শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৮ অপরাহ্ন

কবিতার রাজ্যে রাজা কবি শামসুর রাহমান

আবুল কাসেম হায়দার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০২২

শামসুর রাহমান আধুনিক বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠতম শব্দশিল্পী ও কবি কথায় মৃত্যুর পূর্বে তিনি এমন একজন কবির জীবনযাপন করেছেন যা ছিল প্রায় কিংবদন্তীতুল্য। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান কবি শিরোপাটিও তাঁকে দেয়া হয়। গণমানুষের কবি, স্বাধীনতার কবি, মুক্ত চিন্তার কবি, সর্বোপরি প্রেম ও মানবতার কবি হিসাবে তাঁর কাব্যভিসারে ছিল নায়কোচিত সৌন্দর্যের সংবেদ।
আধুনিক বাংলা কবিতাকে একসঙ্গে দেশীয় ও বিশ্বময়ী রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাঁর কবিতা বাঙ্গালী জাতির সৃজনশীলতার অভ্রভেদি আকাশকে স্পর্শ করেছে। তাঁর সময় বাংলা কবিতা এমন এক স্তরে গিয়ে পৌছে, সকল কাব্যপ্রেমী মাত্রই স্বীকার করবেন, বাংলা কবিতা এখন বিশ্বের অন্য সকল সমৃদ্ধ ভাষার উচ্চতম কবিতার সমতুল্য হয়ে দাড়িয়েছে।
পঞ্চাশ দশকের শামসুর রাহমান তাঁর সঙ্গে এমন সব মেধাবী কাব্যসারথীদের পেয়েছিলেন, যাঁরা ছিলেন সকল দিক দিয়ে মেধবী ও উচ্চ মানবিক রুচিবোধসম্পন্ন। যারা বাংলা সাহিত্যে, শিল্পকলায় ও সঙ্গীতের মাধ্যমে মানবীয় সুকুমারবৃত্তিগুলোকে ছড়িয়ে গিয়েছিলেন বাঙালি জাতির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। এ সকল মেধাবী মানুষদের সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃজন ও মননচর্চা একটি পরিপুষ্ট স্থানে আসতে পেরেছে এবং এর সাথে জড়িয়ে গেছে বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তাও।
শামসুর রাহমানই একমাত্র কবি, যিনি কোন কানকথায় বিভ্রান্ত না হয়ে, কারো দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের বিবেকী সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। বাঙালি জাতির দুঃসময়ে তিনি সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি কবিতার ঘর থেকে গণকবিতার পথে নেমে এসেছিলেন। সাধারণ মানুষের সাথে গড়ে তুলেছিলেন এক নিবিড় প্রেমময় আত্মীকবন্দন। শামসুর রাহমানের কবিতা জীবন যাপন ছিল সত্য ও সুন্দরের সপক্ষে। মানুষ ও মানবতা ছিল তার বাগদেবীর সবচেয়ে বড় উপজীব্য বিষয়। তাই কবির সুরে ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় কবি বলেন-
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজয় কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা,
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা শোভিত স্লোগানমুখর ঝাঁকালো মিছিল,
স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
শামসুর রাহমানের সময়েই আমরা দেখেছি- শিল্পই পারে কবিতা এবং জীবনকে সমান্তরালভাবে স্পর্শ করতে। কবিতা হচ্ছে ব্যক্তিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং বৈশ্বিক এক আলোকোজ্জ্বল স্বপ্নময়তা- যা বাস্তবতার জগতে ছড়িয়ে দিলে সোনালি সুন্দরে ভরে যায় তেপান্তরের মাঠ-ঘাট, নদী-সমুদ্র, পাহাড় চরাচর ও আদিগন্ত নীলাকাশ। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য যে, শামসুর রাহমানের মতো একজন সুকুমুর কাব্য কালপুরুষ, তাদেরকে পথ দেখিয়েছেন। স্বাধীনতার কবিতাসহ প্রেম-আর্তমানবতা এবং বাস্তবতার সাথে মাতোয়ালা রাইত মিলে বাংলা কাব্য জগতে এমন এক রহস্যঘন পৃথিবী অবস্থিত হয়েছে, যা পাঠককে জীবন সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করতে উদ্দীপ্ত করে। আর শামসুর রাহমান হচ্ছেন সেই নতুন চিন্তার সংবেদ জাগিয়ে দেয়া কবি কথাকার।
