বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমের সাথে বুদ্ধিজীবীরা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। মূলত যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, অধ্যয়ন ও আদর্শিক অনুশীলন বুদ্ধিজীবীরাই করে থাকেন। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম জাতিকে এগিয়ে নেয়। যারা বুদ্ধিকে জীবিকা নির্বাহের বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন তারা তাদের ভূমিকার মাধ্যমে পাল্টে দিতে পারেন সমাজ ও রাষ্ট্র। একটি দেশের গভর্ন্যান্স বা শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় বুদ্ধিজীবীরাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যদিও বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি রাজনীতি করেন না, তবে তারা পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেন। পৃথিবীর ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এটি বাস্তব সত্য।
১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও ১৯১৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীরাই ভিত্তি নির্মাণ করেন। আর পৃথিবীর তাবৎ পরিবর্তনে তাদের ভূমিকা অনন্য। তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক অভিশাপ অবসানে রয়েছে তাদের অনস্বীকার্য ভূমিকা। বাংলাদেশের সংগ্রামেও আমাদের বুদ্ধিজীবীদের গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে। তবে স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময়ে তাদের সেই সর্বাত্মক ভূমিকা ক্রমেই লীন হয়ে আসে। জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে অভিন্ন ভূমিকার পরিবর্তে সুবিধাবাদ, বিভক্তি ও হতাশা তাদের ক্রমেই গ্রাস করে। সাম্প্রতিক সময়ে সে প্রবণতা সব সীমা লঙ্ঘন করেছে। নিরপেক্ষতা, নৈতিকতা ও সাহস হারিয়ে তারা দলীয় তাঁবেদার গোষ্ঠীতে পরিণত হন। লাল, নীল ও গোলাপি বিভাজন পরিলক্ষিত হয়। বিবেকবর্জিতভাবে এরা দলীয় তাঁবেদারে পরিণত হন। পদ ও পদবি লাভে তারা এতটাই দলীয়বৃত্তি গ্রহণ করেন যে, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের চেয়েও বড়গলায় কথা বলেন। বিশেষ করে বর্তমান শাসকশ্রেণী ফ্যাসিবাদের অনুসরণে জাতিকে বিভক্ত করতে চাইলে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একাংশ ঢাল-তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে আসেন। বিভিন্ন পেশাধারী বুদ্ধিজীবী শ্রেণী- কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক-অধ্যাপক, সাংবাদিক-গবেষক, চিকিৎসক-প্রকৌশলী অর্থাৎ এমন কোনো পেশাজীবী সম্প্রদায় নেই, যেখানে দলীয় লাইন অনুযায়ী বিভাজন ঘটেনি। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সাহসের পরিবর্তে দলীয় সঙ্কীর্ণতা, অবৈধ কর্মে দক্ষতা ও দলীয় অবদান অগ্রাধিকার পায়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি নিয়োগে যে অন্যায়ের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় তা গোটা জাতিকে লজ্জিত করে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নয়, প্রশাসনেও এই নগ্ন দলীয় প্রবণতা পরিদৃষ্ট হয়। এমনকি বিচার বিভাগেও রাখঢাক না করে দলীয়ভাবে পদ ও মর্যাদা বিতরণ করা হয়। বিচার বিভাগ থেকে যখন দলীয় সিদ্ধান্ত রায় হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয় তখন এর প্রমাণ মেলে। সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রধান ব্যক্তিকে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজে লাগানো হয়। সেই ব্যক্তিই যখন শাসক শ্রেণীর বিরোধিতা করেন, তখন তাকে নিকৃষ্ট শক্তি প্রয়োগে বিতাড়ন করে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যারা সামান্য ভিন্নমত পোষণ করেন তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধিকার, অধিকার ও বিবেকবোধ কেড়ে নেয়া হয়।
তবে সবাই যে বিবেককে বিসর্জন দিয়েছেন এমন পাইকারি কথা বলা যাবে না। সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বুদ্ধিজীবীদের একাংশ অন্যায়, অনিয়ম ও অত্যাচারের প্রতিবাদ করে চলেছেন। তারা খুন ও গুমের শিকার হয়েছেন। চাকরিচ্যুত হয়েছেন। মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত হয়েছেন। অনেকে শারীরিকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। যখনই যেকোনো প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বিরোধিতার আভাস পাওয়া গেছে সেখানেই খড়গহস্ত হয়েছে সরকার। যেকোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যদি তাদের সাথে শতভাগ সমর্থন জ্ঞাপন না করে তবে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ হিসেবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অবস্থা দেখা যেতে পারে। এভাবে বিলীন হয়ে গেছে বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী অনেক সংগঠন।
বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সাম্প্রতিক নাম হচ্ছে সুশীলসমাজ। বাংলাদেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সুশীল সমাজ সীমিতভাবে হলেও ভিন্নমত প্রকাশের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট থেকে এই সুশীলসমাজের উন্নতি ও অধঃগতি ঘটে। ক্ষমতাসীনদের সমর্থনে একদল বুদ্ধিজীবী এগিয়ে আসেন। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিরোধীদের ক্ষমতাচ্যুতকরণে ভূমিকা রাখেন। অপর দিকে, ওই সময়ে আরেক দল বুদ্ধিজীবী তারুণ্য ও সাহসকে ভর করে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগ সরকার যেহেতু এক নেতা, এক দেশ ও এক আদর্শে বিশ্বাস করে; সে জন্য ২০০৯ সাল থেকে দেশে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিরোধী ভূমিকার একরকম অবসান ঘটে। তবে নির্বাচনের আগে ও পরে সুশীলসমাজের সীমিত ভূমিকা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
অতিসাম্প্রতিক সময়ে দেশে সরকারবিরোধী আবহাওয়া পানি পেতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীর দালালিমূলক ভূমিকার বিপরীতে একটি শক্ত ও সমন্বিত প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। ডান ও বাম ধারার বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে ও বিবিধ প্রকারে তাদের নিজ নিজ অবস্থান জানান দিচ্ছেন। গত শুক্রবার এমনই একটি বুদ্ধিজীবী তথা সুশীলসমাজের অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে। সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘের এক মুক্ত আলোচনায় দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীরা বর্তমান সময়ের একটি পর্যালোচনা করেন। দেশের বর্তমান অবস্থাকে খুব খারাপ সময় বলে অভিহিত করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। এটি করেছে ধনিক শ্রেণী। খুব খারাপ সময়ের মধ্যে আছি মন্তব্য করে দেশের এই বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবী বলেন, ‘বাংলাদেশ এক সময় ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। পাকিস্তানও উপনিবেশ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করেছে ধনিক শ্রেণী। ঔপনিবেশিক শাসকরা যেমন সম্পদ পাচার করত, এখন এই ধনিক শ্রেণী বিদেশে সম্পদ পাচার করছে। কাজেই লোক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা বন্ধ হয়নি। তিনি বলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে উঠতে না উঠতেই ভেঙে পড়ে। ওই ভেঙে পড়া রাষ্ট্রের পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি, আইনকানুন আমরা বাতিল করতে পারিনি। সেগুলো নিয়েই নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো। ফলে বাংলাদেশ হলো আয়তনে ও শাসকদের চেহারা অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্র কিন্তু রাষ্ট্রের মূল চরিত্রের পরিবর্তন হলো না। ওই একই আলোচনাসভায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, এক ব্যক্তি এক দল- এটি হলো আমাদের দেশের রাজনীতি। গণতন্ত্র এর খেসারত তো দিতেই হবে এবং আমরা তা দিচ্ছি। আগামী ৫০ বছরে দেশের ভালো করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার এবং সুষ্ঠু আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি জোর দিতে হবে। এই প্রতিবাদী আইনজীবী আরো বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় নজর দিতে হবে। আমরা এটিকে নষ্ট করে দিয়েছি। জনগণের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দাবি করা বাংলাদেশে ধস নেমেছে উল্লেøখ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (অব:) আনু মুহাম্মদ বলেন, এখন একটি বড় ধরনের ধস দেখতে পাচ্ছি। এতদিন শক্ত-সামর্থ্য একটি অর্থনীতির কথা বলা হচ্ছিল। এখন সেটি ভেঙে পড়েছে। রিজার্ভ (বৈদেশিক মুদ্রা) ধরে রাখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, বলা হয়েছিল চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ। কিন্তু আমরা এখন ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে সরকারের বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অনুপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের আরেক অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ক্ষমতায় থাকলে কেউ গণতন্ত্রের চর্চা করে না। কিন্তু সুষ্ঠু গণতন্ত্র বাজে শাসকদের কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। আন্দোলন ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রত্যাশার আরো খবর আছে। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শক্তি বাড়াতে বিএনপির পাশাপাশি এবার মাঠে নামছে গণতন্ত্রমঞ্চ। বামধারার কয়েকটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত এই মঞ্চ সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত আগস্ট মাসে আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক জোট গণতন্ত্রমঞ্চে রয়েছে জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এদের আরো মূল্যায়ন হচ্ছে- বর্তমান সরকারের সীমাহীন লুটপাট ও অর্থপাচারের ফলে জনগণের যে নাভিশ্বাস উঠেছে তার বিরুদ্ধে ঐক্য ও আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন তারা। বামধারার এসব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন রাজনৈতিক দল হিসেবে যতটা না সক্রিয় তার চেয়েও তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা জোরালো। সুতরাং বুদ্ধিবৃত্তিক তথা বুদ্ধিজীবী পর্যায়ের সমন্বয় গড়ে উঠেছে এদের মাধ্যমে। অপর দিকে, ডানধারার সিভিল সোসাইটিগুলোর বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন নামে প্রচুর বুদ্ধিবৃত্তিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভা করে যাচ্ছে। ডানধারার বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠী তাদের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আবারো প্রভাব বিস্তার করার সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক ডামাডোলের বাইরে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন এই বৃত্তিকুশল সামাজিক গোষ্ঠী সক্রিয়, আরো সক্রিয় হয়ে উঠলে তা অগ্রসরমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, সামাজিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক উন্নয়নে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী নিয়ামক হয়ে ওঠে। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান শ্রেণিভিত্তিক নয়; বরং সামগ্রিক। দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সমাগত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান করে তুলবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের বৃহত্তর বুদ্ধিজীবী অংশ সুবিধাবাদ ও গণবৈরী ভূমিকা বর্জন করবে বলেই জনগণের অশেষ প্রত্যাশা রয়েছে। তাদের প্রতিজ্ঞা হোক, ‘মুক্তি অথবা মৃত্যু’।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com