বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৬ পূর্বাহ্ন

আজ ভয়াল ১৫ নভেম্বর ‘মোরা ভাত চাই না ত্রাণ চাই না, চাই একটা টেকসই বেড়িবাঁধ’

এনামুল হক কলাপাড়া
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২২

‘মোগো গ্রামে কোনও বাঁধ নাই রাবনাবাঁধ ও আন্দারমানিক নদী হগোল (সব) বাঁধ গিল্লা খাইয়া হালাইছে। এহোন ভাঙা বাঁধ দিয়া জোবার (জোয়ার) পানি ঢুইক্যা মোগো গ্রামের ঘর-দুয়ার জায়গা-জমি মাঠ-ঘাট হগোল পানিতে তলাইয়া যায়। মোরা ভাত চাই না ত্রাণ চাই না, চাই একটা টেকসই বেড়িবাঁধ’। এ কথাগুলো বলছিলেন পটুয়াখালী জেলার উপকূলীয় উপজেলা কলাপাড়া বেড়িবাঁধ বিহীন ধানখালী ও লালুয়া এলাকার ভুক্তভোগীরা। সব চেয়ে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া, মুন্সীপাড়া, হাসনাপাড়া, ছোট পাঁচ নম্বর, বড় পাঁচ নম্বর, মঞ্জপাড়া, চান্দুপাড়া, কালাউপাড়া, এগারো নম্বর, ধনজুপাড়া, বানাতিপাড়া, চাড়িপাড়া ও মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর, সুধীরপুর, কমরপুর ও নজীবপুর এবং ধানখালী দেরপুর এলাকা গুলোতেও। এ দু’টি ইউনিয়নের মধ্যে লালুয়া ইউনিয়নের প্রায় সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ইতোমধ্যে রামনাবাদ নদী গিলে ফেলেছে এবং মহিপুর এলাকার নিজামপুর থেকে কমরপুর পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার ও ধানখালী দেবপুর দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। এসব এলাকার ভুক্তভোগীরাও একি দাবি ‘মোরা ভাত চাই না ত্রাণ চাইনা, চাই একটা টেকসই বেড়িবাঁধ’। পানি উন্নয়ন বোর্ড পটুয়াখালী ও কলাপাড়া দপ্তর সূত্রে জানা যায়, পটুয়াখালী জেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ রয়েছে ১ হাজার ৩৩৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাউবোর পটুয়াখালী সার্কেলের অধীনে ৮২২ কিলোমিটার এবং কলাপাড়া সার্কেলের অধীনে রয়েছে রয়েছে ৫১৩ কিলোমিটার। এসব বেড়িবাঁধের মধ্যে পাউবোর কলাপাড়া সার্কেলের অধীনে জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার চালিতাবুনিয়ায় প্রায় চার কিলোমিটার চর। আন্ডায় চার কিলোমিটার কলাপাড়ার লালুয়ায় সাত কিলোমিটারসহ ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত রয়েছে। এছাড়া কলাপাড়ার মহিপুরের নিজামপুর, সুধীরপুর, কমরপুর ও নজীবপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ৮ কিলোমিটার, ধানখালী দেবপুর দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। আজ ১৫ নভেম্বর সিডর তান্ডবের ১৫ বছর হচ্ছে। ঠিক ১৫ বছর আগে আজকের এই কালো রাত্রিতে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩ শ’ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে আঘাত হেনেছিল। সন্ধ্যা ৬টার দমকা হাওয়ার সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল। আবহাওয়া অফিস ৫ নম্বর বিপদসঙ্কেতের পর ৮ নম্বর মহা বিপদসঙ্কেত দিলেও উপকূলীয় এলাকার অনেকেই বুঝতে পারেননি এভাবে লন্ডভন্ড হয়ে যাবে সবকিছু। রাত ১১টায় প্রচন্ড বেগে আঘাত হানে কলাপাড়া উপজেলায়। মাত্র কয়েক মিনিটে ১০ থেকে ১২ ফুট সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে প্লাাবিত হয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। নিমেষেই উড়ে যায় ঘরবাড়ি, গাছ-পালা। মাটির সাথে মিশে যায় বহু স্থাপনা, রাস্তা ঘাট, পশু-পাখি ও জীবজন্তু। বিধ্বস্ত হয় বেড়িবাঁধ।
আহত হয় হাজার হাজার মানুষ। প্রাণ হারায় উপজেলার ৯৪ জন মানুষ। সেই অভাবনীয় দুর্ভোগের রাতে অনেকের সাজানো সংসার চিরতরে হারিয়ে যায়। ভেঙে যায় অনেকের লালিত স্বপ্ন। প্রকৃতি যে মানুষের ওপর এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কোনো দিন ওই স্মৃতির কথা ভুলতে পারবে না উপকূলীয় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত হাজারো মানুষ। এই রাতে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াল সামুদ্রিক জলো”ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় অঞ্চল লন্ডভন্ড করে দেয়। উপকূলীয় অঞ্চলের শত শত মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। মারা যায় হাজার হাজার গবাদি পশু। আগের দিনও যে জনপদ ছিল মানুষের কোলাহলে মুখরিত, মাঠজুড়ে ছিল কাঁচা-পাকা সোনালি ধানের সমারোহ, পরের দিনই সেই চিরচেনা জনপদ পালটে যায়। এ দিন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপে সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। নি¤œচাপটি কয়েকবার গতি পরিবর্তন করে মধ্যরাতে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। রাতে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা উপকূলীয় অঞ্চলে। সিডর আঘাত হানার পর ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্তরা বাঁধের যথাযথ সংস্কার কিংবা পুনর্র্নিমাণ না হওয়ায় সাগর পাড়ের বাসিন্দাদের আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভয়াবহ সুপার সাইক্লোন সিডরে এ উপজেলায় ৯৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় এক হাজার ৭৮ জন। সেই ঘটনার জের ধরে আজো নিখোঁজ রয়েছেন ৮ জেলে। স্বজন হারাদের কাছে তাদের খোঁজ খবর নিতে গেলে তারা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। উপজেলার এই তিনটি ইউনিয়নে সিডরের সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেড়িবাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, বিধ্বস্ত এসব বেড়িবাঁধের মধ্যে জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের সাত কিলোমিটার রয়েছে পায়রা সমুদ্র বন্দরের অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে। তাই বিধ্বস্ত ওই সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ মেরামত বা সংস্কার করবে। ওখানের বেড়িবাঁধ মেরামত বা সংস্কারের কোনও পরিকল্পনা নেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কিন্তু লালুয়ায় পায়রা সমুদ্র বন্দরের অধিগ্রহনকৃত ভূমি এলাকায় বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ এখন পর্যন্ত সংস্কার বা মেরামত করেনি পাউবো কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিনেও এসব বেড়িবাঁধ মেরামত বা সংস্কার না হওয়ায় অরক্ষিত রয়েছে উপকূলীয় পটুয়াখালী উপজেলায় প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ। অভিযোগ রয়েছে কোথাও কোথাও বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত বা সংস্কার হলেও কাজের মান ছিল নি¤œমানের। যার ফলে সংস্কারের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওই সংস্কারকৃত বেড়িবাঁধ জোয়ারের পানির তোড়ে ফের বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এতে চলতি বছরে কয়েক দফা জোয়ারের পানি বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে লোকালয়ের মধ্যে প্রবেশ করায় মানুষের ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি তলিয়ে যায়। আবার কখনো ঝড়-জলোচ্ছাসে এইসব অরক্ষিত এলাকার মানুষের জানমাল ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এনিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত পটুয়াখালীর উপকূল জনপদের মানুষজন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার বিধ্বস্ত উপকূলীয় উপজেলা কলাপাড়া অসংখ্য পরিবার এভাবেই বসবাস করছে বেড়িবাঁধের ওপর। সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণী, বুলবুল, আম্পান, ইয়াস জাওয়াদ, কোমেন, মোরা, আম্ফান, অশনি, সিত্রাং আঘাতের তান্ডবে নিঃস্ব হয়েছে বহু পরিবার। কারও জমি চলে গেছে নদীতে, নোনা পানিতে ভেসে গেছে কারও বাড়িঘর। দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আগেই আবার নদীর বাঁধ ভেঙে নোনা পানিতে নষ্ট হয়ে যায় আসবাব-ঘরবাড়ি, সম্পদসহ জমির ফসল। বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে লালুয়া চাড়িপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর চরে সারি সারি মৃত গাছ আর ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সামনে ভিটাবাড়ি রাবনাবাঁধ বিলীন হয়ে যেতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে অনেকে। দিশেহারা হয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে তারা। খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে। ভাঙন অব্যাহত থাকায় আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটা”েছ নদী তীরবর্তী বসবাসকারী মানুষ। লালুয়া ইউনিয়ন ঘুরে দুর্গত ও নিঃস্ব মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের বর্তমান করুণ অব¯’ায় মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয় টুকু। নিঃস্ব হতে হতে এই গ্রামের মানুষের শেষ সম্বল নিয়ে এখন শুধুই বেঁচে থাকার আকুতি। প্রতিদিনই ভাঙছে নতুন করে একেকটি পরিবারের স্বপ্ন। এখানে প্রতিটি ভোর হয় একেকটি পরিবারের সর্বস্ব হারানোর খবর শুনে। চারিপাড়া বাঁধ প্রতিদিনই ভাঙছে। আর নিঃস্ব হচ্ছে বাঁধে আশ্রয় নেয়া পরিবার গুলো। চারিপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেড়িবাঁধের বাইরে, বাঁধের ওপরে এবং বাঁধের ভেতরে অসংখ্য বাড়িঘর। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এসব মানুষের এটাই যেন নিয়তি। অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয়নি বলে তাঁরা এখনো এখানেই পড়ে আছেন। লালুয়ার ইউপি চেয়ারম্যান মো. শওকত হোসেন তপন বিশ্বাস বলেন, আমার ইউনিয়নের সাত কিলোমিটার বেড়িবাঁধই নেই। এক কথায় বলা যায় পুরো ইউনিয়নটিই এখন অরক্ষিত অব¯’ায় রয়েছে। এই বেড়িবাঁধ সংস্কার ও পুনর্র্নিমাণের জন্য কত বার যে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিয়েছি তা গুনে হিসাব দিতে পারবো না। তারপরও বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ করা হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ হোসেন জানান, লালুয়ার ইউনিয়নে ছয় কিলোমিটার ভাঙা বেরিবাঁধ পুনর্র্নিমাণের কাজ পায়রা সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষ শীতের সময় শুরু করবে। টেন্ডার হয়ে গেছে। এখন শুধু কাজ করায় অপেক্ষা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরুরি কাজ চলমান রয়েছে বলে তিনি জানান।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com