কবি ও কবিতাসহ শিল্প সাহিত্যের প্রতি আমার ভালবাসা ছোটবেলা থেকেই। শৈশব থেকে কবি ও শিল্প-সাহিত্যিক-এক কথায় যারা সৃজনশীলতার চর্চা করেন তাদের ভালো লাগে। এই ভালো লাগা থেকে আমি একটি প্রকাশনা শিল্প দাঁড় করিয়েছি। কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। এবং প্রকাশনা নিয়ে তার সঙ্গে আলাপও কবি, এক পর্যায়ে নাম চয়নের কথা আসলে বহুবিধ নামের সঙ্গে ‘লেখালেখি’ নামটিই আমরা পছন্দ করি।
পালক সাস্কৃতিক গোষ্ঠি শিল্পখাতে বিশেষ অবদানের জন্য আমাকে একটি পুরস্কার দিয়েছিল। পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমানের হাত থেকে আমি পুরস্কারটি গ্রহণ করি। এটা ছিল আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা। আমার প্রকাশনা ‘লেখালেখি’ শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর আত্মপ্রকাশ করেছে। তা না হলে তার যে কোন একটি নতুন বই আমি প্রকাশ করার সুযোগ পেতাম। এখন তা সম্ভব না বলে ২০০৯ সালে তার প্রতি গভীর ভালবাসা ও দায়বোধ থেকে ‘স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান’ নামে একটি ছোট গ্রন্থ সম্পাদন করেছিলাম। উক্ত গ্রন্থে কবি শামসুর রাহমানের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন কবি আল মাহমুদ, খান সারওয়ার মুরশিদ, কবির চৌধুরী, ড.আনিসুজ্জামান, শহীদ কাদরী, ড. সফিউদ্দিন আহমদ, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা।
কবি শামসুর রাহমানের জনম তার পৈত্রিক নিবাস ৪৬ নম্বর মাহুৎটুলিতে, পুরান ঢাকায় ২৩শে অক্টোবর ১৯২৯ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী ডিগ্রী লাভ করেন। সাংবাদিকতা নিয়ে তার পেশা জীবনের শুরু। মনিং নিউজ, দৈনিক বাংলা সহ নানা পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।
১৯৮৭ সালে কবিকে কেন্দ্র করে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠিত হয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এই সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন। কবি শামসুর রাহমান উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, গান, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থসহ বহু গ্রন্থের প্রণেতা। কবিতায় তিনি ছিলেন বলিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত। তার অগণিত কাব্য আমাদেরকে উপহার দেন। ১৯৬০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গণ বন্দি শিবির থেকে, রৌদ্র করোটিতে, উদ্ভট উঠের পিঠে চলেছে স্বদেশ, হরিণের হাড় প্রভৃতি। শিশুদের ছড়ার বই, গল্প, উপন্যাস প্রতিটি শাখায় তিনি গ্রন্থ রচনা করেন।
২০০৬ সালে ১৭ই আগস্ট কবি আমাদের ছেড়ে পর জগতে চলে গিয়েছেন। সাহিত্যকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য কবি ১৯৬৩ সালে আদমী পুরস্কার, ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে একুশে পদক, ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা পদক সহ দেশী-বিদেশী অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।
