতির সাথে ফুটে উঠেছে গ্রামীণ মানুষের বাস্তব জীবনের নানা মাত্রিক চিত্র। কবিতাটি নিয়ে কিছু লেখার আগে কবির সঙ্গে একদিনের এক বিকেলের স্মৃতিকথা বলি। নদী পদ্মার উত্তাল ঢেউাশ্রিত শিক্ষা ও শান্ত নগরী রাজশাহী। সত্তরের অন্যতম কবি আসাদ মান্নান তখন রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার। বিনয়ী ও নিরাহঙ্কারী এই কবি ২০১৫ সালে সেখানে আয়োজন করলেন সাহিত্য-উৎসব। আমরা ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে ট্রেনে করে গিয়েছিলাম নির্মলেন্দু গুণ, জাহিদুল হক, অসীম সাহা, মাকিদ হায়দার, নাসির আহমেদ, শিহাব সরকার ও টোকন ঠাকুর প্রমুখ। ট্রেনে টক-ঝাল-মিষ্টি মিশিয়ে আমরা পাঁচ ঘণ্টা পর গন্তব্যে পৌঁছলাম। টক-ঝাল-মিষ্টি বলতে যেতে যেতে আড্ডা, কবিতা ও কবিদের নিয়ে নানা প্রসঙ্গ তো হলোই, টক-ঝাল হলোআসাদ মান্নান একটি স্লিপিং সিট আমাদের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন, এই সিট নিয়েই মূলত ষাটের কবিদের মধ্যে বেশ বাধাবাধি হলো।
অর্থাৎ এই সিটে কে যাবেন? আমরা ছোটরা মজাই পাচ্ছিলাম। যা হোক সিট নিয়ে যারা রাগ-অভিমান-গোস্সা করলেন, গন্তব্যে এসে সবাইকে নামতে হলো, যে দু’জন সিট নিয়ে কথা কাটাকাটি করেছেন, তারা কিছুক্ষণ মুখ কালাকালি করেছেন, তা শেষে আবার মুখর হলেন, আমরা গিয়ে সন্ধ্যারাতে উঠলাম সার্কিট হাউসে। আগেই বলেছি, পদ্মা পাড়ের বৃক্ষশোভিত রাজশাহী আমার কাছে খুব ভালো লাগে। সার্কিট হাউসও বেশ নিরিবিলি ও বৃক্ষশোভিত। খাওয়া-দাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হলো। তারপর সূর্য ওঠা সকালে আমরা স্নান সেরে চা-নাস্তা করে উৎসবের মাঠে যাবোএই সময় নির্মল দা সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে ফটোসেশন করার আহ্বান জানালেন, তিনি আমাকে বললেন, শিহাব এসো আমার কয়েকটি ছবি তুলে দাও, আমি তোমার ছবি তুলে দিচ্ছি। এর সঙ্গে যুক্ত হলেন মাকিদ হায়দার, নাসির আহমেদ, শিহাব সরকার, টোকন ঠাকুরসহ রাজশাহীর কয়েকজন তরুণ কবি ও লেখক। এই সময়ে একটি কক্ষ থেকে একজন তরুণির হাত ধরে বেরিয়ে এলেন কবি ওমর আলী। আমি তো রীতিমত হতবাক যে, তাঁর সঙ্গে এখানে দেখা হবে। দেখলাম আস্তে আস্তে হাঁটছেন, সম্ভবত কবি নাসির আহমেদ বললেন, ওমর ভাই কিছুদিন আগে স্ট্রোক করেছেন, বিশেষ করে তাঁর হাত দুটো অবশ। ছুটে গেলাম তাঁর দিকেসম্ভাষণ জানিয়ে আমার পরিচয় দিলাম। আমাকে বললেন, ভাই দূর থেকে অর্থাৎ মফস্বলে বসে তোমার অনেক কবিতা পড়েছি, আজ তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়ে খুব ভালো লাগল। আমি সত্যি বিস্মিত। বললাম, আপনাকেও আজ প্রথম দেখলাম, আমি খুবই আনন্দিত। তারপর সঙ্গে থাকা তরুণীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, তিনি নিজের হাতে খাওয়া-দাওয়াসহ কিছুই করতে পারেন না। এরপর আমরা উৎসবের মঞ্চে গিয়ে উপস্থিত হলাম। একটি সেশন বা পর্ব শুরু হলো। দর্শক সারিতে বসলামআমি মাঝখানে, আমার ডান পাশে কবি ওমর আলী, বাম পাশে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। শুরু হলো কবির সঙ্গে কথপোকথন। সামান্য সময়। কথা স্পষ্ট নয়। জড়িয়ে যায়। বললেন, শিহাব কবিতার সঙ্গে ঘর-সংসার করলাম বহু বহু বছর, এবার যাবার বেলা হয়ে গেছে। প্রতিদিনই আমার পড়ন্ত বেলা। চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। বাংলা কবিতায় যা রেখে গেলাম, তা কেউ কেউ মনে রাখতেও পারে, নাও রাখতে পারে; তাতে কোনো খেদ নেই। বললাম, ঢাকায় না গিয়ে আপনি যে মাটি ও মানুষ এবং প্রকৃতির দুরন্ত ছায়ায় জীবন কাটালেন, তাতে আপনার মনে কী একবারও আফসোস আসেনি যে, মফস্বল ছেড়ে কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হই? না, না, দেখো রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসংখ্য লেখা আমার এই অঞ্চলে বসেই লিখেছেন। ‘পোস্ট মাস্টার’র মতো গল্প এবং আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে। তো আমার কেন আফসোস? আমি লিখে পরিতৃপ্ত। আর ক’টা দিন আছে, জীবনের বাতি নিভে যাবে সহসায়। তোমরা লিখো, এদেশ কবিতার দেশ। এখানেই শেষ। এই প্রথম দেখা, এটাই শেষ দেখা। উৎসব শেষে চলে গেলেন নিজের বসত ভিটায়। সম্ভবত মাস চারেক পরেই ৩ ডিসেম্বরে তিনি চলে যান সুদূরের পথে।
ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাহিত্য নির্দিষ্ট করে কবিতার কথা বললে, আশির দশকের গোড়া থেকে আমি ঢাকায় আছি, সশরীরে দেখেছি কবি সুফিয়া কামাল, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান থেকে পঞ্চাশের দশক থেকে ঢাকায় অবস্থানরত ষাট, সত্তর, আশির প্রায় সকল কবিকে কাছে থেকে দেখেছি। তখন দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক সাহিত্য সাময়িকী দেখার জন্য উদগ্রীব থাকতাম। যে জ্যেষ্ঠ কবিদের কথা বললাম, তাদের কবিতা দিয়েই সিরিয়াল শুরু হতো। অর্থাৎ প্রথমে আবুল হোসেন, তারপর শামসুর রাহমান এভাবে। আরো দেখতাম কয়েকটি নাম কবি দিলওয়ার, কবি আজিজুল হক ও কবি ওমর আলীর কবিতা। জেনেছি, দিলওয়ার সিলেট, আজিজুল হক যশোর এবং ওমর আলী বগুড়া থেকে লেখেন। আমি এই তিনজনের কবিতা পড়ে তখনই বিমোহিত হতাম। বিশেষ করে ওমর আলী। ঢাকায় থাকি বলে, কখনো তাঁর সঙ্গে সরাসরি দেখা হয়নি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’র এই শিরোনামের কবিতাটি দিয়েই তিনি কবিতার পাঠকের হৃদয় জয় করে ফেলেছেন। যেমন সত্তরের কবি আবিদ আজাদ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঘাসের ঘটনা’র শিরোনামের কবিতা দিয়ে আজো জ্বলজ্বল করছেন। যেমন রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’, যেমন নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’, যেমন আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলো শোকের’, যেমন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’, যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অবনী বাড়ি আছো’, যেমন আল মাহমুদের ‘নোলক’ যেমন শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ বা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার সঙ্গে সবাই স্বীকার করবেন, এই কবিতাগুলো বাংলা কবিতার কালজয়ী কবিতা। পাশাপাশি দুঃখের সঙ্গে বলে রাখি, পরবর্তীকালে আর কোনো কবিকে কী এ রকম একটি কবিতা দিয়ে চেনা যায়? কেন যায় নাসেটি অন্যখানে একদিন বলা যাবে। তাই আমি মনে করি, কবি ওমর আলীর আলোচ্য কবিতাটিও বাংলা কবিতার একটি নন্দিত কবিতা।
