আমাদের জীবনের বিভিন্ন ধাপের (শিশু, যৌবন ও বৃদ্ধাবস্থা) বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও চাহিদা রয়েছে। তেমনি বয়ঃসন্ধিকাল মানুষের জীবনের এমন একটি ধাপ যখন মানুষ কৈশোর ও যৌবনের মাঝামাঝি অবস্থায় থাকে। এই ধাপটি খুব সংবেদনশীল একটি বয়স। উপযুক্ত দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা এবং সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ এ বয়সীদের তাদের সদ্য যৌবনে খাপখাওয়াতে সাহায্য করে। এই বয়সীদের প্যারেন্টিং করতে মুসলিম পিতা-মাতার উচিত কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা। মুসলিম টিনএজাররা বেড়ে উঠবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবধারার। ঈমান, আকিদা, তাকওয়া, হালাল ও হারাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হবে তার চলার পথের পাথেয়।
পাশ্চাত্যের প্যারেন্টিং ধরনের সাথে আমাদের মুসলিম টিনএজ প্যারেন্টিং ধরনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, ইসলামী শরিয়াহ মতে, বালেগ হওয়ার লক্ষণ প্রকাশের পর থেকে একটি শিশু আর শিশু থাকে না। সে হয়ে যায় সদ্য যৌবনে পদার্পিত যুবক। এটি শারীরিক গঠন অনুযায়ী বিভিন্ন বয়সে হতে পারে। ১২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সকেই সাধারণত বয়ঃসন্ধি পিরিয়ড ধরা হয়। বালেগ হওয়ার পরপরই শরিয়াহ মতে তার ভালো ও মন্দ কাজের হিসাব লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়ে যায়। তাই মুসলিম পিতা-মাতার প্রধান কাজ এ সম্পর্কে সন্তানকে সতর্ক করা। বয়ঃসন্ধির এই সংবেদনশীল সময়ে সঠিক গাইডলাইনের অভাবে অনেক ছেলেমেয়েই মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের নৈতিক অবক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই পিতা-মাতা যদি আল্লাহর ভয়ের বীজ তাদের মনে বপন করতে পারেন, তাহলে আশা করা যায় শত ঝড়ঝাপটায়ও তারা নিজেদের হারিয়ে ফেলবে না।
সূরা লোকমানে আমরা জানতে পারি, লোকমান হাকিম তার কিশোর ছেলেকে আল্লাহর ভয়ের বীজ বপন করেছেন এভাবে-
‘হে বৎস! কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তরগর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সব কিছুর খবর রাখেন’ (সূরা লোকমান-১৫)।
তিনি আরো উপদেশ দেন যে, ‘হে বৎস! নামাজ কায়েম করো, সৎ কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজে নিষেধ করো এবং বিপদ-আপদে সবর করো’ (সূরা লোকমান-১৫)। লোকমান হাকিম তার টিনএজ ছেলেকে সবার আগে আল্লাহর পরিচয় শিক্ষা দিয়েছিলেন। কারণ একজন বালেগ মুসলিম হিসেবে তার এখন জানা আবশ্যক কি তার অবশ্যই করণীয় ও কি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। সুতরাং আমাদেরও উচিত টিনএজ সন্তানকে এভাবে নাসিহা দেয়া তার করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে। বালক আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা:কে রাসূলুল্লাহ সা: উপদেশ দিয়েছিলেন এভাবে- ‘হে বালক, আমি তোমাকে কিছু জিনিস শিক্ষা দিচ্ছি।… আর যখন সাহায্য চাও আল্লাহর কাছেই চাও। আল্লাহকে স্মরণ করো সচ্ছলতা ও সুখের সময়, তাহলে তুমি তাকে তোমার কঠিন সময়ে পাবে।… জেনে রাখো, ধৈর্যের সাথেই বিজয় আসে’ (তিরমিজি)।
শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে টিনএজ ছেলেমেয়েরা এ সময় একটি নাজুক অবস্থার ভেতর দিয়ে যায়, তাই প্যারেন্টদের তাদের হ্যান্ডেল করতে কৌশলী হওয়া জরুরি। কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি বেশ কিছু আদব।
প্রথমত, আমাদের উচিত তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। তাদের সম্মানের সাথে ভালোবেসে কথা বলা। যাতে করে তারা বুঝতে পারে আমরা তাদের আবেগ অনুভূতির ব্যাপারে যতœশীল। ইবরাহিম আ:কে যখন আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন বালক ইসমাইল আ:কে কোরবানি করতে, তখন ইসমাইল আ: ছিলেন ১৩ বছরের বালক। তিনি আল্লাহর এই নির্দেশ ছেলেকে জানান একজন স্নেহশীল বাবার মতো করে, যিনি কি না তাঁর ছেলের পরামর্শ চাচ্ছিলেন এভাবে-
