দান সম্পর্কে মহান রাব্বুল আল আমিন অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে রূপক অর্থে আমাদের জন্য কয়েকটি উদাহরণ হিসেবে আয়াত পেশ করছেন সূরা আল বাকারায়। প্রথমত. যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, অর্থাৎ হজ, জিহাদ, ফকির, মিসকিন, যে কোনোভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অর্থ ব্যয় করার উদাহরণ হিসেবে আল্লাহ্ গম-বীজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কেউ গমের একটি দানা সরস জমিতে বপন করল। আর এই একটি দানা একটি চারা গাছ হয়েছে যা সাতটি শীষে এক শ’ করে সাত শ’ দানায় পরিণত হয়েছে (সুবহান আল্লাহ্)। মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন : ‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মতো, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে এক শ’ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা-বাকারা : ২৬১)
রূপক দৃষ্টান্তটির অর্থ দাঁড়াচ্ছে- আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করার পুণ্য অর্জনের সওয়াব এক থেকে শুরু করে সাত শ’ পর্যন্ত পৌঁছে। অর্থাৎ এক পয়সার পুণ্য সাত শ’ পয়সা সমপরিমাণ। আবু সা’ঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত : তিনি আল্লাহর রাসূল সা:-কে বলতে শুনেছেন, বান্দা যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার ইসলাম উত্তম হয়, আল্লাহ তার পূর্বের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেন। অতঃপর শুরু হয় প্রতিফল; একটি পুণ্যের বিনিময়ে দশ হতে সাত শ’ গুণ পর্যন্ত; আর একটি পাপ কাজের বিনিময়ে ঠিক ততটুকু মন্দ প্রতিফল। অবশ্য আল্লাহ যদি ক্ষমা করে দেন তবে তা অন্য ব্যাপার। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৪১)
দান-সদকা কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে- দান করে অনুগ্রহ প্রকাশ করতে পারবে না, গ্রহীতাকে ঘৃণিত মনে করা যাবে না। আল্লাহ্ বলেছেন : ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় তাদের সম্পদ ব্যয় করে, অতঃপর তারা যা ব্যয় করেছে, তার পেছনে খোঁটা দেয় না এবং কোনো কষ্টও দেয় না, তাদের জন্য তাদের রবের নিকট তাদের প্রতিদান রয়েছে এবং তাদের কোনো ভয় নেই, আর তারা চিন্তিত হবে না।’ (সূরা বাকারা : ২৬২)
বরং এর চেয়ে উত্তম সুন্দর কথা বা ক্ষমা চাওয়া, কিন্তু যে দানের পরে কটূক্তি বা ধিক্কারমূলক কোনো কর্ম প্রদর্শন করা হয় তা আল্লাহ কবুল করেন না। কারণ আল্লাহ অভাবমুক্ত। ‘উত্তম কথা ও ক্ষমা প্রদর্শন শ্রেয়, যে দানের পর কষ্ট দেয়া হয় তার চেয়ে। আর আল্লাহ অভাবমুক্ত, সহনশীল।’ (সূরা বাকারা : ২৬৩)
অথচ আজকের বাংলাদেশের একটি আকর্ষণীয় চিত্র প্রদর্শন হচ্ছে যা কুরআনের পরিপন্থী। এই সঙ্কটকালেও ত্রাণের প্রদর্শনেচ্ছা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
দ্বিতীয়ত, আরো একটি রূপক উদাহরণ হচ্ছে, প্রবল বর্ষণ বা দান এবং পাথরখ- বা নিয়ত যা গলদসহ দান করার কারণ। আল্লাহ বলেন : ‘হে মুমিনগণ, তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেয়ার মাধ্যমে তোমাদের সদাকা বাতিল করো না। সে ব্যক্তির মতো, যে তার সম্পদ ব্যয় করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে এবং বিশ্বাস করে না আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি। অতএব তার উপমা এমন একটি মসৃণ পাথর, যার উপর রয়েছে মাটি। অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ল, ফলে তাকে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলল। তারা যা অর্জন করেছে তার মাধ্যমে তারা কোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। আর আল্লাহ কাফির জাতিকে হিদায়াত দেন না।’(সূরা বাকারা : ২৬৪)
