‘মার দৈ, মৈ কা মরবে কো ডরাত হোঁ? জৈসে ইত্তে সিপাই মর্ তৈসে এক মৈ সই।’ ‘মেরে ফেলো আমায়। আমি কি আর মৃত্যুকে ভয় পাই? এত্ত এত্ত সেপাই মারা গেল যুদ্ধে, না হয় আমিও মরে গেলাম।’ দোর্দ-প্রতাপ সেনাপ্রধানের চোখে চোখ রেখে বলল মেয়েটি। মেজর জেনারেলের শিবিরে মেয়েটিকে নিয়ে ততক্ষণে হইহই-রইরই কা- শুরু হয়ে গেছে। ছোট-বড় সব সেনাপ্রধান এসে জড়ো হয়েছেন তার শিবিরে। সেই ভিড়ে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার স্টুয়ার্ট সাহেবও। হিউ রোজের চোখে চোখ রেখে যে কেউ এমন কথা বলতে পারে, স্টুয়ার্ট স্বপ্নেও কখনো কল্পনা করতে পারেননি। তিনি নিশ্চিত, মেয়েটি স্বাভাবিক নয়। স্তম্ভিত স্টুয়ার্টের মুখ দিয়ে শুধু একটি কথাই বেরোল,ÒShe is mad.Ó
আর হিউ রোজ? শান্ত স্বরে প্রবীণ সেনাপ্রধান সেদিন তার অধস্তন সহকর্মীকে বলেছিলেন,ÒIf one percent of Indian women become as mad as this girl is, we will have to leave all that we have in this country.Ó
তিনি ঝলকারি বাই। বুন্দেলখ-ের কোরি সম্প্রদায়ের মেয়ে। দলিত। ঝাঁসির রানীর সাহচর্যে পাল্টে গিয়েছিল তার জীবন। হয়ে উঠেছিলেন ওস্তাদ যোদ্ধা। রানীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন। ছিলেন পাক্কা গোলন্দাজও। হিউ রোজ বাহিনী যেদিন ঝাঁসি দখল করে নেয়, সেদিন রানী লক্ষ্মীবাই রাতের আঁধারে ঘনিষ্ঠ সহচরদের পরামর্শে কেল্লা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন কাল্পির উদ্দেশে। আর সেদিনই ঝলকারি হারান তার স্বামীকে। কেল্লার উনাব দরওয়াজা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন তার স্বামী পূরণ। যতক্ষণ জান ছিল দরওয়াজা গলে একটি ইংরেজ সেনাকেও ঢুকতে দেননি তিনি। ঝলকারিও সেদিন তার পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ঝলকারিকে অবশ্য এর জন্য চোখের জল ফেলতে দেখেনি কেউ। তার চোখে ছিল আগুন। শুধু পূরণ কেন, ঝাঁসির জন্য, রানীর জন্য তার জানও যে কবুল। এরই মধ্যে রানীর কাল্পি যাত্রার খবর এসেছে তার কানে। তখনই কর্তব্য ঠিক করে ফেললেন ঝলকারি। যেভাবেই হোক রানীর যাত্রাপথ বিঘœহীন করা চাই। অতএব রাজ্ঞীবেশে তার হিউ হেনরি রোজের শিবিরে পৌঁছে যাওয়া।
কে এই হিউ হেনরি রোজ? স্ট্রার্থনেয়ার্নের প্রথম ব্যারন তিনি। ছিলেন ব্রিটিশ সেনাপ্রধান এবং সামরিক উপদেষ্টা। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া তার ১৮২০ সালে। মিসরীয়-অটোমান যুদ্ধই হোক, কিংবা ক্রিমিয়া-সিবাস্তোপোলের যুদ্ধÍনিজের যোগ্যতা তিনি প্রমাণ করেছেন সর্বত্রই। ফলত লাভ করেছেন উচ্চতম সামরিক সম্মান। সুতরাং ভারতে গদরের আগুন জ্বলতেই বিলেত থেকে তড়িঘড়ি রোজ সাহেবকে পাঠানো হয়েছিল এ দেশে। সেটা সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ সালের কথা। ৩৭ বছরের সেনাজীবনের অভিজ্ঞতা রোজকে প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ, স্থিতধী করেছে। ব্রিটিশ শাসকরা তাই ভরসা করেছিলেন তার ওপর। হিউ রোজ এ দেশে পৌঁছতেই কোম্পানি প্রথমে তাকে পুনা ডিভিশনের প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিল। এর তিন মাসের মধ্যেই ১৭ ডিসেম্বর তাকে সমঝে দেয়া হয় সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া ফিল্ড ফোর্সের মেজর জেনারেলের দায়িত্ব। গদরের সময় মালোয়া, বুন্দেলখ- ও মধ্যভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সামরিক অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন এই রোজ সাহেবই।
১৮৫৮ সালের কথা। ঝাঁসি আক্রমণ করেছিল হিউ রোজের বাহিনী। ঝাঁসি তখন সমগ্র মধ্যভারতে ব্রিটিশবিরোধী অভ্যুত্থানের প্রধান সামরিক ঘাঁটি। ব্রিটিশরা যেমন, তেমনি বিদ্রোহীরাও জানতেন সে কথা। হিউরোজ বাহিনী তাই সহজে পৌঁছতে পারেনি ঝাঁসি। ঝাঁসি তখন সেপাইদের শেষ আশা-আকাঙ্ক্ষা। অতএব ঝাঁসির পথে জোরদার প্রতিরোধ তৈরি করেছিলেন তারা। ঝাঁসির জন্য জান কবুল তাদের। সেদিনকার সেপাইদের সেই আবেগের বর্ণনা পাওয়া যাবে রাসোতে,তেজ অংরেজ কি, অংরেজ রাজ নে হাঁসি/ মাহ বল বিক্রম কি, লে ঝটপট ঝাঁসি।।/ঝাঁসি গলেঁ মে ফাঁসি দেউ, অর্চা গলেঁমে হার/জবতক রানি নে কিল্লা না ছোড়ি, তবতক না হোই উধার।।/রাখ্গড়, বারোদিয়া, খুরী লৈ,/বাণপুর, শাহ্গড়, মুসে ডরি হ্যায়/কহত ভূপৎলাল যবতক বুন্দেলা শূর রহি জিউ।/তবতক অংরেজ ক্যায়সে লেবত ঝাঁসি, সবি দেখ লেও।।/ঝাঁসি কিল্লা আউর বাইসাহেব যবতক রহে জিউ,/তবতক অংরেজ ক্যায়সে লেবত ঝাঁসি হামে দেখ লেও।।
তবে কোম্পানির সেনাকে ঠেকানো যায়নি। ২০ মার্চ হিউ রোজ ঠিক পৌঁছে গেলেন ঝাঁসিতে। শহর থেকে আট মাইল দূরে শিবির পড়ল তার। আর সেদিনই রোজের আদেশে তার সঙ্গী ব্রিগেডিয়ার স্টুয়ার্ট ঘোড়সওয়ার ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে ঘিরে ফেলেন ঝাঁসি শহর। ২১ মার্চ সকাল ৭টায় হিউ রোজও পৌঁছে যান ঝাঁসিতে। রানী লক্ষ্মীবাই আপ্যায়ন করেছিলেন শত্রুপক্ষকে। তার নিজস্ব স্টাইলে। অখ্যাত এক গ্রামীণ কবি তার ‘রাসো’-তে বর্ণনা দিচ্ছেন সেই আপ্যায়নের। ‘খাড়ে বোলি’ অর্থাৎ বুন্দেলখ-ের দেহাতি ভাষায় রচিত সেই ‘রাসো’ বা গীতিকা। অরছা, পান্না, দতিয়া, ছত্রপুর, হামিরপুর সর্বত্র লোকের মুখে মুখে আজও শোনা যায় সেই রাসো। কবি লিখছেন,বাই নে ভেজৌ অংরেজো বাত।/হৌতা লেব কটোয়ার হাঁত।।/কটোয়ার হাথ লেব ন্যাব চঢ়াও।/ন্যাব চড়াও সি মোরছে বড়াও।।/মোরছে বঢ়াও সি তেলংগা শের।/মৈ তো বাঘিন্ হোউ সমঝায়ো ফের।।