‘পুত্র আমার! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি, এখন তোমার অভিমত কী? ( ভেবে দেখো)। সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন’ (৩৭ : ১০২)। একইভাবে সূরা লোকমানে আমরা দেখি- লোকমান হাকিম তার ছেলেকে সম্বোধন করেছেন এভাবে- ‘ইয়া বুনাইয়া বলে’। আরবি ভাষায় এটি একটি আদর ও মমতাপূর্ণ সম্ভাষণ। বাংলায়, ‘হে আমার বৎস!’ বলে। বাংলা ভাষায়ও বৎস শব্দটি ছেলের তুলনায় বেশি আদর প্রকাশ করতে ব্যবহার হয়। এখানে ছেলেকে পিতা উপদেশ দিয়েছিলেন অত্যন্ত কোমলভাবে স্নেহের ও যথাযথ সম্মানের সাথে। এই দু’টি ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, কঠোরতার চেয়ে স্নেহের সাথে নম্রভাবে বোঝানোতে সন্তানরা শিখতে আগ্রহী হয় বেশি।
একটি ব্যাপার আমাদের মাথায় রাখতে হবে, এ বয়সী সন্তানরা শারীরিক গঠনে দেখতে বড় হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু এদের বিভিন্ন অর্গানের গঠন তখনো পুরোপুরি শেষ হয় না। বিশেষ করে ব্রেন ও লিভার। গবেষণা বলছে, ২০ বছরের মাঝামাঝিতে গিয়ে আমাদের ব্রেনের গঠন পুরোপুরি শেষ হয়। তাই টিনএজারদের ব্রেনের অসম্পূর্ণতার জন্য তাদের চিন্তা-চেতনা ম্যাচিউরড থাকে না। তারা বেশি আবেগপ্রবণ হয়, ইমোশনালি অপরিপক্ব থাকে।
এ ছাড়া এ সময় হরমোনজনিত পরিবর্তন আসে অনেক। এ কারণে তাদের মুড সুয়িং হয়। তারা মুডি হয়ে যায়, কম কথা বলে অথবা খুব সাধারণ কিছু নিয়েও অনাকাক্সিক্ষত রিয়েক্ট করে। বেশির ভাগ মা-বাবাই সন্তানের এ ব্যাপারগুলো নিয়ে হতাশ থাকেন। সন্তানদের অপ্রাসঙ্গিক আচরণ তাদের বিব্রত করে। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে এটিই স্বাভাবিক এ বয়সীদের জন্য। এ সময়টাতেই আমাদের সবচেয়ে বেশি তাদের ইমোশনাল কেয়ার দেয়া উচিত। তাদের আশ্বস্ত করা যে, আপনি তার পাশে আছেন। এ সময় মা-বাবার ভূমিকা হওয়া উচিত লাইফ কোচের মতো। তার সমস্যা সেই মোকাবেলা করবে, কিন্তু আপনি ভালো ও মন্দ দিক বাতলে দেবেন। তাকে সমাধান করতে বলবেন। তার আবেগকে মূল্যায়ন করবেন। তাকে অভয় দিয়ে বলবেন- এমন হওয়াটা খুব স্বাভাবিক এবং আমি জানি তোমার এখন কেমন লাগছে। কিন্তু আমি তোমাকে কিভাবে ইমোশনকে হ্যান্ডেল করতে হয় সে ব্যাপারে সাহায্য করব। এতে করে তার লাইফ স্কিল ডেভেলপড হবে। প্রবলেম সলভিং স্কিল বাড়বে। সে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে শিখবে। যেহেতু তাকেও আস্তে আস্তে দায়িত্ব নিতে শিখতে হবে, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে একাই সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে।
তাকে কিছু পারসোনাল স্পেস দিতে হবে। তা সব কিছুতে হস্তক্ষেপ করা উচিত না প্যারেন্টসদের। কারণ সে এখন আর ছোট নেই, তাই সে আমাদের মতো করেই প্রাইভেসি চায়। সার্বক্ষণিক নজরদারি করলে সে বিরক্ত হবে, আপনার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। তবে আপনি অবশ্যই গোপনে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবেন। নেতিবাচক কোনো কিছু দেখলে আমাদের রিঅ্যাকশন যেন না হয় তাদের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করা। কারণ এর ফল খারাপ ছাড়া ভালো কিছু হবে না। এতে আপনার সাথে তার দূরত্ব আরো বাড়বে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের ধৈর্যসহকারে হ্যান্ডেল করতে হবে। রাগ হওয়া সত্ত্বেও আপনি যথাসম্ভব শান্ত থেকে তাকে কাউন্সিলিং করার চেষ্টা করুন। তাকে প্রশ্ন করতে পারেন এভাবে, ‘যদি তোমার সন্তান তোমার সাথে এ আচরণ করত তাহলে তুমি কী করতে।’ এভাবে করলে আপনার সাথে তার বন্ধন আরো দৃঢ় হবে, সে আপনাকে বিশ্বাস করবে। আপনাকে তার বিশ্বাস ও ভরসার জায়গাটা নিতে হবে। এর ফলে আপনি তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পাবেন। কারণ আপনি জানেন, দিন শেষে সে আপনার কাছেই সাহায্য চাইবে।
