‘তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমদের ছোট গাঁয়’ কবির নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম ছোটবেলায়। সেই নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়েছিলাম স্মৃতিবিজড়িত ফরিদপুরের গোবিন্দপুর গ্রামে। যেখানে বসে কবি পরিচয় করিয়েছিলেন রসুলপুরের আসমানীর সাথে, নকশীকাঁথার মাঠের হাসুর সাথে, ডালিম গাছের তলে দাদীর কবর দেখিয়ে নাতনির সাথে আমাদের কাঁদিয়েছিলেন। প্রকৃতির রূপের চমৎকার সৌন্দর্য ফোটানো কুমার নদীর পারে বসে শুনিয়েছেন আনমনে খেলা করে যাওয়া রাখাল বালকের কথোপকথন।
ফরিদপুর শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে কুমার নদীর দক্ষিণে গোবন্দিপুর গ্রামে পল্লীকবি জসীমউদ্?দীনের বাড়ি। বাড়িতে চারটি পুরাতন টিনের চালা ঘর রয়েছে। কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র ঘরগুলোতে সংরক্ষিত রয়েছে। কবির স্মৃতিবিজড়িত অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাড়ির উত্তরে কবির কবর। কবর স্থানের পাশেই পাকা রাস্তা ও কুমার নদী। কুমার নদীর পারে দর্শনার্থীদের বসার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির সামনে নদীতীরে একটি গাছে কবি নজরুল ইসলামের কবিতার দুটি লাইন লেখা রয়েছে। ‘আকাশেতে একলাদোলে একাদশীর চাঁদ, নদীর তীরে ডিঙি তরী পথিক ধরা ফাঁদ।’ পল্লীকবির বাড়িতে এসেছিলেন নজরুল, তখন এখানে মাদুর পেতে বসতে দিয়েছিলেন। সেখানে বসেই আধঘণ্টার মধ্যে এই কবিতাটি লিখেছিলেন। কবির বাড়িতে প্রবেশ করে উঠানে দাঁড়ালেই যে ঘরটি চোখে পড়ে সেটির দেয়ালে কবির অমর সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতাটি টানানো আছে। এই ঘরে বসেই কবি ‘রাখালী’ ও ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। হাতের ডানপাশে চোখে পড়ল ছোট্ট একটা কাচারি ঘর। কাচারি ঘর থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ল চমৎকার গাছবাড়ি, দরজায় লেখা আছে ‘প্রতিদান’ কবিতার প্রথম দুটি লাইন- আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর। সেখান হতে একটু সামনে কবির পিতা আনসার উদ্দিনের কক্ষ। সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হাসু মিয়ার পাঠশালা। পাশেই সংরক্ষিত রয়েছে ১৯০০ সালের যশোর, খুলনা অঞ্চলের রুমাই নকশীকাঁথা। কবির ছেলে হাসু ও বাঁশুমনির স্মৃতিঘর। কবি ও তার সন্তানদের আলোকচিত্র এবং কবির দেশভ্রমণের ছবি।
কবির বাড়িতে উল্লেখযোগ্য সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে নকশী কাঁথা, হরেক রকম মুখোশ, মাটির বিভিন্ন পুতুল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অটোগ্রাফ সম্বলিত বই, কবির নিজের হাতে ছাপানো বই, পীর দুদু মিয়ার আমলের তরবারি এবং গ্রামফোনের দুর্লভ সব রেকর্ড, মরমি শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া পল্লীগীতি। কবিরুন নেসা কবির বাড়ির কাজের মানুষ। যিনি এখন দর্শনার্থীদের টিকেট বিক্রি ও স্মৃতিঘর ঘুরে দেখান। তিনি বলেন, কবি খুব ভালো লোক ছিলেন, আমরা নানা কইছি তারে। আমাদের ঘুরতে নিয়ে যেত। দোহানে নিয়ে খাওয়াইতো, চুরি ও কানের দুল কিনে দিত। এবার বাড়ি ফেরার পালা। জিয়ারত করার জন্য কবরের সামনে দাঁড়াতেই চোখ ভিজে গেল। মনে পড়ে গেল বিখ্যাত কবিতা- এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। ঠিক কবিও ৪৬ বছর ধরে প্রিয়জনদের নিয়ে ডালিম গাছের তলে শুয়ে আছেন। আমরাও তাকে দুই নয়নের জলে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।