বিচিত্র সৃষ্টির বৈভবে আসাদ বিন হাফিজ গড়ে তুলেছেন তার নিজস্ব সাহিত্য বলয়। নানাবিধ মাধ্যমে কাজ করেছেন বলে কোন পরিচয়টি প্রধান সেটা এক নিমিষেই নির্ধারণ করা কঠিন। তবে তার সবগুলো কাজের ওপর সমান নজর রাখলে শিশু সাহিত্যই বেশি ওজনদার মনে হয়। বিষয়টি সত্য হলেও, তার অন্যান্য কাজও অগুরুত্বপূর্ণ নয়, বিশেষ করে কবিতায় অবস্থান এখনো মূল্যায়ন সাপেক্ষ। গদ্যেও যে-দুটি গ্রন্থ তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন [‘ভাষা আন্দোলন: ডান-বাম রাজনীতি’ (১৯৯০) ও ‘ইসলামী সংস্কৃতি’ (১৯৯৫) বই দুটি মাথায় রেখে এ মতামত প্রকাশ করা হচ্ছে] তার তুলনা মেলা ভার। এখনও প্রচ-ভাবেই বলা চলে সক্রিয় এই লেখক, তাই একেবারে প্রান্তিক মন্তব্য তার সাহিত্য সম্পর্কে করার সময় আসেনি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সৃজনশীলতার পাশাপাশি আসাদ বিন হাফিজ আরও একটি কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো সাহিত্যে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহারে। এ দৃষ্টিভঙ্গি যদিও এখন অনেক সাহিত্যকর্মীর রচনায় দেখা যায়, কিন্তু তবুও সারা বিশ্ব জুড়ে ধর্মহীন সাহিত্যের যে জয়জয়কার ও পৃষ্ঠপোষকতা, সে-তুলনায় এ স্রোতধারা অত্যন্ত ক্ষীণ এবং সেই ক্ষীণ কিন্তু খরস্রোতা ধারারই বিপ্লবী প্রতিনিধি আসাদ বিন হাফিজ। এজন্য তার সাহিত্য বিপ্লবী সাহিত্য; কারণ, তিনি যে-জীবন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন তা ইসলাম। এই জীবন ব্যবস্থা আজ বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে বিজয়ী শক্তি হিসেবে টিকে নেই। অথচ মহান আল্লাহরও অঙ্গিকার তিনি ইসলামকে বিজয়ী করবেন। আমাদের এই সাহিত্যিক বিশ্বাস করেন একমাত্র ইসলাম বিজয়ী হলেই মানুষ ফিরে পাবে তার মর্যাদা, অভাব-অনটন আর দারিদ্রের হবে চির অবসান। তাই তিনি এ সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন এবং প্রতিষ্ঠা করতে চান এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে মানুষ কেবল গোলামি করবে মহান রাব্বুল আলামিনের। এ দৃষ্টিভঙ্গিকে অবলম্বন করে তিনি সৃষ্টি করেন সাহিত্য, তার রচিত সাহিত্যের কেন্দ্রীয় বক্তব্য এটিই। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এরকম দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী সাহিত্যশিল্পী হাতে গোনা। যে-কজন রয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হলেন আসাদ বিন হাফিজ। এদিক থেকে তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আধুনিক বাংলা সাহিত্য এরকম কণ্ঠস্বরের পরিচয় তার প্রতিষ্ঠালগ্নে পায়নি বললেই চলে; আর পাবেই বা কিভাবে, মুসলিম উম্মাহ ছিল দীর্ঘ ঘুমে অচেতন। শতাধিক বছর ধরে এ উম্মাহ অত্যন্ত নগ্নভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ করে গেছে। এখনও অনুকরণ প্রথা না থামলেও কিছুটা বোধোদয় হওয়া শুরু হয়েছে। রাত যত গভীর হয় ততই বাড়তে থাকে সূর্যোদয়ের সম্ভাবনা। মুসলিম জাহান যখন এই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তখন তার বিভিন্ন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন কিছু সংস্কারক পুরুষ। তারা তাদের বিপ্লবী কর্ম ও চিন্তার মাধ্যমে উম্মার ভেতরে নতুন প্রাণ চাঞ্চল্য জাগিয়ে তোলেন। ইসলামকে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিতে সময়োপযোগী ব্যাখ্যায় এরা উপস্থাপন করা শুরু করেন। এ চিন্তাবিদরা এ ধারণা জনগণের সামনে পেশ করলেন যে ইসলাম শুধু ধর্ম মাত্র নয়, তা এক বিপ্লবী জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম এসেছে মানব জীবনকে আল্লাহর রঙে রাঙিয়ে দেবার জন্য, এসেছে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এ চিন্তার আলোকে নতুন করে জেগে উঠছে মানুষ; বিশ্বের দেশে দেশে শুরু হয়ে গেছে জাগরণের প্রতিযোগিতা। জাগরণের শক্তি হিসেবে ইসলাম সংস্কৃতিকে খুবই প্রয়োজনীয় মাধ্যম মনে করে; আর সাহিত্য হলো সংস্কৃতিরই এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। যে-মাধ্যমকে ব্যবহার করে মানুষের চিন্তা ও চেতনার ওপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব। শিক্ষাপ্রাপ্ত-আলোকপ্রাপ্ত বর্তমান সময়ের মানুষ পশ্চিমা সংস্কৃতির নির্জীব গোলামে পরিণত হয়েছে। উদ্দেশ্যহীন জীবন ও ভোগবাদী মানসিকতাই হলো তথাকথিত পশ্চিমা সভ্যতার অবদান। আসাদ বিন হাফিজ সাহিত্যের জন্য যে-মূল্যচেতনাকে কেন্দ্রীয় বিষয় করেছেন কেবল তাই পারে ধবংসকামী মানবতাকে রক্ষা করতে। তাই আগামীতে এ মূল্যচেতনাই জয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যাবে পথহারা মানুষ আবার ফিরে পাবে পথ।