ইংরেজদের বলে পাঠালেন বাই, যদি পুরুষ হও তবে তলোয়ার হাতে তুলে নাও। শুরু হোক যুদ্ধ। মোর্চা আগ বড়াও। আবারো একবার তোমাদের সমঝে দিই যে তোমরা বাঘ হলে আমিও বাঘিনী। সরকারি নথিপত্রেও রয়েছে রানীর সেই আপ্যায়নের কথা। সেই নথিপত্র বলছে, সেদিন ঝাঁসির কেল্লার দক্ষিণ বুরুজে এক রক্ত রাঙা নিশান হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ছুঁতে চাইছিল দূরের আকাশ One of these towers had been raised by the rebels, from it floated the red standard of the Ranee.Õ ইঙ্গিত স্পষ্ট, বিনা যুদ্ধে হার স্বীকারের প্রশ্নই ওঠে না। ২৩ মার্চ ১৮৫৮। শুরু হয় যুদ্ধ। চলে ১০ দিন। ৪ মার্চ অবধি। সেই ইতিহাস গর্বের, অহংকারের। শোকের, প্রতারণারও। গর্বের, কারণ গদরকালে এমন কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি আর কোথাও হয়নি ইংরেজ বাহিনী। সে কথা বলছেন ইংরেজ সেনা অফিসাররাই। বিদ্রোহী রানীর প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ তারা। হিউ রোজ রানী সম্পর্কে লিখেছেন, Although a ladz, she was the bravest and best military leader of the rebels. A man among the mutineers.
তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ঝাঁসি ঠিক হাসিল করে নেয় হিউ রোজের বাহিনী। অবশ্যই এ দেশীয়দের বিশ্বাসঘাতকতা তার কাজকে সহজ করে দিয়েছিল। কেল্লার দরওয়াজা কোম্পানি সেনার জন্য খুলে দিয়েছিল তারা। রানীকে তাই কেল্লা ছাড়তে হয়। সে রাতেই প্রিয় ঘোড়া সারঙ্গীর পিঠে চেপে কেল্লার উত্তরের দরওয়াজা দিয়ে ঝাঁসি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন রানী। পিঠে তার দত্তক শিশুপুত্র দামোদর রাও। সঙ্গী ছিলেন রানীর সহচরী মান্দার ও কাশী এবং রঘুনাথ সিংহ, গুল মুহম্মদের মতো কয়েকজন বিশ্বস্ত সহচর। আর ৪০০ আফগান সেপাই। মাঝরাত তখন। আকাশে চাঁদ উঠতে সামান্য বাকি। রানীর যাত্রাপথ মসৃণ করার উদ্দেশ্যে রাত পোহাতেই পুব দিকের বুরুজ থেকে ইংরেজ শিবির লক্ষ্য করে অনবরত গোলা ছুড়তে শুরু করেছিলেন তার এক বিশ্বস্ত গোলন্দাজ লালভাও বক্সী। ‘কড়কবিজলি’ কামানের বজ্রপাতে বিশৃঙ্খল তখন ইংরেজ শিবিরের একাংশ।