কবি শামসুর রাহমান সম্পর্কে কবি আল মাহমুদ বলেন, “শামসুর রাহমান গদ্য ও লিখেছেন। তবে তা অপেক্ষাকৃত কম। পয়ার ছন্দ, যাকে আমরা অক্ষরবৃত্ত বলি, এটা শামসুর রাহমানের হাতে স্ফুর্তি পেয়েছে। এত সহজ এবং স্বাভাবিকতায় তার পয়ার বা অক্ষরবৃত্ত প্রবাহিত হয়েছে যে, আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি। কারণ, আমারও তো অধিকাংশ কবিতা অক্ষরবৃত্তেই রচিত। তার কবিতা আমি সব সময় আমার পাশে হাত বাড়ালেই পেয়েছি, পড়েছি এবং তার প্রতি আমার গভীর প্রীতিপূর্ণ মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। তার মতো কবির প্রতি শ্রদ্ধাভাব আমার প্রথমাবধি ছিল। শামসুর রাহমান অসাধারণ দক্ষতায় তার নিপুণ কাব্য সম্ভার সাজিয়ে তুলেছেন।”
কবি শামসুর রাহমানের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন কবীর চৌধুরী। এক সাথে লেখা, আন্দোলন, পথ চলা প্রভৃতি ছিল কবির সঙ্গে কবীর চৌধুরী। জীবনের শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত কবীর চৌধুরী কবির ভালবাসার ব্যক্তি। মৃত্যুঞ্জয়ী শামসুর রাহমানের স্মৃতি উদ্দেশ্যে শীর্ষক এক প্রবন্ধে কবীর চৌধুরী বলেন, “আমার প্রিয়তম মানুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সমকালীন বাংলাভাষার সার্থকতম কবি বলেই শুধু নয়, তার উদার মানবিক গুণাবলীর জন্যও বটে। তার কথা মনে করলেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে স্নিগ্ধস্মিত হাস্যোজ্জ্বল একটি মুখ, শিশুর মত সরল কৌতুহলী দুটি চোখ, হাজারো বিপর্যয়ের মধ্যেও জীবনবাদী। শামসুর রাহমান তার কবিতায় বাংলাদেশের রূপক প্রতিমা ও চিত্র কল্পের পাশাপাশি গ্রিসের প্রাচীন ধ্রুপদী ঐতিহ্য এবং পৌরানিক কাহিনীকে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন।
শামসুর রাহমানের কবিতার বিষয়ে তাকে আমার কাছে মৃত্যুহীন করে ধরে রেখেছেন। এক সময় আমি তার উদ্দেশ্যে একটা কবিতা লিখে ফেলি।
কবিতার প্রতি পংক্তির প্রথম অক্ষরগুলি উপর থেকে নিচে লম্বমানভাবে পড়ে গেলে পাঠক তার মধ্যে কবির নামটি আবিস্কার করবেন।
শাওন রাতে যার লাগি কান পেতে ছিল রবি
মগ্ন চৈতন্যে রেখেছিল যারে তুমি কি সেই কবি
সুর মানব, আমাদের শার্ট আর স্বাধীনতা তুমি
রঙিন কামনা বাসনা আর রক্তাক্ত স্বদেশ ভূমি
রাতদিন তুমি সব সৃষ্টিতে তোমায় দিয়োছো ঢেলে
হওনি কখনও কৃপণ, বুকের দরাজ কপাট দিয়েছো মেলে।
মানি সানন্দে আজ তুমি আমাদের কবি
নও শুধু ভোগী কিংবা কেবলই বিরাগী।”
কবি শামসুর রাহমান যে কাব্য সাধনা করেছেন, তার মধ্যে ফাঁকির জায়গা নেই, কবিতার শিল্পরূপ সম্পর্কে তার যে প্রত্যয় আছে, তার মধ্যে আপসের সুযোগ নেই। অন্যদিকে তিনি মানুষকে ভালোবাসেন হয়তো বিশেষ করে ভালবাসেন তার দেশকালের মানুষকে, সে ভালোবাসার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। শামসুর রাহমানের বিশেষ কৃতিত্ব এই যে, কবিতার প্রতি ও মানুষের প্রতি বিশ্বস্ততাকে তিনি এক জায়গায় মেলাতে পেরেছেন। সেই যে একটি কবিতায় তিনি বলেছিলেন:
আমরা যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো
মিলি রাতের গভীর থামে,
তখন জাগি ইতিহাসে ঘুরছে কাঁটা
পড়ছে বোমা ভিয়েতনামে!