আসাদ বিন হাফিজের একটি অন্যতম পরিচয় তিনি কবি। কি পরিচয়টির প্রতি এখনও তিনি সুবিচার করেন নি। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত হয়েছে দুটি মাত্র [আমাদের জানামতে] মৌলিক কাব্যগ্রন্থ: ‘কি দেখ দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর’ (১৯৯০) ও ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ (১৯৯৬)। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর অতীত হয়েছে প্রায় বারোটি বছর, অথচ প্রকাশিত হয়নি নতুন কোনো কাব্যগ্রন্থ। এ থেকেও বোঝা যায়, কবিতা থেকে হয়ত দূরে অবস্থান করছেন এই লেখক, সম্ভবত অন্য কোনো সৃষ্টির মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন। এটা যদি সত্য হয় তাহলে তিনি বঞ্চিত করছেন তার কবিতার পাঠকদের।
আসাদ বিন হাফিজের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কি দেখো দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর’। মোট একষট্টিটি কবিতা স্থান পেয়েছে এখানে; কবিতাগুলি বিচিত্র বিষয়ের ঠাসবুনুনি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই এই কবির অন্তত একটি বিষয় পাঠক আবিষ্কার করে ফেলেন যে, এই কবির ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল। আধুনিক কবিতারূপী যে-দুর্বোধ্য চিজ অনেক সমকালীন পদ্যকার প্রসব করেন আমাদের আলোচিত কবি তা থেকে মুক্তই বলা যায়। এ কবির কাব্যসৌধ গড়ে উঠেছে সুবোধ্যতার ভিতের ওপর। গ্রন্থের বিষয়, বক্তব্য ও প্রকরণ প্রচলিত বৃত্তের ভেতরেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষার বন্ধুর পথে তিনি পা বাড়ান নি, ফলে সব শ্রেণির পাঠকই তার রচনা থেকে রসাস্বাদন করতে পারবেন। এ গ্রন্থের বহু কবিতার ভেতর বিবিধ বিষয় বক্তব্যের সমাবেশ ঘটেছে। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় থেকে শুরু করে প্রেম-ভালোবাসা, বিপ্লব, মানবিকতা, আন্তর্জাতিকতা, ইসলামী অনুষঙ্গ প্রভৃতি তার কবিতার অবলম্বন হয়েছে। তবে অন্ত্যানুপ্রাসহীন কবিতার চেয়ে অন্ত্যানুপ্রাসবহুল কবিতাতেই তিনি বেশি সাবলীল।
ক. কিন্তু আঁখি বুঝলি না তুই চাতক চেয়ে রই
এ সমাজে ভালোবাসার সময় পেলাম কই? [চিঠি]
খ. তাগুতের উৎখাতে দুর্বার
আমাদের গতি নয় রুখবার [গুডবাই]
ছন্দের চঞ্চল দোলা ও অন্ত্যানুপ্রাসের নিটোল ঝঙ্কারে চমৎকার এক আবহ তৈরি হয়েছে পঙক্তিগুলোর মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, আসাদ বিন হাফিজের শিল্পী সত্তায় ধরা পড়েছে আবেগ মাখানো এক দুঃখের কথা, এ সমাজকে নতুন করে কবি গড়তে চান। এখনও সমাজে যে অবক্ষয়, যে ধস ও পতনের ঘনঘটা, সেখানে হৃদয় নিয়ে কারবার করার সময় কই! একজন সচেতন মানুষকে, একজন বিপ্লবীকে তো সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয় সমাজ পরিবর্তনের দৌড়ে, সেখানে প্রেয়সীকে দেবার মতো সময় তার কই। দ্বিতীয় পঙক্তি দুটির মধ্যে তার আন্দোলন সংগ্রামের চরিত্র আরও পরিষ্কার; এ সমাজ তাগুতি সমাজ, তাগুতকে অপসারণ করে পারলৌকিক বিধানের এক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চান। এ সংগ্রামের জন্যই তিনি ছাড়তে চান ঘর-সংসার।
গুডবাই কামরুন চললাম
সামনেই মুক্তির সমংগ্রাম। [গুডবাই]
বক্তব্যের অতিরিক্ত সরলতা ও স্লোগানমুখীতার জন্য অনেক পঙক্তি কাব্যপদবাচ্য হবার মর্যাদা হারিয়েছে।‘দয়া করে মোল্লাদের আর ক্ষ্যাপাবেন না’ Ñ এই পঙক্তিটি ‘অশনি সংকেত’ কবিতার; এ রকম অনেক দুর্বল পঙক্তি রয়েছে এ কাব্যগ্রন্থে;আর ‘উৎকর্ষতা’-র মতো ভুল শব্দের প্রয়োগও সচেতন পাঠককে আহত করে। এছাড়াও তৃতীয় সংস্করণ হওয়া বইতে রয়ে গেছে প্রচুর মুদ্রণপ্রমাদ।
কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’; এ গ্রন্থটি প্রথম কাব্যগ্রন্থ অপেক্ষা অনেক বেশি সুগ্রন্থিত ও সুপরিকল্পিত। এখানকার কবিতাগুলোও নির্মাণ, গ্রন্থনা ও সৌন্দর্যের দিক থেকে অনেক বেশি কুশলতায় পরিপূর্ণ। যদিও এ গ্রন্থেও আসাদ বিন হাফিজ তার বক্তব্য প্রকাশের সরল ধারাই অবলম্বন করেছেন তবুও তা রচনার কৌশলে দ্যোতনাময় হয়ে উঠেছে। দেখা যায়, দ্বিতীয় কবিতা গ্রন্থে এ কবি অনেক বেশি ভারসাম্যময়, অনেক বেশি শিল্প-কৌশলী। এখানে আছে সর্বসাকুল্যে মাত্র আঠাশটি কবিতা; কিন্তু এই আঠাশটি কবিতাই নির্বাচন করেছেন অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক। ফলে গ্রন্থটি হয়ে উঠতে পেরেছে এক সুনির্বাচিত কাব্য- সংকলন এবং এতে স্থান পেয়েছে বেশ কয়েকটি সার্থক মানের কবিতা, যেমন: ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’; ‘একটি দেয়াশলাইয়ের উপমা’; ‘আরেকটি মোনাজাতের খসড়া’ ও ‘অমূল্য তৈজষ’ ইত্যাদি। এর মধ্যে ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ কবিতাটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের মধ্যেই একটি অন্যতম সেরা কবিতা। আসাদ বিন হাফিজ আর কিছু না লিখলেও, আমাদের ধারণা, শুধু এই কবিতাটির জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন। কবি নিজেই এ কবিতাকে আর অতিক্রম করে যেতে পারেন নি। তিনি যে-সমাজের স্বপ্ন দেখেন তার অসাধারণ এক কাব্যিক রূপ দিয়েছেন এই কবিতায়। যা বাংলা সাহিত্যে আর কোনো কবির কলমে এ রকমভাবে ফুটে উঠেনি। যেমন কবি বলেন,
ক. আমি আমার জনগণকে আরেকটি অনিবার্য
বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি।
যে বিপ্লব সাধিত হলে মানুষের শরীর থেকে
খসে পড়ে শয়তানের লেবাস
জল্লাদের অশান্ত চিত্তে জন্ম নেয় বসরাই গোলাপ
অর্ধ পৃথিবীর দুর্দান্ত শাসক
কেপেঁ উঠে ফোরাত কুলের কোন
অনাহারী কুকুরের আহার্য চিন্তায়। [ অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার]
খ. যে বিপ্লব সাধিত হলে কন্যা হন্তারক
অভাবী পিতাদের জন্য পরওয়ারদিগার
খুলে দেন রহমতের সব ক’টি বদ্ধ দুয়ার।
তখন কোন অভাব আর অভাব থাকে না
উদ্বৃত্ত সম্পদ প্রদানের জন্য
পাওয়া যায় না কোন ক্ষুধাতুর বনি আদম। [ অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার]
গ. যেখানে অন্ধকার সেখানেই বিপ্লব
যেখানে ক্লেদাক্ত পাপ ও পঙ্কিলতার সয়লাব
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে নগ্নতা ও বেহায়াপনার যুগল উল্লাস
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে মিথ্যার ফানুস সেখানেই বিপ্লব
যেখানে শোষণ ও সুদের অক্টোপাস ক্যান্সার
সেখানেই বিপ্লব
বিপ্লব সকল জুলুম,অত্যাচার
আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে
বিপ্লব অন্তরের প্রতিটি কুচিন্তা
আর কুকর্মের বিরুদ্ধে। [ অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার]
উদ্ধৃত পঙক্তিগুলোর মধ্যে ফুটে উঠেছে একেবারে সরাসরি কোন ধরনের বিপ্লব কবি চান তার আকুতি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে, ইসলামী বিপ্লবের কথা, আর কোনো কবি, আমাদের জানামতে, এতো সার্থকভাবে বলতে পারেন নি। আলোচ্য কবিতাটির মধ্যে চরিত্র অনুযায়ী যে-ধরনের বক্তব্য মেজাজ থাকা দরকার তা কবি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। বিপ্লবী বক্তব্যের জোস অনুযায়ী যে-রকম শব্দ ও পঙ্িক্ত নির্মাণের প্রয়োজন ছিল তা পরিবেশ অনুযায়ী সাযুজ্যপূর্ণ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কাক্সিক্ষত ইসলামী সমাজের একটি চমৎকার ছবি ফুটে উঠেছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। কবিদের একটি প্রধান কাজ হলো মানুষকে স্বপ্ন দেখানো, আসাদ বিন হাফিজের এ কবিতা সংগ্রামী ও বিপ্লবী মানুষকে অনাগত বিপ্লবের স্বপ্ন দেখায়। যে-কোনো সার্থক কবিতার এও একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে কবিতাটিতে পঙক্তিগুলোর মধ্যে কোনো কোনো জায়গায় সাবলীলতা ক্ষুণ হয়েছে। পঙক্তির আয়তনের বিশালতা ও বক্তব্যের দীর্ঘসূত্রিতার জন্যই এ সমস্যা। তবে আশার কথা হলো, এ সমস্যা কবিতার রসাস্বাদনে কোনো বাধার সৃষ্টি করে নি।