/রানী কেল্লা ছেড়ে গেলেন ঠিকই, তবে তার লড়াই কিন্তু থামেনি। ৭ থেকে ২০ মে পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রমে রানী সৈন্যদের ড্রিল-প্যারেড করিয়েছেন। তাকে সাহায্য করেছেন কোম্পানির সেনাদল ছেড়ে চলে আসা ব্রিটিশ সামরিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত সেপাইরা। একে একে অন্যান্য প্রস্তুতিও নিয়েছেন রানী। বুন্দেলি রাসোতে রয়েছে সেই প্রস্তুতির বর্ণনাÍ/পেঁড় গিরবাও কহত রানি ঝাঁসি।/ন তেলেঙ্গা দেব হামি সিপাহিক ফাঁসি।।/বে-হিম্মৎ সে ন কহ পাওয়ে লটকাও।/ন ধূপ অধূপ মেলি মিলবত ছাঁব।।
ঝাঁসির রানী বললেন, গাছ কেটে ফেলো, যাতে তেলেঙ্গা আমার সিপাইদের ফাঁসি দিতে না পারে। বে-হিম্মৎ (ইংরেজ) যেন ‘লটকাও’, ‘লটকাও’ বলতে না পারে। প্রখর রোদে যেন তাদের ছায়া না মেলে।
এর পরের যুদ্ধকথা সবার জানা। তা শুধু রানীকে নিয়েই নয়, চারণ কবিরা গান বেঁধেছেন হিউ রোজকে নিয়েও। সেসব গানে রয়েছে জেনারেলের দুর্গতির বর্ণনা। সেসব গাইতে গাইতে দেহাতি মানুষগুলো আজও হাসতে হাসতে কুটোপাটি হয়। একে অন্যের ওপর ঢলে পড়ে। তারা গায়,আঁখসে আঁসুয়া বীচি বোলিঁ হিউ রোজ মানি।/বিনতি করৌঁ মাঙ্গো এক লোটা পানি।।/এক লোটামে পিয়াস তরসাঁও। ঔর মাঙ্গো ফির।/লৌটকে রাখো তোফা গোলী, লৌট শমসির।।
মানী হিউ রোজের আজ চোখে জল। এক লোটা পানির জন্য মিনতি করছেন তিনি। বলছেন এক লোটা জল দিয়ে আমার তৃষ্ণা মেটাও। তবু কি আর তিয়াস মেটে? বললেন, আরো, আরো জল চাই। গোলি, তলোয়ার, শমসের কামান সব তোমরা ফেরত নিয়ে যাও।
ফিরে আসা যাক ঝলকারি প্রসঙ্গে। ৫ মার্চ রাত পোহাতে ঝলকারি যে রাজ্ঞীর বেশে হাতে খোলা তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ায় চেপে কেল্লা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন, এর উল্লেখ করা হয়েছে আগেই। ‘ঝলকারি নে অপনা শৃঙ্গার কিয়া। বড়িয়া সে বড়িয়া কপড়ে পহনে, ঠিক উসি তরহ জৈসে লক্ষ্মীবাই পহনতি থি। গলে কে লিয়ে হার ন থা, পরন্তু কাঁচ কে গুঁরিয়ো কা কণ্ঠ থা। উসকো গলে মে ডাল দিয়া।’
লিখেছেন বৃন্দাবনলাল বর্মা তার ‘ঝাঁসি কি রানী’ উপন্যাসে। প্রকাশকাল ১৯৪৬। সেই প্রথম সাহিত্যে স্থান পাওয়া ঝলকারির। দলিত কবিরা তাকে নিয়ে গান বেঁধেছেন, কিন্তু ইতিহাসে ঝলকারি বরাবরই ব্রাত্য। কবি মৈথিলী শরণ গুপ্তা ঝলকারিকে নিয়ে লেখা একটি কবিতায় লিখছেন, আকর রণ মে ললকারি থি/ওহ ঝাঁসি কি ঝলকারি থি/গোরো কো লড়না সিখা গই/রানি বন জোহর দিখা গই/হৈ ইতিহাস মে ঝলক রহি/ওহ ভারত কি সতনারি থি। বাস্তবতা কিন্তু এর উল্টো কথাই বলে। ইতিহাসে তার ঠাঁই হয়নি। কেন এই উপেক্ষা? দলিত বলেই কি? প্রশ্ন তুলেছেন আধুনিক দলিত লেখকরা। ঝলকারি প্রসঙ্গে