এর মানে এই নয় যে, তাকে শাসন করা যাবে না। আদর শাসনের ভারসাম্য থাকতে হবে। কিছু কমন রুলস ঠিক করা থাকবে, যা সে মানতে বাধ্য। যেমন- ইসলামিক রুলিংসগুলো বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে চলা, সন্ধ্যার আগে বাসায় ফেরা ইত্যাদি কিছু জিনিস। দৃঢ়ভাবে এ ব্যাপারে তাকে বলা থাকবে। আবার আদরের আতিশয্যে আমরা যেন এমন না হয়ে যাই যে, যা চায় তা সাথে সাথে দিয়ে দেই। না চাইতে সব পেয়ে গেলে একসময় তার চাওয়া লিমিট ক্রস করে ফেলবে। তখন আমরা হা-হুতাশ করি; কিন্তু ভুলে যাই এর জন্য আমরাই দায়ী। তাদের বুঝতে দিতে হবে, কিছু পেতে হলে আমাদের কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। তাকে তার প্রিয় কোনো কিছু অর্জনের প্রাপ্তি হিসেবে দেবেন। তাহলে সে মূল্যায়ন করতে শিখবে ছোটখাটো সব প্রাপ্তিকেই।
মোট কথা, তাদেরকে জীবনবোধ শিক্ষা দিতে হবে। শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবা, নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকলে হবে না। তাকে এটি শেখাতে হবে যে, তার নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। অন্যের জন্য হাসিমুখে কিছু করা, নিজের আরাম-আয়েশ বিসর্জন দেয়ার শিক্ষা দিতে হবে। এ জিনিসগুলো শিক্ষা দেয়ার সবচেয়ে ফলপ্রসূ উপায় হচ্ছে আপনি নিজে একই কাজগুলো করা। তখন আপনাকে দেখে অবচেতন মনেই সে এ কাজগুলো করতে অনুপ্রাণিত হবে।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর টিনএজারদের তারবিয়া পদ্ধতি আমাদের জন্য মডেল। তিনি ছিলেন তার আশপাশের বালকদের কাছে আশ্রয় ও ভরসার জায়গা। তাদের সাথে তার আচরণ ছিল কোমল ও ভালোবাসাপূর্ণ। আনাস রা: ছোট থেকে বেশ লম্বা সময় ধরে রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে ছিলেন। তিনি বলেন, নবীজী কখনো তার সাথে উহ্ শব্দটিও করেননি। তিনি কিশোরদের যথাযথ সম্মান দিতেন। একবার কোনো এক মজলিসে তিনি খেতে বসেছিলেন, যেখানে তাঁর ডানপাশে এক কিশোর বসেছিল। যেহেতু মজলিসের আদব হলো ডানদিক থেকে বিতরণ করা তাই তিনি সেই কিশোরের কাছে অনুমতি চাইলেন মজলিসে উপস্থিত প্রবীণদের আগে খাবার বিতরণ করবেন কি না!; কিন্তু কিশোর ছেলেটি অনুমতি না দেয়ায় তাকে দিয়েই শুরু করেন। আমরা কল্পনা করতে পারি এ ঘটনা! সে জায়গায় আমরা হলে হয়তো ভাবতাম এই ছেলের অনুমতি নেয়ার কী আছে। বড়দের দিয়েই শুরু করতে হবে। এ ধরনের উত্তম তারবিয়ার কারণে তাঁর চারপাশের তরুণরা ছিল আত্মবিশ্বাসী ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। এরাই পরবর্তীতে উম্মাহর কা-ারি হয়েছিল।
হজরত আলী রা:-এর একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে- আমরা যেভাবে বড় হয়েছি, সেভাবে আমাদের সন্তানদের বড় করা যাবে না। কারণ তাদের যুগ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের এ যুগের শিশুরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সাইক্রিয়াটিক ইস্যু ফেস করছে। তাদের যুগের সাথে তাল মেলাতে অনেক বেশি মানসিক চাপ নিতে হয়। তাই প্যারেন্ট হিসেবে আমাদের অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হতে হবে তাদের প্রতি। প্রকৃতপক্ষে টিনএজার হ্যান্ডেলিং কোনো রকেট সাইন্স নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এদের সাথে স্বাস্থ্যকর একটি বন্ডিং তৈরি করতে হলে আমাদের অনেক ধৈর্যশীল হতে হবে, অনেক দোয়া করতে হবে সহজতার জন্য। এর বিনিময়ে মা-বাবা আল্লাহর কাছে সম্মানিত ও পুরস্কৃত হবেন। কেননা, নেক সন্তান মা-বাবার জন্য সাদকায়ে জারিয়া। আবার আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও সন্তান বিপথে গেলে আল্লাহ আপনাকে পাকড়াও করবেন না। কেননা, আমরা জানি পিতা নবী হওয়া সত্ত্বেও নূহ আ:-এর ছেলে বিশ্বাসী ছিল না। সেখানে আমরা তো সাধারণ মানুষ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সন্তানদের সাদকায়ে জারিয়া হিসেবে কবুল করুন। আমীন।