এই কবিতাটি সম্পর্কে একটি ভুল সমালোচনার জবাব দেওয়া দরকার। কেউ কেউ মনে করেন, আসাদ বিন হাফিজের ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ কবিতাটি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ কবিতার নকল। পাঠক, ‘নকল’ শব্দটির প্রতি লক্ষ করুন। এ প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যের আরেকটি এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ঘটনাটি কমবেশি সবাই জানেন। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হবার পর মোহিতলালের প্রতিক্রিয়া ছিল ঈর্ষাপ্রসূত। তিনি নিজেও জানতেন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও তার ‘আমি’ প্রবন্ধ এক জিনিস নয়। দুটি দুই ধরনের সৃষ্টিকর্ম; তবুও মোহিতলাল সাহেব কেন চিৎকার জুড়েছিলেন তা বিচারের ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেওয়া গেল। কিন্তু আবু জাফর ওবায়দুল্লার যে-কবিতাটি প্রসঙ্গে আসাদ বিন হাফিজের কবিতাটিকে অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করা হয়, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আমরা দেখব যে ব্যাপারটা একেবারেই অনৃত ভাষণ। প্রথমে দুটি কবিতার কিছু লাইন উদ্ধৃত করা যাক,
ক. আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি।
আমি আমার পূর্বপুরেষের কথা বলছি।
আমার পূর্বপুরুষের সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল। [আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি]
খ. আমি আমার জনগণকে আরেকটি অনিবার্য
বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত নেয়ার কথা বলছি
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে
যেভাবে রুখে দাঁড়ায় আক্রান্ত দুর্বল
বিধ্বস্ত জাহাজ যাত্রীরা আঁকড়ে ধরে
ভাসমান পাটাতন
তেমনি একাগ্রতা নিয়ে
আমি আপনাদের আসন্ন বিপ্লবের জন্য
প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছি। [অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার]
উপরে উভয় কবিতার প্রথম স্তবক উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের মতে এখানে একটি অপরটির দ্বারা প্রভাবিত হবার মতো সমান্য উপাদানও নেই। প্রথম স্তবক থেকে দুটি কবিতাকেই মনে হয় আলাদা ও স্বতন্ত্র। এবার সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করা যাক দুটি কবিতার মূল বিষয় কী। ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ পদ্যে কবি তার এক পূর্বপুরুষের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন, সে কবিতা ভালোবাসে; বিপরীত পক্ষে যারা কবিতা ভালোবাসে না তাদের পরিণাম কী তার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। এখানে কবিতাকে প্রতীকায?িত শব্দও ধরা যেতে পারে, যা ধারণ করে সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও মঙ্গল। অপরদিকে ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ কবিতার বক্তব্য খুবই সরাসরি ব্যক্ত হয়েছে। কবি তার দেশের মানুষকে ইসলামী বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছেন। বক্তব্যের দিক থেকে দুটি কবিতার মধ্যে কোনো মিল নেই। এবার দেখা যাক কবিতা দুটির কিভাবে সমাপ্তি হলো,
ক. সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহবায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মত প্রতিরোধে উচ্চারণ কবিতা
আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো [আমি কি কিংবদন্তীর কথা বলছি]
খ. তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকবে
একটি করে রক্ত গোলাপ
সজীব ও তরতাজা
চিত্তহারী ঘ্রাণময়
আমি আপনাদের সেই আনন্দিত
অনিবার্য বিপ্লবের পতাকা উত্তোলনের জন্য
উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি। [অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার]
এখন নিশ্চয় মনে হচ্ছে যে, ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ সম্পর্কে কারো কারো উক্তি অবিবেচনা-প্রসূত বক্তব্য ছাড়া আর কিছু নয়। তবে হ্যাঁ, দুটি কবিতার মধ্যে একটি মিল রয়েছে, সেটি হলো উভয় কবিতাই দীর্ঘ কবিতা। এ গ্রন্থটিতে একটি প্যারোডি কবিতাও আছে, সেটি ‘আরেকটি মোনাজাতের খসড়া’। কবিতাটি প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতার জবাবে লিখা। আসাদ বিন হাফিজের এ জবাবী কবিতাও একটি চমৎকার শিল্পসফল কবিতা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।
‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ কাব্যগ্রন্থটিতে নানা বিষয় ও চিন্তার কবিতা স্থান পেয়েছে: বিপ্লব, ঐতিহ্যসংলগ্নতা, আন্তর্জাতিকতাবাদ, মানবিকতা, রাজনীতি, একান্ত ব্যক্তিগত অনূভুতি প্রভৃতি এর বিষয় রাশি। আসাদ বিন হাফিজের কাব্যভাষা প্রাচীনপন্থী নয় বরং তা সব সময় ছোঁয়ার চেষ্টা করে সমকালীন স্বীকৃত সাহিত্য ভাষার তটরেখা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ এ কাব্যগ্রন্থেও নেই বললেই চলে। সহজ-সরল কিন্তু আবেদনময়ী ভাষায় তিনি গড়ে তুলতে চান তার সৃষ্টির সৌধ। কবিতার ভাষা সহজ-সরল হলে সেখানে লাভ ও ক্ষতি দুটোই থাকে। সহজতার একটি ধনাত্মক দিক হলো তা সহজে পাঠকের বোধগম্য হয় ও দুর্বোধ্যতার অসহনীয় ভারে পাঠক ভারাক্রান্ত হন না। অপরদিকে কাব্যভাষা খুব সহজ-সরল হলে সেখানে শিল্পমান ক্ষুণ হবার আশঙ্কা থাকে। আসাদ বিন হাফিজ এই কাব্যগ্রন্থে সহজ সরল ও সাবলীল পঙক্তি নির্মাণে নিবেদিত থাকলেও রসের দাবীকে অস্বীকার করেন নি। এটিও এ গ্রন্থের একটি গুণ বলে স্বীকৃত হবে। অনেকগুলো অন্ত্যানুপ্রাস যুক্ত কবিতা স্থান পেয়েছে এই বইতে। যদিও এ ছড়া কবিতাগুলো কোনও ছড়ার বইয়ের সম্মান বৃদ্ধি করত কিন্তু এ কাব্যগ্রন্থে এ ধরনের কবিতা গ্রন্থের জন্যে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ হলো একটি অনুবাদ কবিতার সংকলন ‘নাতিয়াতুন নবী’ (২০০৩)। অবশ্য কবিতাগুলো আসাদ বিন হাফিজ নিজে অনুবাদ করেন নি, তিনি কবিতাগুলোকে কাব্যরূপ দিয়েছেন মাত্র।
কাব্যগ্রন্থের মতো আসাদ বিন হাফিজের গল্পগ্রন্থের সংখ্যা হাতে গোনা হলেও, নানা কারণে তা গুরুত্বপূর্ণ। এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে তার ছোট দুটি গল্পের বই। ‘পনরই আগস্টের গল্প’ (১৯৯০) ও ‘ইয়াগো মিয়াগো’ (১৯৯৫)। গ্রন্থ দুটির মধ্যে শেষেরটি লেখা হয়েছে ছোটদের জন্য। দুটি বইতে সব মিলিয়ে গল্প সংখ্যা তের; এই তেরটি গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে গল্পকারের গল্পের ভুবন; যে-ভুবন স্বকীয়, সম্ভাবনাময়ী এবং চমৎকার স্বতন্ত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, একজন শক্তিশালী গল্পকার পেতে গিয়েও আমরা পেলাম না। কবিতাতে আসাদ বিন হাফিজের মধ্যে যে-জিনিসের প্রচ- অভাব, তা হলো নিরীক্ষাপ্রবণতা; নতুনত্বের প্রতি গভীর আগ্রহ Ñ অবাক ব্যাপার হলো এর কোনোটাই অভাব নেই তার গল্পগ্রন্থে, বিশেষ করে ‘পনরই আগস্টের গল্পে’। নিরীক্ষা ও নতুনত্বের প্রতি ব্যাপক পক্ষপাত লক্ষ করি এই গল্পগ্রন্থে। তার প্রথম গল্পগ্রন্থের সাধনা ও নিষ্ঠা যদি অব্যাহত থাকত তাহলে আমরা এতদিনে পেলেও পেতে পারতাম একজন শক্তিশালী গল্পকারকে।
১৯৯০ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের প্রথম গল্প হলো ‘জাহান্নামের চৌরাস্তা’। খুবই সাধারণ একটি ঘটনাকে গল্পকার তার সৃজন-প্রতিভার সাহায্যে উচ্চতর বিন্দুতে নিয়ে গেছেন। গল্পটাতে আসলে তেমন কোনো কাহিনিই নেই, কিন্তু এই কাহিনিহীনতার মধ্যে থেকে যেভাবে তিনি কাহিনি তৈরি করলেন তা বিস্ময়কর। শেষের দিকে গিয়ে গল্পটি আর সাধারণ বর্ণনার স্তরে থাকেনি। তা পৌঁছে গেছে এক পরাবাস্তব আখ্যানের বৈশিষ্ট্যে। কল্পনা ও নিরীক্ষার যুগপৎ সম্মেলনে গল্পটি অর্জন করেছে এক বিশেষ মাত্রা।
‘বইছে নদী’ গল্পটির কাহিনি বয়ানের ঢং গতানুগতিক হলেও এর নৈতিক আবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় (জীবন ব্যবস্থা অর্থে) মূল্যবোধের অনুপস্থিতি শেষ পর্যন্ত মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় এবং পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা যে নিজের প্রয়োজনে নারীকে ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত তাকে পণ্য করে তোলে গল্পে এ কাহিনিই বর্ণনা করা হয়েছে সার্থকভাবে। গল্পের প্রধান চরিত্র কবির একটি পত্রিকার সাংবাদিক; তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাগরের কল্যাণেই চাকুরিটা পেয়েছে। এছাড়া সাগর তাকে যখনই প্রয়োজন হয় তখনই টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করে। এজন্য কবিরের স্বীকারোক্তি ‘এ পর্যন্ত সে যা করেছে কবিরের জন্য সোদ্দর ভাইও এতটুকু করেনা, কিন্তুু কবির যেমন ভাবত সাগরকে, সাগর আসলে তেমন মানুষ নয়। কেমন মানুষ তার প্রমাণ কবির পায় যখন একদিন সে আগে আগে বাসায় ফিরে আসে। বাসায় এসে দেখতে পায়, তার অতি প্রিয় বন্ধু সাগর তার প্রিয়তমা স্ত্রীর শয্যাসঙ্গী। এ ঘটনার পর দীর্ঘদিন কবিরের সময় কেটেছে তীব্র মানসিক অস্থিরতার মধ্যে। এ অস্থিরতা থেকে বাঁচার জন্য একদিন প্রগতির ধ্বজাধারী কবির জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। তার এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই এই কাহিনি শেষ হয়।
‘বাধা বিরহিনী’ গ্রামীণ বাস্তবতায় তরুণ-তরুণীর হৃদয় বিনিময়ের কাহিনি। গল্পটি যে-ভাবে শুরু হয়েছে, তাতে মনে হয় লেখক রাধা-কৃষ্ণের কাহিনির পুনর্র্নিমাণ করেছেন; কিন্তু কিছুদুর এগুলেই প্রকৃত বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠে। রাধা ও গোপালের মধ্যে মনের আদান-প্রদান হয়, এতে দু-পরিবারের আপত্তি ছিল না। গোপালের ইচ্ছা ছিল এবারের বর্ষায় নদী থেকে প্রচুর মাছ ধরে যে টাকা পাবে, সেই টাকায় নতুন ঘর বানিয়ে রাধাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। অথচ গোপালের স্বপ্ন আর পূরণ হতে পারে নি, ওই বছর কোনো এক অব্যাখ্যেও (ফারাক্কা বাঁধ) কারণে বর্ষা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলে নদীতে পানিও কমে যায়। ফলে মাছ বেশি একটা ধরা যায়নি, ‘কোন রাক্ষুসী নাকি বাঁধা দিয়েছে গাঙের মধ্যে।’ এ কারণে গোপালের স্বপ্ন ভঙ্গ ঘটে এবং তার মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেয়; শেষ পর্যন্ত এ জুটির মিলন হলো না। এভাবে শেষ হয় গল্পের কাহিনি।
‘আশ্রয়’ও ‘বিদ্রোহী’ গল্প দুটি ঐতিহাসিক গল্প; দুটি গল্পেরই কাহিনি হজরত মুসা (আ.) কে নিয়ে। ‘আশ্রয়’ গল্পটিতে বর্ণিত হয়েছে হজরত মুসা (আ.) এর জন্ম থেকে শুরু করে ফেরাউনের রাজপ্রাসাদে তার স্থান পাওয়া ও সেখান থেকে বিয়ে পর্যন্ত জীবনের ঘটনা। অপর দিকে ’বিদ্রোহী’-র বর্ণনা ভঙ্গি চমকপ্রদ। হজরত মুসা (আ.) যখন ফেরাউনের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য বনী ইসরাইলকে নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন তখনকার কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে এখানে। আশার কথা হলো গল্পকার এখানে বর্ণনার জন্য প্রথাগত রীতি বেছে নেন নি, তিনি কাহিনিটি বর্ণনা করেছেন গদ্য কবিতার ঢঙে। কবিতা ও গল্প দুটি শিল্পমাধ্যমকে এক সাথে মেলাবার একটি প্রবণতা এখানে লক্ষ করা যায়। এ ধরনের রীতি যদিও খুব একটা নতুন নয় কিন্তু আসাদ বিন হাফিজ যখন তা ব্যবহার করেন তখন বলতেই হয় গল্পের শরীর নিয়ে ভাবার পরই গল্পকে বাস্তব রূপ দেন তিনি।
’জায়ন পাহাড়ের ডাক’ এক ফিলিস্তিনি সংগ্রামীর কাহিনি। ঘটনাপ্রবাহ কিভাবে রায়হানকে একজন মুজাহিদে পরিণত করল তার ইতিহাস লেখক এগল্পে বর্ণনা করেছেন। শুধু তাই নয়, রায়হানের মৃত্যুর পর তার ছেলে – মেয়েরাও যোগ দেয় মুক্তি সংগ্রামে । অত্যন্ত সাদামাটাভাবে এগিয়েছে গল্পের কাহিনি ও বর্ণনা রীতি, এবং শেষও হয়েছে সরলভাবে।
‘পনরই আগস্টের গল্প’ বা গ্রন্থের শিরোনামে যে-গল্পটি সেটির মূল চরিত্র অধ্যাপক আব্দুর রহমান। পুরো গল্পে বর্ণনা করা হয়েছে এই অধ্যাপকের মনস্তাত্বিক যন্ত্রণা। অনেক দিন আগে, যখন আব্দুর রহমানরা ছাত্র ছিলেন, যখন তাদের এক ছাত্র নেতাকে হত্যা করা হয়। গতরাতে হঠাৎ এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে তিনি আজ এসেছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই হত্যাকা-ের জায়গাটিতে । তারপর সেখানে তার যে শারীরিক-মানসিক অবস্থা সেটারই এক আবেগঘন বর্ণনা আলোচ্য গল্পটি । শেষে দেখা যায় , নিহত ছাত্র নেতার বিপ্লবী স্বপ্নকে সফল করে তোলার শপথ নিয়ে শেষ হয় গল্পটি।
‘ইয়াগো মিয়াগো’ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প হলো ’মিনা আপার বান্ধবী’। শিশুতোষ গল্পের দাবী অনুযায়ী এখানে সরাসরি আদর্শের কথা বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা শুনে পরিবারের ছোট ছেলে সহ বাকিরা তাদের ঈদের শপিং বাদ দিয়ে যেভাবে টাকা দুর্গত মানুষদের কাছে পোঁছে দেবার সংকল্প ব্যক্ত করে তা সত্যিই অনুপ্রেরণামূলক।
বইয়ের নাম শিরোনামের গল্পটিতে বর্ণনা করা হয়েছে মঙ্গলগ্রহে থেকে আসা দুই আগন্তুকের কাহিনি । তারা আসে তাদের দুই মানব বন্ধু মিতু আর মিঠুর কাছে। গল্পটির মধ্যে রহস্য ও রস দুটিই ছিল কিন্তু মিতু,মিঠু ও ইয়াগো, মিয়াগো যখন লঞ্চে করে দাদু বাড়ির পথে তখন লঞ্চে স্কুল শিক্ষকের অযাচিত উপদেশকে আরোপিত মনে হয়। ‘ওস্তাদজী ও কামেল জ্বীন’ সুন্দর রহস্যগল্প। ওস্তাদজীর জ্বীনদের দেশে ভ্রমণের কাহিনিকে লেখক খুবই বিশ্বস্ততার সাথে বর্ণনা করেছেন । শেষপর্যন্ত গল্পটি উপভোগ্য ও সার্থক। ‘অলৌকিক এক রাজার কাহিনী’ হজরত মুসা (আ.) এর কাহিনি। দুটি বইতে সর্বমোট তিনটি কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে একই নবীর। তাছাড়া এ গল্পে ‘পনেরই আগস্টের গল্প’ গ্রন্থের ‘আশ্রয়’ গল্পটির কিছু অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। এ গল্পটির শুরুটা আকর্ষণীয়।
‘খেয়ালী এক ঘুড়ির গল্প’ এর গল্প হলো নাটাই থেকে ছিড়ে গেলে ঘুড়ির কি দুর্দশা হয় তার কাহিনি। এ গল্পের মধ্যে উপগল্প হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে মেষ ও শেয়ালের কাহিনি, কিন্তু ঘুড়ির পরিণতির মতো শেষের পরিণতির কথা ‘মহাউল্লাসে শেয়ালের মামারা তখন আরামসে ভোজ দিল’ বাক্যের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়নি। বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করে বললে খুদে পাঠকরা বুঝতে পারত।
‘ভালবাসতে ইচ্ছে করে’ বইটির শেষে গল্প এবং আয়তনও খুব ছোট। শিশু মনের ভাবনা-চিন্তা নিয়ে গল্পটি। ভাবনা-চিন্তাও তেমন জটিল কিছু না, বাসার বাইরে বের হতে পারেনি জন্য অনেক কিছু ভাবছিল এক ছেলে। হঠাৎ বৃষ্টি আসে এবং বৃষ্টি বর্ষণটা ছেলেটির ভালো লেগে গেল। তখন তার খুবই ভালোবাসতে ইচ্ছে হলো যিনি বৃষ্টি দিলেন তাকে; অর্থাৎ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো একজন শিশু কিংবা কিশোর কি এমনভাবে চিন্তা করতে পারে? আসল বিষয় কিন্তু সেটা নয়; লেখকের উদ্দেশ্য হলো এই গল্পটির মাধ্যমে শিশু-কিশোর যেন বুঝতে পারে যে আল্লাহকেও আমাদের ভালোবাসতে হবে। ‘ইয়াগো মিয়াগো’ শিশুতোষ গল্পগ্রন্থে আসাদ বিন হাফিজ এ যোগ্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে, বাচ্চাদের উপযোগী সাহিত্য রচনা করার জন্য যে দক্ষতা থাকা দরকার তার ভেতরে সেটার কোনো অভাব নেই। বইটিতে যে-গল্পগুলো আছে তা পড়লে যে-কোনো বাচ্চারই আনন্দ পাওয়ার কথা।
নানা ধরনের লেখা লিখেছেন আসাদ বিন হাফিজ। কবিতা, গল্প, ছড়া, গান, ধারাবাহিক উপন্যাস, কাহিনিসহ গবেষণামূলক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। এত বিচিত্র মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কাজের ভারসাম্য লঙ্ঘিত হয়েছে।
ক.
ছড়া নয় ছড়া নয়
ছড়িয়ে দিলাম বিষ
ফারাক্কার তলে তলে
মাইন পুতে দিস।
এই ছড়ার জনপ্রিয়তা হলেন আসাদ বিন হাফিজ। অসাধারণ বক্তব্য, তুলনাহীন প্রকাশ ও ছন্দের দোলা। ছড়াটি এই আলোচক কোনো বই থেকে পড়েন নি, মুখে মুখে শুনেই এটি মুখস্থ হয়ে গেছে এবং জানা হয়েছে যে এটির লেখক হলেন আমাদের আলোচ্য সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। এরকম সময়জয়ী ছড়া যিনি রচনা করতে পারেন তিনি যে ছড়া সাহিত্যে অনবদ্য অবদান রাখতে পারবেন তাতে আর সন্দেহ করার কি আছে। তার ছড়া অন্য সব মাধ্যমকে পেছনে ফেলে তরতর করে সামনে আসন নিয়ে ফেলেছে; আর আসাদ বিন হাফিজও স্বয়ং যেন নিজ সত্তাকে ছড়া কেন্দ্রিকই করে ফেলেছেন এতদিনে।
তবে ছড়া বিষয়ক কিছু আশঙ্কা-চিন্তার কথাও এখানে প্রকাশ করা উচিত। দেখে গেছে সাহিত্যের একটি শাখা হিসেবে যদিও ছড়া দুর্দান্ত গতিশীল একটি মাধ্যম এবং তা খুব তাড়াতাড়ি পাঠককে আনন্দ দেয় কিন্তু সাহিত্যের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ছড়ার কোনো মূল্যায়ন নেই। সাহিত্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও একাডেমি ছড়াকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে আমলে নেন না। গুরুত্ব না দেবার কারণ হয়ত ছড়ার প্রকৃতির ভেতরেই লুকিয়ে আছে। চারিত্রের দিক থেকে ছড়া লঘু, তরল ও চটুল। উন্নত ভাবনা ও অভিজ্ঞতা প্রসূত জীবন নির্যাস ছড়া ধারন করতে পারে না, এমনকি এগুলো ছড়ার স্বভাবের সঙ্গেও ঠিক মেলে না। ফলে সাহিত্যের বনেদি মাধ্যম একে ভাবা হয় না এবং খুব একটা গুরুত্বও বর্তমানে দেওয়া হয় না; এই নিয়তিকে মেনে নিয়েই ছড়াকারকে ছড়া নিয়ে কাজ করতে হয়। অবশ্য একথাগুলো আরও কিছু মাধ্যমের জন্য প্রযোজ্য; যেমন: গোয়েন্দা, রোমান্স, সিরিজধর্মী দীর্ঘ কাহিনি প্রভৃতি। এগুলোর পাঠকপ্রিয়তা যথেষ্ট পরিমাণে থাকলে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য মাধ্যম হিসেবে এগুলোর তেমন কোনো মূল্য নেই। অন্য অনেক মাধ্যমে কাজ করার যথেষ্ট দক্ষতা দেখানোর পরও আসাদ বিন হাফিজ ছড়া নিয়ে যখন কাজ করতে চান (সাহিত্যবোদ্ধাদের দ্বারা ছড়ার অবমূল্যায়ন হবার পরও), তখন বুঝতে হবে, চিন্তা-ভাবনা করেই এ মাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন তিনি; তার এই নির্বাচন বলা চলে তার ব্যক্তিত্বের জন্য মানানসই হয়েছে।
ছড়াকারের বেশ কিছু ছড়ার বই বেরিয়েছে। ছড়াতেও তিনি অন্যান্য মাধ্যমের মতো গতানুগতিক পথেই যাত্রা করেছেন, লিখেছেন একেরপর এক প্রিয় পঙক্তি। তার অনেক ছড়ার ছন্দ, অন্ত্যমিল ও বক্তব্যের ব্যঞ্জনা লাভ করেছে নান্দনিক মাত্রা। সরাসরি বক্তব্য প্রকাশের তীর্যক মাধ্যম হলো ছড়া; এই ছড়াকার মাধ্যমটিকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগিয়ে যাচ্ছেন।
খ. ‘ভাষা-আন্দোলন: ডান-বাম রাজনীতি’ ও ‘ইসলামী সংস্কৃতি’ পুস্তক দুটিও এই লেখকের অনন্য সংযোজন। প্রথম বইতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে, যে-বর্ণনায় প্রাধান্য লাভ করেছে ভাষা আন্দোলনের মূল উপেক্ষিত বিষয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভাষা আন্দোলন যারা শুরু করেছিলেন, এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন তাদের বড় একটা অংশ ছিলেন ইসলামপন্থী; কি পরবর্তীতে যখন এ আন্দোলনের ইতিহাস লেখা হয়েছে তখন দেখা গেল আন্দোলনের আসল উদ্যোক্তারা ইতিহাসে একেবারে অবহেলিত। এর কারণ হলো এ সমস্ত ইতিহাস যারা লিখেছিলেন তাদের অধিকাংশ ছিলেন মার্ক্সবাদী বা ঐ মতাদর্শের প্রতি দুর্বল-মনা লোক। পরবর্তীতে অবশ্য মোস্তফা কামাল ও অন্যান্যদের চেষ্টায় এ বিস্মৃত অধ্যায় সামনে আসা শুরু করে। আসাদ বিন হাফিজের বইখানি ইতিহাসের উপেক্ষিত অধ্যায়কেই সামনে আনার প্রয়াস পেয়েছে। তবে বইটির প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে চিন্তার অপূর্ণতা ও পরিশ্রমের ঘাটতি। শিশুদের জন্যও তিনি সহজ-সরল ভাষায় ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বই লিখেছেন। শিশুদের উপযোগী করে ইসলামকে উপস্থাপন নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
গ. আসাদ বিন হাফিজের আরেকটি পরিচয় তিনি গীতিকার। শুধু তাই নয়, তার সম্পাদনায় বেরিয়েছে কয়েক খ- ইসলামী সংগীতের সংকলন; সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য এ কাজও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার ইসলামী সংগীত যতগুলো হাতে পাওয়া গেছে তাতে সেগুলোর বৈশিষ্ট্য সহজেই শনাক্ত করা যায়। সংগীতে তিনি প্রচলিত ধারাতেই কাজ করেন যে-সমস্ত বিষয় নিয়ে ইসলামী গান লেখা হয়েছে সেগুলো নিয়ে তিনিও লিখেছেন। এর বাইরে তার সংগীতের ভেতর অন্য কিছু খুঁজলে হতাশ হতে হবে।
ঘ. অনেক সিরিজধর্মী কাহিনিও লিখেছেন তিনি; অবশ্য সেগুলি অনুবাদ কাহিনি, অন্য কাহিনির ছায়া অবলম্বনে সিরিজ লিখে পাঠকদের আনন্দ দিয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের সিরিজ নাকি ব্যবসা সফল; তবে সাহিত্য সফলতা যে সেখানে নেই এতে কারো দ্বিমত পোষণ করার কথা নয়।
৫.
এতক্ষণের আলোচনা থেকে বোঝা গেল যে আসাদ বিন হাফিজের সাহিত্যকেন্দ্রিক তৎপরতার পরিধি অনেক বিস্তৃত। বহু মাধ্যমে কাজ করতে চান তিনি;কিন্তু একাধিক মাধ্যমে কাজ করার কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। একাধিক মাধ্যমে কাজ করলে শেষ পর্যন্ত এরকম হবার সম্ভাবনা থাকে যে, কোনো বিষয়ের ওপরেই ঠিকমত হক আদায় করা যায় না, এবং কোনো বিষয়ই লেখকের পুরো মনোযোগ নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। তাই নিজের কাজকে দৃঢ? ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাইলে, সকল মাধ্যমেই প্রচুর সৃষ্টি ফসল ফলাতে হবে; তারপরেও এর ফলাফল কেমন হবে হঠাৎ করে তা বলা কঠিন। হয়ত কিছু প্রবণতা সমকালেও সমালোচকরা নির্ণয় করতে পারেন, কি একেবারে শেষ কথা বলা সত্যিই অসাধ্য কাজ। সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা দুটোকে সামনে রেখেই আসাদ বিন হাফিজের কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। এ পর্যায়ে আমরা দেখি তার সৃজনশীল কাজের সংখ্যা খুবই কম, কবিতা ও গল্পগ্রন্থের সংখ্যা হাতে গোনা। সেই তুলনায় তিনি কাজ করেছেন ছড়া ও সিরিজ কাহিনিতে বেশি। ছড়াকে সাহিত্যকর্ম হিসেবে মেনে নেওয়া গেলেও তার নামে ছাপা হওয়া সিরিজ কাহিনিকে কেউই সাহিত্যকর্মের তালিকায় স্থান দেবেন না। সূত্র:http://alislahbd.com/news-details.php?article_id=185|