এর রূপক উদাহরণের অর্থ হচ্ছে, মাটির আস্তর বলতে সৎকর্মের বাইরের কাঠামোটি বুঝায়, যার নিচে নিয়তের খারাপ দিক লুকায়িত। নিয়ত উত্তম হওয়া ছাড়া কোনো দানই কবুল হয় না তা যতই অধিক পরিমাণে হোক।
পরের উদাহরণটি হচ্ছে, এমন ফলমূল প্রদানকারী উদ্যান যা লঘু বৃষ্টি পড়াতেও ফলদায়ক হয়ে ওঠে। কুরআনের ভাষায় : ‘আর যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও নিজদেরকে সুদৃঢ় রাখার লক্ষ্যে সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা উঁচু ভূমিতে অবস্থিত বাগানের মতো, যাতে পড়েছে প্রবল বৃষ্টি।
ফলে তা দ্বিগুণ ফল-ফলাদি উৎপন্ন করেছে। আর যদি তাতে প্রবল বৃষ্টি নাও পড়ে, তবে হালকা বৃষ্টি (যথেষ্ট)। আর আল্লাহ তোমরা যা আমল করো, সে ব্যাপারে সম্যক দ্রষ্টা।’ (সূরা বাকারা : ২৬৫)
রূপকের আড়ালের ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, যারা সব ধরনের সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত কোনো টিলায় অবস্থিত বাগানের মতো যেখানে হালকা বর্ষণও কার্যকর। অর্থাৎ উত্তম নিয়তের মাধ্যমে ক্ষুদ্র দানও আখিরাতের জন্য উত্তম পাথেয়।
আরো একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, একটি আঙুর ও খেজুরের বাগান। এই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেন : ‘তোমাদের কেউ কি কামনা করে, তার জন্য আঙুর ও খেজুরের এমন একটি বাগান থাকবে, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদ-নদী, সেখানে তার জন্য থাকবে সব ধরনের ফল-ফলাদি, আর বার্ধক্য তাকে আক্রান্ত করবে এবং তার জন্য থাকবে দুর্বল সন্তান-সন্তুতি। অতঃপর বাগানটিতে আঘাত হানল ঘূর্ণিঝড়, যাতে রয়েছে আগুন, ফলে সেটি জ্বলে গেল? এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা করো।’ (সূরা বাকারা : ২৬৬)
অর্থাৎ, কেউ অর্থ ও সম্পদ ব্যয় করে বাগান করে, এতে ফল পাওয়ার পরে সে বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলো। অথচ তার সন্তান-সন্তুতি অকেজো বা দুর্বল। ঠিক এমন মুহূর্তে যদি তার তৈরি বাগান জ্বলেপুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়, তবে তার অপরিসীম কষ্ট উপভোগ করতে হবে। ‘উমার রা: বললেন, এটি উদাহরণ হচ্ছে সেই ধনবান ব্যক্তির, যে মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহর ইবাদাত করতে থাকে, এরপর আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি শয়তানকে প্রেরণ করেন। অতঃপর সে কাজ করে শেষ পর্যন্ত তার সব সৎকর্ম বরবাদ করে ফেলে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৪৫৩৮)
এ উদাহরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে, সে বৃদ্ধ হয়ে যাবে, তার সন্তান সন্তুতিও থাকবে এবং অল্প বয়সী হবে, এর কারণে দুর্বল হবে। অথচ যদি এমন ক্ষতি যৌবনে বা সন্তানবিহীন অবস্থায় হয়ে থাকে তবে ক্ষতি পূরণ করার সুযোগ থাকে এবং দরকার পড়ে না।
অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় বা ফি-সাবিলিল্লাহ কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে : হালাল সম্পদ, সুন্নাহভিত্তিক ব্যয়, বিশুদ্ধ খাতে ব্যয়, অনুগ্রহ প্রকাশহীন ব্যয়, হেয়-প্রতিপন্নবিহীন এবং ইখলাসের সাথে যশের ঊর্ধ্বে ব্যয়।
এভাবে যেকোনো সৎকর্ম বিশেষ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কৃতকর্মের সওয়াব অর্জনের পূর্বশর্ত হচ্ছে, পবিত্র ও হালাল উপার্জন, ওই অজ্ঞ কৃষকের মতো হওয়া যাবে না, যে অনুর্বর মাটিতে বীজ বপনের ফলে অঙ্কুরেই ফসল নষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ সৎ নিয়ত থাকতে হবে, যোগ্য বা সৎ গ্রহীতা হতে হবে।
লেখিকা : ইসলামী গবেষক