প্রথমেই যে প্রসঙ্গ উঠে আসে, সেই হিউ রোজের মুখোমুখি হওয়ার আখ্যান কিন্তু খোদ রোজের ডায়েরিতেও স্থান পায়নি। স্বাভাবিকভাবেই রানী লক্ষ্মীবাইয়ের প্রসঙ্গ রয়েছে তাতে। তবে কি ঝলকারি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নন? তিনি কি শুধুই কিংবদন্তির নায়িকা? এ নিয়ে চাপান উতোর হয়েছে অনেক। সত্যি হলো, ঝলকারি কাল্পনিক চরিত্র নন মোটেই। এ বক্তব্যের স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। সমসাময়িক এক ব্রাহ্মণ পর্যটকের লেখায় উঠে এসেছে ঝলকারির কথা। রানী লক্ষ্মীবাই ও ঝলকারিÍদুজনকেই চাক্ষুষ দেখেছিলেন তিনি। কথা বলেছেন তাদের সঙ্গে। নাম তার বিষ্ণুভট্ট গডেস বরসোইকর। তার ‘মাঝা প্রবাস’ (আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত) গ্রন্থে ঝলকারিকে তিনি রানীর দাসী বলে উল্লেখ করেছেন।
তবে হিউ রোজের সঙ্গে ঝলকারির সাক্ষাৎকারের উল্লেখ তার গ্রন্থে নেই। ‘ঝাঁসীর রাণী’ শিরোনামে এক জীবনী গ্রন্থ লিখেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। সে বইয়ে কিন্তু এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। স্টুয়ার্ট ও হিউ রোজের কথোপকথন তিনি ইংরেজিতে উদ্ধৃত করেছেন। সম্ভবত কোনো ইউরোপীয়র স্মৃতিকথা থেকে ঘটনাটি উদ্ধৃত হয়েছে। মহাশ্বেতা রচিত এ স্মৃতিগ্রন্থ প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। বইটি লেখার সময় লক্ষ্মীবাইয়ের বৈমাত্রেয় ভাই চিন্তামণির সন্তান গোবিন্দরাম তাম্বে, রানীর দত্তক পুত্রের সন্তান লক্ষ্মণরাও ও ঝাঁসির রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ অনেকেই তথ্য সংগ্রহে তাকে সাহায্য করেছেন। সুতরাং ঝলকারি বাই যে কাল্পনিক চরিত্র নন, তা নিশ্চিত। যুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়েও সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না।
সাহিত্যিক বৃন্দাবনলাল ভার্মারও একই বক্তব্য। তার ‘ঝাঁসি কি রানি’ উপন্যাসের সাবপ্লট তৈরি হয়েছে এ ঝলকারিকে নিয়েই। ভার্মার দাবি, এ উপন্যাসে তিনি কোথাও ঐতিহাসিক তথ্যকে অতিক্রম করে যাননি। ভার্মা নিজে রানীর এক ঘনিষ্ঠ সভাসদের পৌত্র ছিলেন। বড় হয়েছেন তিনি ঝাঁসির রাজপরিবারের গল্প ও রানীর কারনামা শুনে। শুধু পারিবারিক গল্পকথার ওপর নির্ভর করেই নয়, উপন্যাস লেখার সময় তিনি তথ্য সংগ্রহ করেছেন রানীর দত্তক পুত্র দামোদর রাও এবং ঝলকারির পৌত্রের কাছ থেকেও। দলিত মহল্লায় প্রচলিত রাসোগুলো তো ছিলই। এর পরও কি আর ঝলকারিকে শুধুই কিংবদন্তির নায়িকা বলে উপেক্ষা করা যায়?
ইতিহাসে উপেক্ষিতা, তাই বলে ঝলকারির ব্যক্তিত্ব ম্লান হয় না। দলিত মহল্লার দুলারি তিনি। তারা তাকে আগলে রেখেছেন বুকের ভেতর। হিউ রোজের মুখোমুখি হয়ে ঝলকারি যখন বলছেন, ‘আমিই রানী লক্ষ্মীবাই। তোমাদের যত ক্রোধ, সে তো আমার ওপর। আত্মসমর্পণ করছি আমি। বন্দি করো তোমরা আমায়। শুধু রেহাই দাও ঝাঁসির বাসিন্দাদের। তাদের ক্ষমা করো। তাদের কোনো ক্ষতি করো না তোমরা।’ চারণ কবিদের মুখে এই আখ্যান শুনে দলিত মহল্লার শ্রোতাদের চোখ আজও উজ্জ্বল হয়। সুন্দরী ছিলেন ঝলকারি। শ্যাম বর্ণা। পরনে রানীর পোশাক। দৃপ্ত ভঙ্গি। সন্দেহ হয়নি হিউ রোজের। সঙ্গে সঙ্গে ছদ্মবেশী ঝলকারিকে প্রেফতারের আদেশ দিয়েছিলেন তিনি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অবশ্য সেরাস্তাদার গোপালরাওয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় ঝলকারির আসল পরিচয় সামনে চলে আসে। প্রতারিত হিউ রোজ ক্ষেপে গিয়েছিলেন। ঝলকারির ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন তিনি। শুনে ফুঁসে উঠেছিলেন ঝলকারিও। বলেছিলেন, ‘মার দৈ, মৈ কা মরবে কো ডরাত হোঁ? জৈসে ইত্তে সিপাই মর্ তৈসে এক মৈ সই।’
চোখে চোখ, ঝলকারির এমন বক্তব্য শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছিল হিউ রোজের। তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন সাহেব। এরপর আরও ৩২ বছর বেঁচে ছিলেন ঝলকারি। মৃত্যু তার ১৮৯০ সালে। আর জন্ম? ২২ নভেম্বর ১৮৩০ সালÍঝলকারির জন্ম তারিখ। কেল্লার পাশেই ভোজলা গাঁওয়ে জন্ম। ঝালকারির শৈশবেই মা যমুনা দেবীর মৃত্যু হয়। বাবা সদোবর সিংয়ের কোলেপিঠে চেপেই তার বড় হওয়া। মাতৃহীন একমাত্র কন্যাটি পিতার লাডপ্যায়ারেই বড় হয়েছেন। দলিত পরিবারে লেখাপড়ার আর তেমন চর্চা কোথায়? তবে সদোবর তাকে হাতে ধরে তীর-ধনুক চালানো শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন ঘোড়ায় চড়তে। মা না থাকলে যেমন হয়, ঘরে তেমন কড়া শাসন ছিল না। ডানপিটে ঝলকারির বনবাদাড়ে ছিল অবাধ বিচরণ। জনশ্রুতি, একদা কাঠ সংগ্রহের জন্য জঙ্গলে গিয়েছিলেন তিনি। সে সময় এক বাঘের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে তার। সেই অসম লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিলেন তিনিই। হাতের কুড়াল দিয়ে বাঘটিকে হত্যা করেছিলেন ঝলকারি। এ সময় গ্রামের এক গৃহস্থ ঘরে ডাকাত পড়লে একার চেষ্টায় তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ডাকাত দলকে। ফলে ঝলকারির নামডাক ছড়িয়েছিল বেশ। কন্যার এমন গুণে তার প্রতি আকৃষ্ট হন সমগোত্রীয় এক কোরি যুবক পূরণ। ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধরের সেপাই তিনি। ঝলকারির সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তার। এসব তথ্যের জোগানদার চারণ কবিদের রাসো। ব্যাঘ্র হত্যা কিংবা ডাকাত দলনÍএ ঘটনাগুলোর সত্যতা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে। আসলে ঝলকারির শৈশবকে ঘিরে এই যে রূপকথার বুনোট, এর পেছনে রয়েছে তার পরবর্তী জীবনের কারনামা। তবে ছোটবেলা থেকেই তিনি যে ডানপিটে আর দুঃসাহসী ছিলেন, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। লক্ষ্মীবাইয়ের সংস্পর্শে এসে তার গুণগুলো পূর্ণতা পেয়েছে। এমন ঘটনা ঘটেছে আরো অনেকের ক্ষেত্রে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে সেসব তথ্য। তা লক্ষ্মীবাইয়ের সঙ্গে ঝলকারির পরিচয় কীভাবে হয়, এ নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কারো কারো মতে, পূরণ কোরি তাকে রানীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিংবদন্তি আবার অন্য কথা বলে। ঝাঁসির সুদিনে প্রতি বছর চৈত্র মাসে রাজপ্রাসাদে গৌরী পূজার উৎসব হতো। গ্রামের অন্যদের সঙ্গে একবার সেই উৎসব দেখতে গিয়েছিলেন ঝলকারিও। তখনই রানীর নজরে পড়ে যান তিনি। আর এই নজরে পড়ে যাওয়ার কারণটিও বেশ আশ্চর্যজনক। জনশ্রুতি, রানীর চেহারার সঙ্গে আশ্চর্য মিল ছিল ঝলকারির। হিন্দি ভাষার বিখ্যাত কবি বিহারী লাল হরিতের ‘বীরাঙ্গনা ঝলকারি’ কাব্যে রয়েছে সেই সাদৃশ্যের উল্লেখ,
লক্ষ্মীবাই কা রূপ ধার, ঝলকারি খড়গ সওয়ার চলি।/ বীরাঙ্গনা নির্ভয় লশকর মে, শস্ত্র-অস্ত্র তন ধার চলি।।
দুজনের চেহারার এ মিল নাকি অবাক করেছিল রানীকে। স্বভাবতই নিজের এ হামশকলের প্রতি কৌতূহলী হয়ে ওঠেন তিনি। আর তখনই জানতে পারেন ব্যাঘ্র হত্যা ও ডাকাত দলকে হেনস্তা করার কাহিনী। এর পরও কি আর ঝলকারির প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে থাকা যায়? সেই থেকে রানীর ছায়াসঙ্গিনী ঝলকারি। লক্ষ্মীবাইয়ের উৎসাহে শিখেছেন তিনি কামান-বন্দুক-তলোয়ার চালানো। পরবর্তী সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন রানীর নারী বাহিনী দুর্গা দলেরও। তবে রানীর সঙ্গে তার চেহারার সাদৃশ্য সম্ভবত চারণ কবিদের কল্পনা। রানীর ছদ্মবেশ ধারণই এ কল্পনার উৎস। বিভিন্ন তথ্য বলছে, সুশ্রী হলেও ঝালকারি ছিলেন শ্যাম বর্ণা। এদিকে রানীর গায়ের রঙ ছিল পাকা গেঁহুর মতো। প্রত্যক্ষদর্শীরাই জানিয়েছেন। তা রানীর হামশকল না হলেও ঝলকারির গৌরব এতটুকু ম্লান হয় না। রানীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শামিল হয়েছেন, এ তার গৌরব। শুধু ঝলকারি কেন, রানীর আরো এক সহচরী মান্দারও পুরুষ বেশে যুদ্ধ করতে করতে লড়াইয়ের ময়দানে প্রাণ দিয়েছেন। মান্দার, ঝলকারির নাম তবু তো জানা যায়, এমন কত শত শত দুঃসাহসী যোদ্ধা অজ্ঞাতে হারিয়ে গেছেন। ইতিহাস তাদের মনে রাখেনি। আর ইতিহাস যেখানে স্তব্ধ হয়, কিংবদন্তি বাঙ্ময় হয় সেখানেই। বিস্মৃত ইতিহাসকে ধারণ করে লোকস্মৃতি। লিখিত হয় এক সমান্তরাল ইতিহাস। চারণ কবিদের রাসো এ উপেক্ষিতাদের কথা বলে। ঝলকারিদের স্মৃতি ধরে রাখে এই লোকস্মৃতিই। ইতিহাসের উপেক্ষা তাদের কারনামাকে ম্লান করতে পারে না। ঝালকারি বাই কোরির আখ্যান সেই কথাই বলে। জয়িতা দাস: অধ্যাপক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক