রাসায়নিক সারের চাহিদা পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। দেশে রাসায়নিক সারের বার্ষিক চাহিদা ৬০ লাখ টনেরও বেশি। এর প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। আমদানীকৃত রাসায়নিক সারের মধ্যে প্রধানতম হিসেবে বিবেচিত হয় চারটি—ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ডাইঅ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও মিউরেট অব পটাশ (এমওপি)। এর মধ্যে টিএসপি ও ডিএপি আমদানি হয় সৌদি আরব, চীন, কাতার, মরক্কো ও তিউনিসিয়া থেকে। এমওপি সারের ৪০ শতাংশ আসে কানাডা থেকে। বাকি ৬০ শতাংশের জন্য বেলারুশ ও রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া টিএসপি ও ডিএপি সারও কিছু পরিমাণে রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। তবে বর্তমানে এমওপি সার আমদানি নিয়েই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হচ্ছে বোরো ও রবি মৌসুম। দেশে খাদ্যশস্য সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় এ মৌসুমেই। সারসহ চাষাবাদে প্রয়োজনীয় উপকরণের চাহিদাও এ সময় থাকে সবচেয়ে বেশি। সরকারি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশে রাসায়নিক সারের বার্ষিক ব্যবহারের ৭০ শতাংশেরও বেশি হয় শুধু বোরো ও রবি মৌসুমে। যদিও এবার মৌসুমটিতে সারের প্রয়োজনীয় জোগান নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারের আন্তর্জাতিক বাজার এমনিতেই মারাত্মক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তার ওপর আমদানির প্রধান উৎস যুদ্ধ উপদ্রুত এলাকা হওয়ায় সেখান থেকে আমদানি ও পরিবহন অব্যাহত রাখা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে। বিকল্প উৎস থেকে আমদানি বৃদ্ধি এবং তা টেকসই করা না গেলে দেশের কৃষি উৎপাদনে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।
যদিও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এ মুহূর্তে দেশে সারের সংকট নিয়ে তেমন কোনো আশঙ্কার কারণ নেই। যুদ্ধ শুরুর আভাসে বিকল্প উৎস হিসেবে কানাডা থেকে এমওপি সার আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তিও হয়। চুক্তি অনুযায়ী সার এরই মধ্যে দেশে আসতে শুরু করেছে। সে হিসেবে আসন্ন বোরো মৌসুমে সার সংকট দেখা দেয়ার তেমন কোনো আশঙ্কা নেই। তবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আগামী বছরের মাঝামাঝি দেশে সার সংকট দেখা দিতে পারে।
আসন্ন বোরো মৌসুমসহ চলতি অর্থবছরে সারের সংকট দেখা দেয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বলে মনে করছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলাই কৃষ্ণ হাজরা। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ সার মজুদ আছে, তা গত বছরের চেয়ে বেশি। কোনো সারেরই সংকট নেই। দেশে বছরে মোট সাড়ে নয় লাখ টন এমওপি প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে চাহিদা রয়েছে সাড়ে সাত লাখ টন। বাকি দুই লাখ টন নিরাপত্তা মজুদ হিসেবে রাখা হয়। গত বছর কানাডা থেকে দেড় লাখ টন, বেলারুশ থেকে দুই লাখ টন এবং রাশিয়া থেকে প্রায় ছয় লাখ টন এমওপি সার আমদানি করা হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া থেকে আমদানি করা যায়নি। যদিও যুদ্ধের আভাস পেয়ে চলতি অর্থবছরের জন্য কানাডা থেকে দেড় লাখ টনের জায়গায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন পটাশ আমদানির চুক্তি করা হয়েছিল। এটি ছিল দুই দেশের সরকারের মধ্যে চুক্তি (জি-টু-জি)। এরই মধ্যে কানাডা থেকে সার আসাও শুরু হয়েছে। কানাডার সঙ্গে এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশ কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে। আর বাকি থাকল চার লাখ টন। এটা নিয়ে কিছু সংকট হতে পারে। তবে চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২২-২৩ সালে কোনো সংকট হবে না। এবার বোরো মৌসুমের জন্য পর্যাপ্ত সার মজুদ রয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত কোনো সারেরই সংকট হবে না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই রাশিয়ার সঙ্গে অন্যান্য দেশের পণ্য বাণিজ্য নিয়ে একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। তবে সার ও খাদ্যশস্যসহ প্রয়োজনীয় বেশকিছু পণ্য এখনো এ বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রয়ে গিয়েছে। এর পরেও কোনো ব্যাংক রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানিতে এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না বলে দেশের বাণিজ্য খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
স্থানীয় সার কারখানাগুলোয় কিছু পরিমাণে ইউরিয়া, টিএসপি ও ডিএপি উৎপাদন হলেও বাংলাদেশ এমওপির জন্য পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ইউরিয়া সার উৎপাদন হয়েছে ৭ লাখ ৯৮ হাজার টন আর আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৬৬ হাজার টন। টিএসপি উৎপাদন ও আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭১ হাজার ও ৬ লাখ ৭৫ হাজার টন। ১ লাখ ২ হাজার টন ডিএপি সার উৎপাদন ও আমদানি হয়েছে ১৬ লাখ ৩০ হাজার টন। একই সময়ে এমওপি সার উৎপাদন না হলেও আমদানি হয়েছে ৯ লাখ ৩ হাজার টন। মূলত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) মাধ্যমে দেশে রাসায়নিক সার আমদানি করা হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিএডিসি সূত্র জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে মোট ৬৯ লাখ টন সার ব্যবহার হয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি—চার ধরনের সার ব্যবহার হয় ৫৭ লাখ টন। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও সারের চাহিদা প্রায় সমান থাকবে। সরকারি পূূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশে চলতি অর্থবছরে ইউরিয়া সার ব্যবহার হতে পারে প্রায় ২৬ লাখ টন। এছাড়া টিএসপি সাত লাখ, ডিএপি ১৫ লাখ ও এমওপি সাড়ে সাত লাখ টন ব্যবহার হতে পারে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ (এফএও) স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আগামী বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট তীব্র হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। এ সংকট মোকাবেলার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে খাতসংশ্লিষ্টদের সবাই এখন খাদ্যোৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর আরোপ করছেন। সারসহ প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত জোগান ছাড়া এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিশ্বব্যাপী একটি সংকট আমাদের সামনে। আমাদের দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে বোরো মৌসুম সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে। সুতরাং এ মৌসুমকে যেকোনো মূল্যে সংকট থেকে মুক্ত রাখতে হবে। প্রয়োজনে অন্য খাতের বরাদ্দ কমিয়ে এখানে দিতে হবে।
সার আমদানির ক্ষেত্রে এখনই বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এমওপি সারের পুরোটাই আমদানি করতে হয়। এর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসত রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। এখন যেহেতু যুদ্ধের কারণে আমদানি করা যাচ্ছে না, ফলে এ সার নিয়ে ভবিষ্যতে এক ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। সুতরাং এখনই বিকল্প চিন্তা করতে হবে। রাশিয়া ছাড়া অন্য যেসব দেশ সার উৎপাদন করে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে সেসব দেশ থেকে আমদানি করতে হবে। কারণ যুদ্ধ যে সহসাই থামবে এমনটা বলা যাচ্ছে না। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের পূর্বাভাসও দিচ্ছে। সুতরাং আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। বর্তমানে মজুদ থাকলেও ভবিষ্যৎ মজুদ যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
কভিডের প্রাদুর্ভাবকালেও দেশে সার সরবরাহ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। তবে বিশ্বব্যাপী পণ্যটির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে থাকে গত বছর থেকে। মহামারীর অভিঘাত ও বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝির দিকেই বিশ্বব্যাপী সারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় আগের বছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণে। পাশাপাশি আমদানিতে সারের দাম বাড়ার পাশাপাশি পরিবহন খরচও বাড়তে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। চলমান এ যুদ্ধ সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছে। এর সঙ্গে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে মুদ্রাবাজারে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের ক্রমাগত পতন। এতে আমদানি ব্যয়ের বোঝা আরো বড় হয়েছে সরকারের। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিকে বড় আশঙ্কায় রূপ দিয়েছে চলমান রিজার্ভ সংকট।
বিষয়টি নিয়ে দেশের কৃষি খাতের নীতিনির্ধারকরাও বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্যে বলেছেন, একদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সারের জন্য বিপুল ভর্তুকি দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। আবার পণ্যের মূল্যস্ফীতি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করার আশঙ্কায় ভর্তুকি ব্যয় কমানোও যাচ্ছে না। যদিও বাজার স্থিতিশীল না হওয়ায় সার বাবদ বিশাল অংকের ভর্তুকি অব্যাহত রাখাও সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। সর্বশেষ গত আগস্টে ইউরিয়া সারের মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে সে ইঙ্গিতই পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে জ্বালানি সংকট আরো তীব্রতর রূপ নেয়ায় সারের স্থানীয় উৎপাদন অব্যাহত রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্যাস সংকটে এরই মধ্যে উৎপাদনকারী চারটি কারখানার মধ্যে দুটি বন্ধ হয়ে পড়েছে। বর্তমান সংকট চালু থাকলে চলমান কারখানাগুলোর উৎপাদন চালু রাখাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। যদিও বিসিআইসি চেয়ারম্যান শাহ মো. ইমদাদুল হক চলতি সপ্তাহেই এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি কারখানার উৎপাদন পুনরায় চালু হতে যাচ্ছে।
আসন্ন বোরো মৌসুমে সারের সর্বোচ্চ সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সাবেক খাদ্য সচিব মো. আবদুল লতিফ মন্ডল। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গত কয়েক মাসে সারের অবস্থা কিন্তু খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। যুদ্ধ দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সামনে বোরো মৌসুম আসছে। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বোরো মৌসুমে কৃষক জ্বালানির কারণে সেচ নিয়ে বিপদে পড়তে পারেন। শিগগিরই পরিবর্তনের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে আবার সার সংকট দেখা দিলে মহাবিপর্যয় দেখা দেবে। কারণ বোরো মৌসুমই দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে। আসন্ন সংকট কাটাতে বোরো মৌসুমের দিকে সবাই তাকিয়ে আছে।