কবি ওমর আলী ছিলেন সমকালীন বাংলা কবিতার খ্যাতিমান কবি। ষাটের দশকে তাঁর কবিতার স্ফূরণ ঘটে। কবিতায় তিনি ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। পদ্মা, করতোয়া, ইছামতী ইত্যাদি নদীর অববাহিকায় শ্যামল বাংলার নিবিড় কূলে পুরো জীবন পার করে গেছেন নির্দ্বিধায়। এবং মফস্বলাক্রান্ত গ্রামীণ জীবন তাঁকে আচ্ছাদিত করে রাখলেও তিনি মনে-প্রাণে ছিলেন আধুনিক ও গণমুখি মানুষ। চেতনায় ছিলেন মানবতাবাদী। ধারণা করি, আবুবকর সিদ্দিক, আতাউর রহমান, হাসান আজিজুল হকের মতো তিনিও উত্তর বঙ্গের গ্রামাশ্রিত মাটি ও মানুষের ঘ্রাণ নিয়েই বাংলাদেশের কবিতার মূল স্রোতের সঙ্গেই প্রবলভাবে বাস করেছেন। এই বসবাস তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠার মতো অর্থাৎ তিনি তাঁর কবিতা দিয়ে জয় করেছিলেন অথবা টিকে গেছেন মূল স্রোতধারায়। তাঁর সম্পর্কে এক আলোচনায় বলা হয়েছে: ‘ওমর আলীই একমাত্র কবি যিনি গভীর মমতায় গ্রাম আর গ্রামের মাটিকে কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন আপাদমস্তক, বলতে পেরেছেন ‘লোকটা সুতি কাপড় পরেনি, পরেছে শুধু মাটি’।
তাঁর সব কবিতাগ্রন্থ গ্রামের নিখাঁদ গন্ধে ভরা। একই সঙ্গে গ্রামের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দুঃসহ জীবন যন্ত্রণাকে খুঁটে খুঁটে দেখেছেন, দেশ-কাল, সমাজ-রাষ্ট্র-স্বাধীনতা, জৈবিকতা-প্রবৃত্তি নানা বিষয় উপজীব্য করেছেন কবিতায়। বেদনার্ত মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা নিজের করে পাশে থেকেছেন। তাঁর প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থই এর সত্যতা বহন করে’।১
‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’খ্যাত ওমর আলী নিভৃত পল্লীর একজন গ্রামবাংলার কবি। নিসর্গজাত কবি। স্বভাব কবিও বলা যায়। কাব্য প্রতিভা তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কবিতাই ছিল তার আরাধনা বা আরাধ্য দেবতা। মনোজগতের আরাধ্য বেদিতে কবিতাকে ঠাঁই দিয়েছিলেন। ষাটের দশকের এ কবি মূলত প্রেম ও রোমান্টিকতা, নিসর্গ ও সৌন্দর্য চেতনায় নিমগ্ন ছিলেন। তিনি রোমান্টিক প্রেমের ও সৌন্দর্যচেতনার কবি হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। কাব্যের অনুষঙ্গ হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন নারী, নিসর্গ ও গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে। তার কবিতায় উপমা ও উৎপ্রেক্ষা অসাধারণ ও বিচিত্রতায় পরিপূর্ণ যা শিল্প মাধুর্যে ভরপুর। আপন মনে শিল্পীর আঁচড়ে তিনি কবিতাগুলোকে শিল্পমানে রূপ দিয়ে পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ৪১টি। ৩৮টি কাব্যগ্রন্থ, একটি ছড়ার বই ও দু’টি উপন্যাস। তিনি ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ কাব্যটি রচনার জন্য ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং কাব্য সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।২
বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করা কবি বসবাস করতেন চর কোমরপুর গ্রামে। তাই বলে কী তাঁকে গেঁও বলবেন, না বলতে পারবেন না? দেখুন তাঁর সরাসরি ছাত্র কবি ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ কী বলেছেন? বলেছেন, ‘চর কোমরপুরের যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, তার ঠিক কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে পদ্মা পেরুলে শিলাইদহ কুঠিবাড়িÍযেখান থেকে বিশ্বকবি অনেক গল্প-কবিতা লিখেছিলেন; তার সেই স্মৃতিকে দেখার জন্য দেশ-বিদেশের কবি-সাহিত্যিক ও গবেষকদের নিত্যভিড় লেগে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পদ্মাপারের অতিথি, তারও আফসোস ছিল, তিনি এই জনপদের মানুষের জীবনযাপন ভেতর থেকে জানেন না বলে ঠিকঠাক মতো তার সাহিত্যে সে-সব ধরতে পারেননি; তিনি মনে করতেন, কোনোদিন যদি এই জনপদের নিজস্ব কবির আবির্ভাব ঘটে সেদিন ঠিক মতো এ জনপদের জীবনচিত্র ফুটে উঠবে; ওমর আলী সেই জাতের কবি ছিলেন…।’৩
গ্রামীণ জনপদের কবি হলেও শামসুর রাহমান কিম্বা বদলেয়ারসহ সমকালীন আধুনিক কবিদের সঙ্গে তাঁকে পার্থক্য করা যাবে না। গ্রামে অবস্থান করেছেন বলে তাকে স্বভাব কবিও বলা যাবে না। তিরিশোত্তর বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমান যেমন নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণ করে স্বতন্ত্র সত্ত্বায় একজন আধুনিক কবি অভিধায় খ্যাতিমান হয়েছেন, তেমনি ওমর আলীও জসীমউদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া এবং কিছুটা আল মাহমুদের মত স্বতন্ত্র ধারায় কবিতা লিখেছেন একজন আধুনিক কবির পদবাচ্যে। যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর পড়াশোনা এবং জানাশোনা, সেখানে একজন ইংরেজির অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশের মতো তিনিও মনে-প্রাণে আধুনিক এবং উচ্চাঙ্গের কবিতা তিনি লিখেছেন।
কবি ওমর আলী ছিয়াত্তর (১৯৩৯- ২০১৫) বছরের জীবনের পুরোটাই গ্রামীণ মানুষের পাশাপাশি প্রেম ও প্রকৃতির নিবিষ্ট সাধক ছিলেন। প্রথম দিকে সবার মতো তিনি রোমাণ্টিক ভাবনার কবিতায় মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সমাজ, দেশ ও মানুষ হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতার উপজীব্য। প্রকাশিত ৩৮টি কবিতাগ্রন্থের কবিতাসমূহে তাঁর সমস্ত ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। কবি শামসুর রাহমান তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ দিয়ে যেমন বাংলা কবিতায় তাঁর আগমনী বার্তা দেন, বিশেষ করে প্রথম গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘রুপালি স্নান’ দিয়ে, তেমনি কবি ওমর আলীও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ দিয়েই, বাংলা কবিতায় আগমনী বার্তা দেন। আর গ্রন্থ শিরোনামের কবিতাটি হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের একটি সেরা কবিতা। কবিতাটি তুলে ধরছি:
‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।
সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো
মায়াবী উচ্ছ্বাস দুটি চোখ, তার সমস্ত শরীরে
এদেশেরই কোন এক নদীর জোয়ার বাঁধভাঙা;
হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে।
সে চায় ভালবাসার উপহার সন্তানের মুখ,
এক হাতে আঁতুড়ে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,
সে তার সংসার খুব মনে-প্রাণে পছন্দ করেছে;
ঘরের লোকের মন্দ-আশঙ্কায় সে বড় করুণ।
সাজানো-গোছানো আর সারল্যের ছবি রাশি রাশি
ফোটে তার যত্নে গড়া সংসারের আনাচে-কানাচে,
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর এ ব্যাপারে খ্যাতি;
কর্মঠ পুরুষ সেই সংসারের চতুষ্পার্শ্বে আছে।’
কবিতাটি ১৬ চরণের। শব্দ আছে ১১৫টি। এই বিষয় কী? গ্রামের একজন সাধারণ নারী। কবি যাকে রমণী বলেছেন। তিনি দেখতে কেমন? বাংলার শ্যামল রঙের মতো। দ্বিতীয় বাক্যে উপমা দিয়ে বলেছেন, আইভি লতার মতো সেই নারীর আছে সরল হাসি। অর্থাৎ হাসি ও চলনে সেই নারী লতার মতো আঁকা বাঁকা হয়ে উঠেন। গোছল সেরে যখন রোদে শাড়ি ছড়াতে যান, তখন তাঁর রূপ ফুটে ওঠে আবারতা হলো কুমোরের তৈরি মাটি দিয়ে পটের মতো। আবার উপমায় বলেন, সেই রমণীর চোখ হরিণের চোখের ন্যায়। চোখের পর শরীর। জোয়ার যেমন নদী তীরের বাঁধ ভেঙে দেয়, তেমনি যৗবনবতী সেই নারীর শরীর টগবগ করে। দেখুন আবার লতার উপমা নিয়ে এসে বলছেন, সেই টসবগে শরীর যেখানে টসটসে যৌবন, তা ঢেকে রাখে লতার মতো পেচানো শাড়ি দিয়ে। এই প্রথম ৮ চরণের বাহ্যিক বর্ণনা। এবার আসুন পরের ৮ চরণের বর্ণনায়। কী বলছেন তিনি? বলছেন, এই ভরা যৌবনা নারী কী চায়? চায় পুরুষের মিশ্রণে এসেসরিষার দানার মতো ফসল অর্থাৎ সন্তান। একজন নারী একজন মা হতে চান। মা তার শিশুকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে রান্না করবেন, উনুন সামাল দেবেন। একজন নারী স্বামী-সংসার নিয়ে সুখী হতে চান। এই চাওয়া গ্রামের শতভাগ নারীর চাওয়া। কবিতার নারীটিও মনে করেন হয়ত সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কিন্তু সংসার একমুখী স্রোতে নয়। স্রোতের মধ্যে ঢেউ থাকে। প্রবল ঢেউ কখনো ভিটে বাড়িতে এসে বারি খায়। কখনো কখনো তসনস হয় ঘরদোর। নারী তখনো ভালাবাস সংজ্ঞা দিয়ে নির্মাণ করতে চান চাঁদ। গায়ে মাখেন জ্যোৎস্নার আলো। আলো রং মৃদু। সেই রং পুরুষকে খেয়াল করতে হয়। এই তো কবিতাটি।
কবিতার বহির্রাঙ্গের ব্যাখ্যায় আমি যাবো না। শুধু বলবো, হাজার বছরের শ্যামল বাংলা ও বাংলা চিরায়ত নারী, নারী আকাঙ্ক্ষা এবং গ্রামীণ জীবনের সংসার ও সংসারাশ্রিত মানুষের এক অপরূপ বর্ণনা এই কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। যে মাটির ঘ্রাণে কবি ওমর আলী সকাল-সন্ধ্যা-রাত্রি পার করেছেন, সেই মাটির নির্যাসমাখা চিরন্তন সুর এখানে পরিস্ফূটিত হয়েছে। ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ আমার একটি প্রিয় কবিতা। কারণ আমিও মাটির ঘ্রাণ নিতে ভালোবাসি। জীবনানন্দ দাশকে দিয়েই শেষ করিÍ বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি…।
তথ্যসূত্র: ১. রকিবুল হাসান, ওমর আলী; স্বতন্দ্র ধারার কবি; দৈনিক জনকণ্ঠ, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ২. আদ্যনাথ ঘোষ, কবি ওমর আলীর কবিতা জীবন ও দর্শন; দৈনিক ভোরের কাগজ, ২২ অক্টোবর ২০২০ ৩. মজিদ মাহমুদ, একান্ত অনুভবে কবি ওমর আলী; বাংলা ট্রিবিউন; ১০ ডিসেম্বর ২০১৫




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com