শামসুর রাহমান একজন যোগ্য নাগরিক কবি। ঢাকা শহরে তর বেড়ে উঠা, পড়াশোনা, কর্মজীবন সব কিছু। তবে তিনি শুধু নগর জীবনের চালচিত্র নিয়েই কবিতা লিখেছেন-তা নয়। নগর জীবনের তুলনায় তার কাব্যে চিরায়ত ও চিরন্তন বাংলার মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দু:খ ও ব্যথা-বেদনা এবং প্রকৃতি ও মানুষ ও অনুজ্জ্বল নয়। তবে শামসুর রাহমান গ্রাম জীবনের যে চিত্র এঁকেছেন তা পরিমার্জিত পরিশীলিত, মুন্সীয়ানা এবং শৈল্পিক উদ্ভাবিত। যেমন তার কবিতায়:
“তোমার ধানের বাংলাদেশ
হোক বা না হোক, আজও এখানে এ বাটে দৈনন্দিন
চলে আনাগোনা নানা পথিকের মাঠে বীজ বোনে,
ধান কাটে কর্মিষ্ঠ কৃষক আর মাঝি টানে দাঁড়।
অবশ্য নিরন্ন মনমরা রাখালের দল ভাঙা
বাঁশি ফেলে দিগন্তের হাম্বারব থেকে খুব দূরে
সহসা শহরে ছোটে কারখানার ভেঁপুর মায়ায়।”
শামসুর রাহমানের সাহিত্য একান্ত আপন সৃষ্টির। নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে তিনি আজীবন সাহিত্যচর্চা করেছেন। আমাদের বড় দোষ আমরা আমাদের প্রশংসা করতে পারি না। ভালকে ভাল বলতে আমাদের কেন যেন কষ্ট হয়। আমাদের কেউ কোনো মৌলিক বক্তব্য উপস্থাপন করলে বা মহৎ কিছু বললেই, আমরা তা মেনে নিতে পারি না। আমরা বলি এই তো মৌলিক নয় এ যে পাশ্চাত্যের নকল। তিনি এই বিষয়ে অতি দৃঢ় বাক্যে- বলেছেন:
“দেশি কিংবা বিদেশী কবির প্রভাব ঝুঁকে বেড়ান তারা
নিপুণ গোয়েন্দার মতো।
বলতেই হয় তারা বুদ্ধিমান মগজওয়ালা দামি মানুষ
তাদের ভয়ানক বিদ্যার স্কেল দিয়ে মেপে দেবেন
সৌন্দর্য, কিন্তু কী মূঢ় তাদের বিবেক।”
শামসুর রাহমানে নিজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ১৯৭৬ সালে তার শ্রেষ্ঠ কবিতা, ১ম সংস্করণের ভূমিকায় বলেন, “যা কিছু মানুষের প্রিয় অপ্রিয় যা কিছু জড়িত মানব প্রকৃতির সঙ্গে, সে সব কিছুই আকর্ষণ করে আমাকে। সব চেয়ে বড় কথা, সুদূর সৌরলোক, এই চরাচর, মানুষের মূর্খ, বাঁচার আনন্দ কিংবা যন্ত্রণা, সবসময় বন্দনীয় মনে হয় আমার কাছে। আমি তো জীবনের স্তরে স্তরে প্রবেশ করতে চাই, কুড়িয়ে আনতে চাই পাতালের কালি, তার সকল রহস্যময়তা। যে মানুষ টানেলের বাসিন্দা, যে মানুষ দুঃখিত, একাকী-সে যেমন আমার সহচর, তেমনি আমি হাঁটি সে সব মানুষের ভিড়ে, যারা ভবিষ্যতের দিকে মূখ রেখে তৈরি করে মিছিল।”
‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ এবং “স্বাধীনতা তুমি’ এই দুইটি লাইন আমাদের সকলের মুখে মুখে। প্রায় সব সময় আমরা আবৃত্তি করি। এই দুইটি কবিতার অবিনাশী প্রভাব, আকর্ষণ ও গ্রাস থেকে নবীশ, নবীন-প্রবীণ কোন কবিই মুক্ত নন। কবিতায় কবি প্রথমে তাই প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন-
“আর কতবার বাসাতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খান্ডব দাহন?
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের উপর।
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতে হবে।
শামসুর রাহমানের শিকড় রায়পুরার পাহাড়তলী গ্রামে। কিন্তু জন্ম তার ঢাকায়। তার মন মানসিকতার বিকাশ ঘটেছে ঢাকা শহরে। তাই তিনি লিখেছেন “স্মৃতির শহর ঢাকা।’ এই ঢাকার ব্যপ্তি, বিকাশ এবং তার কাব্যচর্চা, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থান ও মিছিল শ্লোগান সবই তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া স্মৃতি। তার বহু কবিতা রচিত হয়েছে ঢাকাকে নিয়ে। ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সৌন্দর্য তার কাব্যে স্থান পেয়েছে। তার আশৈশব বেড়ে উঠা শহর ঢাকা অনেক কবিতার মূল বিষয়।
কবি শামসুর রাহমান সম্পর্কে ড. সফিউদ্দিন আহম্মদ তার ‘শামসুর রাহমানের কবিসত্তা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেন, “শামসুর রাহমান সমাজ সচেতন কবি। দেশ, সমাজ ও মানুষের প্রতি শিল্পীর দায়িত্ব ও অঙ্গীকারে একাত্ম হয়েই তিনি কবিতা লিখেছেন। মৃত্যু তার কাছে এমন কিছু নয়। নীচ-দুর্বৃত্তদের পায়ের তলায গুঁড়ি মেরে দিন যাপনের কবি তিনি ছিলেন না। মারা, মারী, সন্ত্রাস, বিপর্যয় ও অবক্ষয়, ধ্বংস ও মৃত্যুর তান্ডবে এবং শোষণ, নিপীড়ন ও অত্যাচারে দেশ আজ চরম সংকটের মুখে। শামসুর রাহমান আশাবাদী ও প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ-
ঐ তো দূরে যাচ্ছে দেখ চূড়া
অপরূপ আস্তানার, যার
প্রদীপের আভা, মুছে ফেলে,
দেবে অতীতের ভ্রান্তি দুর্গন্ধ এবং হাহাকার।
সম্মুখে উঠেছে ভেসে অগ্রসর তরুণ-তরুণী
সার্থকতা পেয়ে যাবে, অন্তরালে ধন্য হবে কবি।
“বিংশ শতাব্দীর মানুষ মূলত বিশ্ব মানুষ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালী ও বিশ্ব বাঙালী। শামসুর রাহমান সেই বিশ্ব বাঙালীর এক প্রমুখ শৈল্পিক অভিব্যক্তি। কথাগুলো বলেছেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। তিনি আরও বলেন, “প্রবহমান ঘটনাশ্রোতকে শৈল্পিক কাব্যভাষ্যে রূপান্তরিত করতে গিয়ে শামসুর রাহমান তাই ভ্রমণ করেছেন তার অধিক ও অর্জিত তাবৎ মনোবিশ্বে। রাহমানের এই মনোবিশ্বের কেন্দ্র রয়েছে সমকালীন মহাভূমি এবং তা বিস্তৃত হয়েছে সমকালীন আন্তর্জাতিক বিশ্বে।
কবির ভাষায়:
সংকটে কবির সত্তা আরো বেশি চিন্তাশ্রয়ী হয়,
কতিপয় খর স্বপ্ন তাকে
বিচলিত করে খুব, বিশেষত মাথার বিষয়ে
ভাবে রাত্রি দিন
প্রায় প্রতিদিন হয়তো বা সারাক্ষণ কোনো কোনো
নির্ঘুম রাত্তিরে কি তার কথা মাথার ভিতর
নিজেই ভ্রমণকারী: দ্যাখে সে মরাল কতিপয়
নীলিমার সাথে রিশতা পাতে
উড়ে চলে অন্তহীন আলাদা আকাশেৃৃ
বাংলাদেশের কবিতার রাজ্যে যিনিÍ
রাজা তিনি কবি শামসুর রাহমান। খান সারওয়ার মুরশিদ এর একটি ছোট্ট বক্তব্য দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি- “শামসুর রাহমানের কাব্যিক অবদান অমূল্য। মানুষের ভাগ্য নিয়ে, জাতির ভাগ্য নিয়ে এ কবি খুব ভাবেন, বিশ্বাসে অবিশ্বাসে থাকে ‘প্রতীক্ষায়ৃ. প্রতীক্ষায়ৃ. প্রতীক্ষায়ৃ। শামসুর রাহমানে মানুষ নির্ভরতা নিষ্ঠা এবং বীরপনা মনকে স্পর্শ করে, তার শক্তির কথা ভাবলে আমার মনে হয়, তিনটি ক্লাসিক লাইন লিখে অমর হওয়ার প্রচেষ্টায় এ কবি, লিপ্ত ছিলেন না। তবুও এই অভিযাত্রী কবির রচনার প্রাচুর্য এবং উৎকর্ষ একটি বড় প্রতিভারই সাক্ষ্য বহন করে এবং শামসুর রাহমানের কাছে বাঁচা মানেই ছিল কবিতা।”




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com