করিম ভালো ছেলে। এ বাক্যের মানে কি সবার কাছে একেবারে স্পষ্ট হল? ‘ভালো’ শব্দটি করিম সম্পর্কে অবজেক্টিভ কোনো তথ্য দেয় আসলে? এ শব্দটি দিয়ে আমরা কি সবাই করিমের একই গুণগুলো বুঝি? বুঝি না। এই যে সব মানুষকে অবজেক্টিভলি কোনো বক্তব্য বোঝাতে না পারা, এটা কিন্তু বক্তার দোষ নয়। আসলে পৃথিবীতে অবজেক্টিভ কোনো ভাষা নেই; ভাষামাত্রই সাবজেক্টিভ। কোনো মানুষ যখন কোনো শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করে, সেটা একেকজনের মনে একেক রকম ইমেজ তৈরি করে। একটা অতি আলোচিত শব্দ নিয়ে কথা বলার জন্য এ গৌরচন্দ্রিকা। শব্দটি হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। বর্তমান সরকারের শাসনামলে এ শব্দটি অতীতের সব সরকারের চেয়ে অনেক বেশি শোনা যায়। মজার ব্যাপার- এ শব্দটি একটা বিশেষ শ্রেণির শাসকের মুখে শোনা যায়, সেই রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে। তখনকার সেই রোমান সম্রাট আর এখনকার বাংলাদেশের সরকার যে পরিস্থিতিতে এ শব্দটি অতি ব্যবহার করে, সেটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একই আছে। ‘উন্নয়ন’ শব্দটির মানে কি সবার কাছে একই? নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু মানুষ যেহেতু উন্নয়ন বলতে বিভিন্ন কিছু বুঝে ফেলতে পারে সেজন্য বর্তমান সরকার উন্নয়ন বলতে কী বোঝাতে চায়, সেটি ভীষণ জোরেশোরে প্রচার করে। এ শব্দটিতে একধরনের অবজেক্টিভিটি আরোপের চেষ্টা করে সরকার। তারা বোঝাতে চায় অবকাঠামোর উন্নয়ন মানেই উন্নয়ন। যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে বলে সরকার সব সময় দাবি করে। এ উন্নয়নকেই তার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান যুক্তি হিসেবে নাগরিকদের সামনে হাজির করে। কিন্তু উন্নয়ন বলতে আমি শুধু সেটাকে বুঝি না। বোঝে না একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর অসংখ্য সচেতন মানুষ। উন্নয়ন বলতে কী বোঝানো হয়, সেই জানা-বোঝা আমাদের জন্য ভীষণ জরুরি। সেটি নিয়ে আসছি কলামের শেষ অংশে। এক দশক ধরে এ দেশের পত্রিকায় খবর এসেছে এ অঞ্চলের ব্যয়ের ৪-৫ গুণ ব্যয়ে নানা যোগাযোগ অবকাঠামো যেমন মহাসড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, রেলপথ তৈরি হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় এ পৃথিবীতেই সর্বোচ্চ। একই কথা প্রযোজ্য বিদ্যুতের অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে। এতে অনেক বেশি খরচে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি আছে সরকারের কিছু ক্রনিকে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নামে সীমাহীন আর্থিক সুবিধা দেয়া। এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির খুব বড় অভিযোগ ছিল সব সময়, সেটারই পরোক্ষ একটা প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহন এবং পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন- এ তিন ধরনের অবকাঠামো পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক মানের ধারে-কাছেও নেই। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ ২৯টি দেশের সড়কের মানের কথা বলা হয়েছে। এতে দেখা যায়, নেপাল ও মঙ্গোলিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশের সড়কের মান ভালো নয়। সড়কের মান সংক্রান্ত ৭ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ৩ পয়েন্টের কিছু বেশি। বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, দুর্বল মান ও অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় তুলনামূলক বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। এখানে প্রতিবছর ১ লাখ লোক মারা গেলে ১৫ জনই মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। এ হার এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি। বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে কত সময় লাগে, সেটি বিবেচনায় বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে জানা যায়, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়, অর্থাৎ ২৮তম স্থানে (সময় লাগে ১২৫ দিন)। বাংলাদেশের নিচে আছে শুধু কম্বোডিয়া।
অথচ সরকার দাবি করে বাংলাদেশে এখন চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। ওদিকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণে সিস্টেম লস হিসেবে ১১ শতাংশই হারিয়ে যায়। আমাদের চেয়ে বেশি সিস্টেম লস আছে শুধু আফগানিস্তানে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশ পল্লী এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে খুব পিছিয়ে। এ দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির আনুপাতিক হারও বেশ কম। এ দেশে বিদ্যুতের দামও তুলনামূলক বেশি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৮ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রেও আমাদের অবস্থান ২৯টি দেশের মধ্যে ২৮তম। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাইপের মাধ্যমে নাগরিকদের পানি সরবরাহ করে থাকে প্রায় সব দেশ; কিন্তু বাংলাদেশের মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষ এ সুবিধা পান। পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবার শেষে। আবার ঢাকার নাগরিকদের পাকিস্তানের করাচি, শ্রীলংকার কলম্বো, এমনকি ব্রুনেই দারুসসালামের মতো ধনী দেশের নাগরিকদের চেয়েও বেশি দামে পানি কিনে খেতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটানেই বাংলাদেশের তুলনায় পানি সরবরাহের খরচ বেশি। আমরা দীর্ঘকাল থেকে দেখে আসছি এ দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা- কল্যাণমূলক খাতগুলোয় অতি অপ্রতুল বরাদ্দ দিয়ে সরকার সেই টাকায় নানা অবকাঠামো উন্নয়ন করার চেষ্টা করছে। কল্যাণ খাতগুলোয় মোট বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ৫ শতাংশেরও কম। অথচ শুধু স্বাস্থ্য খাতেই এ বরাদ্দ হওয়ার কথা। কল্যাণ খাতে খরচ না বাড়িয়ে, জনগণকে সত্যিকার অর্থে ভালো না রেখে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পেছনে অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা ঢালা হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, এতগুণ খরচ করেও মানসম্মত কোনো কাজ আমাদের দেশে হয়নি; হলে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মানদ- তলানিতে পড়ে থাকতাম না। বিশ্বব্যাংকের এ রিপোর্ট খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হওয়া টাকার একটা বড় অংশ আসলে দুর্নীতিতেই হারিয়ে গেছে। দেশের মিডিয়া, দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা এবং নাগরিকরা প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছে সব সময়, সেগুলো আসলে শুধু সমালোচনার খাতিরে সমালোচনা ছিল না।
শুধু অবকাঠামো উন্নয়নকেই সরকার উন্নয়ন হিসেবে জনগণের সামনে হাজির করে; কারণ, দীর্ঘকাল এ অঞ্চলে উন্নয়ন বলতে এটাকেই বোঝানো হয়েছে। আইয়ুব খানের উন্নয়নের দশক এবং তার করা ‘উন্নয়নের’ কথা এখনও কিছু প্রবীণ মানুষের মুখে শোনা যায়। শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, অবকাঠামো নির্মাণ মানেই উন্নয়ন নয়- এ কথাগুলো খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তার লিখিত অত্যন্ত আলোচিত বই ‘ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডমে’ তিনি উন্নয়ন বলতে পাঁচটি ক্ষেত্রের নানা উপাদানের একত্রে থাকাকে বুঝিয়েছেন। এগুলো হল-১. রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার- বাকস্বাধীনতা, মুক্ত মিডিয়া, সভা-সমাবেশের অধিকার, প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা চাওয়ার অধিকার ইত্যাদি। ২. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা- মুক্ত শ্রমবাজার, সমান সুযোগপ্রাপ্তি, ব্যবসায় নৈতিকতা, কর্মক্ষেত্রে নারীদের মুক্ত অংশগ্রহণ ইত্যাদি। ৩. সামাজিক সুযোগ-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা, লৈঙ্গিক সমতা, নারীদের সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি। ৪. স্বচ্ছতা, নিশ্চয়তা-দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়া, ন্যায়বিচার পাওয়া, বিপদে পুলিশের সহায়তা পাওয়া ইত্যাদি। ৫. নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা- জরুরি সাহায্য, আশ্রয়, সামাজিক নিরাপত্তামূলক ভাতা ইত্যাদি।
সময় পাল্টে গেছে অনেক আগেই; কিন্তু আমরা পাল্টাইনি। উন্নয়ন নিয়ে আমরা আমাদের জানা-বোঝাকে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারিনি। আর দেরি না করে নাগরিকদের উচিত উন্নয়ন কাকে বলে সেই ব্যাপারে সচেতন হওয়া। তাহলে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর পক্ষে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে যাচ্ছেতাই করা সম্ভব হবে না।
লেখক: ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট