‘কবর তো ইহকাল-পরকালের মাঝে একটা পর্দা মাত্র
অনন্ত আশীর্বাদের ফোয়ারা।
তোমরা অবতরণ দেখেছ এবার চেয়ে দেখ আমার আরোহণ।
চন্দ্র-সূর্যের অস্তাগমন কি বিপজ্জনক?
তোমাদের কাছে যেটা অস্তাগমন, আসলে সেটাই উদয়ন।’
কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী। এমন সাহসী আর প্রেমময় উচ্চারণের পর আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে চলে গেছেন এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু তার রাজত্ব আজও শেষ হয়নি। শিল্প সাহিত্য প্রেমী মানুষের মনের রাজেত্বে তার রাজার আসীন প্রতিদিন উজ্জ্বল হচ্ছে। ভোগবাদী পাশ্চাত্য দুনিয়ার মানুষের ভোগের নেশা কেটে যাচ্ছে তার কবিতা আর গানের ছন্দে। তাদের অন্তর আত্মা শান্তির আশায় নেশার পেয়ালা ছেড়ে এ বিশ্বজগতের মহান ¯্রষ্টার সান্নিধ্য প্রত্যাশী। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী তার কবিতায় যে দিগদর্শন উপস্থাপন করেছেন তা নিয়ে তাদের গবেষণার অন্ত নেই। তার লেখা কোন কবিতার বই ইংরেজি অনুবাদ হয়ে বাজারে আসলেই বেস্ট সেলার, গীতি কবিতার অ্যালবাম কিনতে বিশাল লাইন পড়ে যায় দোকানের সামনে।
ইন্টারনেট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি কবিদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ও পঠিত। ফারসি ভাষাভাষীদের গবেষকেরা জালালউদ্দিন রুমিকে তাদের সবচেয়ে বড় কবি হিসেবে স্বীকার করেন। পশ্চিমা বিশ্বে তার জনপ্রিয়তার কারণ তার কবিতা। তিনি তার কবিতার মাধ্যমে যে বার্তা তুলে ধরেছেন তা তার ভাষার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে ভাব প্রকাশের তুঙ্গে উঠেছে। তিনি তার কাব্যে অনেক নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ দর্শন প্রকাশ করেছেন যা নিছক ফারসি ভাষা বা সংস্কৃতির বিষয় নয়, বরং মানবজাতির আত্মার রহস্যের বিষয়। কাব্য-সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি গদ্যও রচনা করেছেন। তবে তার গদ্য অপেক্ষা পদ্য বা কবিতা বেশি সমাদৃত। সাহিত্যের সামগ্রিক বিচারে রুমির মাহাত্ম্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি তার সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করেছেন পবিত্র কোরআন ও হাদীস থেকে। ইসলামকে তিনি উপলদ্ধি করেছেন অন্তর দিয়ে। মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া মানব জাতির মুক্তি নেই। এ সত্য তিনি সুন্দর ভাবে কাব্য রসে সিক্ত করে শৈল্পিক সুষমায় পরিপুষ্ট করে উপস্থাপন করেছেন। তার প্রতিটি শব্দ মানুষকে মনকে পবিত্রতা ও সৌন্দর্য দান করে। মানব সন্তান সীমাহীন স্বাধীনতা ও অফুরন্ত স্বর্গীয় মহিমা নিয়ে জন্মলাভ করেছে। এ দু’টি পাওয়া তাদের জন্মগত অধিকার। তবে এ মহামূল্যবান দু’টি জিনিস পেতে হলে তাদের অবশ্যই ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। কেউ হয়তো বা প্রশ্ন করতে পারেন এর মধ্যে নতুন কী আছে? দুনিয়ার সকল মহাপুরুষই তো এ কথা বলে গেছেন। রুমির মাহাত্ম্য এখানেই নিহিত যে, তিনি অত্যন্ত সরাসরি দৈনন্দিন জীবনাচরণ থেকে উদাহরণ টেনে মহাসত্যকে জীবন্তভাবে উপস্থাপন করছেন দক্ষতার সাথে। উন্মোচন করেছেন মানবাত্মার রহস্য।
আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে পারস্য সা¤্রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। এর বিস্তৃত ছিল বিশাল ভূখ-জুড়ে। আফগানিস্তান, ইরাক, তুরস্ক এবং উত্তর ভারতের কিছু অঞ্চল পারস্যের সাথে একীভূত ছিল। ইসলামের দ্রুত প্রসারের ফলে পারস্য ইসলামী জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা দেখা যায়, পৃথিবীর জ্ঞানী গুণীদের একটি বড় অংশের জন্ম হয়েছে এ অঞ্চলে। ইবরাহীম আদহাম, শাকীক বালখী, ফাজেল ইবনে আয়াজ, বায়েজীদ বোস্তামী, হুসাইন, ইবনে মনসুর হাললাজ, আবু আলী ইবনে সিনা, আবু নাসর শিরাজ তুসী, উসমান হিজভিরী গাজনাভী, ইমাম আবু হামেদ গাজ্জালী তুসী, আবদুর কাদের জিলানী, শেখ ফরিদউদ্দীন আত্তার নিশাবুরী, মাওলানা জালালউদ্দীন রুমী, খাজা হাফেজ শিরাজী, আবদুর রহমান জামী প্রমুখ অন্যতম। তারা রচনা, কর্ম-পদ্ধতির মধ্যদিয়ে আজো বেঁচে আছেন। এই মহা মনীষীদেরই একজন ফারসি কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী। তার লেখা মসনবী শরীফ আজও বিশ্ব জুড়ে আলোচিত ও পঠিত একটি কাব্যগ্রন্থ। তার বয়স যখন পাঁচ, তখন তাকে দেখে শায়খ ফরিদউদ্দীন আত্তার যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই বালক বিশ্বকে একদিন আলোকিত করবে।
জালালউদ্দিন রুমি ১২০৭(মতান্তরে ১২০৪) খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান আফগানিস্তানের বালাখে জন্মগ্রহণ করেন। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো (UNESCO) তার সম্মানে ২০০৭ সালকে International Rumi year বা মাওলানা জালালউদ্দীন রুমীর বছর নামে আখ্যায়িত ঘোষণা করেছিল । বিশ্ব ২০০৭ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে মাওলানা রুমীর ৮০০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর পিতা বাহা ওয়ালাদ ছিলেন সর্বজনবিদিত প-িত ও সুফি। তিনি একজন সুলেখক ছিলেন। তিনি বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর ভালোবাসা লাভের উপায় নিয়ে অনেক মূল্যবান লেখা তিনি লিখেছেন। মোঙ্গলদের আসন্ন আক্রমণের সময় ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় থাকাকে নিরাপদ মনে না করায় তিনি ১২২০ সালের দিকে তার পরিবারকে আনাতলিয়ায় সরিয়ে নেন। বর্তমান তুরস্কের কনিয়ায় তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আলেম হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। তিনি সেখানকার মানুষকে ইসলামের নানান গুরুত্ব পূর্ণ দিক এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায় নিয়ে সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। ১২৩১ সালে মৃত্যুর পর তার পুত্র জালালউদ্দিন পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। এর অনেক আগেই জালালউদ্দিন স্বনামধন্য অধ্যাপক ও ধর্মপ্রচারক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি আইন ও ধর্মতাত্ত্বিক বিজ্ঞানকে এক সূত্রে গ্রোথিত করেছিলেন এবং সুফিবাদকে আরো বেশি আধ্যাত্মিক মাত্রা দিয়েছিলেন। তবে তখনো তিনি কবিতা রচনা করেননি। রুমির জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ১২৪৪ সালে, অর্থাৎ তার বয়স যখন ৪০ বছর। এ বছর তিনি কনিয়ায় একজন অতি আশ্চর্যজনক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন। তার নাম শামস আল-দীন তাবরিজ বা শামস-ই তাবরিজ। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হয়। শামস রুমিকে আধ্যাত্মিকতার বিষয়ে এমন উন্নত ধারণা দেন যা তিনি ইত:পূর্বে কল্পনাও করতে পারেননি। হঠাৎ করে এক দিন শামস নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শামস নিহত হয়েছেন বলে গুজব শোনা গেলেও রুমি নিজে তা বিশ্বাস করতেন না। শামসের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরই রুমির কলম দিয়ে ঝরনা ধারার মতো কবিতা বেরোতে থাকে। রুমি অবশ্য তার অনেক লেখার মাধ্যমে এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
রুমীর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল আশাবাদ (Optimism)| মানুষ বিরহ বেদনা, দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও বেঁচে থাকবে- কোন হতাশ নৈরাশ্য নয়। তিনি গদ্য ও পদ্যাকারে একাধিক রচনা রেখে গিয়েছেন। তন্মধ্যে ‘দীওয়ান’, ‘মাসনভীয়ে মা’নাভী’, ‘মাকাতীব’, ‘মাজালীশ’ এবং ‘ফীহে মা ফীহে’ উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো মাসনভীয়ে মা’নাভী। এটি বিশ্বে সূফী গ্রন্থ হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। ইসলামী সাহিত্যের ভা-ারে এরূপ গ্রন্থের অস্তিত্ব দ্বিতীয়টি নেই। মাওলানা রুমী বলেন, ‘মাসনভী গ্রন্থ রহস্য উদঘাটনে ধর্মের মূলনীতিসমূহের শিকড়। এটি মহান প্রভুর সর্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট দলিল।’ (মাসনভীঃ মুকাদ্দমা) এই মাসনভী শরীফ বিশাল জ্ঞান-ভা-ারে পরিপূর্ণ। এই জ্ঞান-ভা-ার থেকে প্রত্যেকে জ্ঞানের পরিধি অনুসারে লাভবান হতে সক্ষম। অসংখ্য বাস্তব কল্প-কাহিনী, উপকথা, নীতি-গল্প কাহিনীর মাধ্যমে তরীকত, হাক্কীকত এবং মারেফাতের গূঢ় রহস্য উন্মোচন, আল্লাহর মহব্বত, কামেল পীরের পরিচয়, পরলৌকিক সুখ-শান্তি লাভের উপায় এবং আল্লাহর অস্তিত্ব বিষয়ের বর্ণনা এই মাসনভীতে রয়েছে। কাব্য-রসিক পাঠক সাধারণ এবং কোরআন মজিদের সারমর্ম অনুধাবনে আগ্রহী সকল শ্রেণীর মানুষের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেই মাসনভী শরীফ আখ্যায়িত হয়েছে মরমী কাব্যরূপে। এই কাব্যগ্রন্থটি বাংলাদেশে সমধিক পরিচিত। ফরাসি ভাষার এই কাব্যটির প্রভাব বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে বিদ্যমান। বর্তমান সর্বাধিক প্রচলিত ১৫টি ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
বাংলা-ভাষাভাষী মুসলমানদের নিকট নতুন করে মাসনভীর পরিচয় দানের বিষয়টি আবশ্যক নয়। কেননা এদেশে ইসলাম প্রচারের সাথে ফারসি ভাষার মাসনভী গ্রন্থটি ওতপ্রোত। ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের মতে সূফীরা ইসলাম প্রচারের সময় মাসনভীকে এদেশে জনপ্রিয় করে তুলতে সচেষ্ট হন। এর প্রমাণ ষোড়শ শতাব্দীর কবি জয়ানন্দ রচিত ‘চৈতন্য-মঙ্গল’ কাব্য। তিনি বলেন, ‘মসনভী আবৃত্তি করে থাকে নলবনে। মহাপাপী জাগাই মাধাই দুই জনে।’ এ কবিতার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয়ই এ গ্রন্থটি পাঠ করতেন। মাসনবীর প্রসঙ্গে আব্দুর রহমান জামী (১৪১৪-১৪৯২) বলেন, ‘মাসনভীয়ে মৌলাবীয়ে মা’নাবী। হাস্ত কোরআন দর যাবানে পাহলবী । অর্থাৎ, মৌলাবীর মসনভী তত্ত্বগরীয়ান। পহলভী ভাষায় এই অমর কোরান । (অনুবাদক মুহাম্মদ এনামুল হক) এখানে কোরআন অর্থ অবশ্য পাঠ্যগ্রন্থ । আত্মার সৌন্দর্যে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। যে আত্মায় প্রেম নেই সে আত্মা মৃত। আত্মাময় মানুষের জন্য প্রয়োজন আত্মোদ্?ভাসিত বাণী। সেই অমীয় বাণী গভীর আধ্যাত্মিক তত্ত্বপূর্ণ গ্রন্থ মাসনভী।
তুমি ভাবতেই পারবেনা-
কতোটা কঠিন কষ্টে খুঁজেছি- একটি অনন্য কোন উপহার
তুলে দিতে, মুগ্ধ তোমার হাতে।
শেষে -যোগ্য মনে হয়নি কোনটাই-
বুঝিনি কি লাভ হবে- বয়ে নিয়ে স্বর্ণের ফোঁটা, অতোটা দীর্ঘ এক স্বর্ণখনিতে?
বুঝিনি জলের ফোঁটা- কতো আর পারবে অমন- সুগভীর এক সমুদ্র ভরাতে !
যা কিছু সঙ্গে নিয়ে শেষে-তোমার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম,
আসলে তা ছিল
‘সব পূর্ণতা’র কাছে দাঁড়িয়ে এতোটুকু ‘পূর্ণ করার অপচেষ্টা’ শুধুআমার!
আসলে তোমার ‘সব আছে’ , ‘সব একাই নিয়ে আছো’ বলে-
লক্ষ-হাজার-জন্ম-জন্মান্তর এতোটা দেবার পরেও
শূন্য এ অন্তর ও আত্মায়
খুঁজে নিতে পারিনা- তোমায়
এতোটুকু ‘দিতে পারা’র মতো পরিতৃপ্তির কোন আস্বাদ।
অবশেষে তাই-
বিপুল ব্যর্থ হয়ে-
শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে তুলে ধরি এক আয়না তোমার দিকে
বলি – ‘দেখ তোমাকেই, আর
অপার করুনা দিয়ে মনে রাখো-
নিঃস আমাকে এই- অনাদি, অনন্তকাল’।
রুমি ৩ হাজার গজল ( প্রেমের গান) রচনা করেছেন। আর এসব গজলের অনেকগুলোর সাথেই শামসের নাম বিজড়িত। শামসের জন্য উৎসর্গীকৃত তার দিওয়ান-ই শামস-ই তাবরিজ হচ্ছে গজল ও বিভিন্ন শ্লোাকের সমাহার, যার মধ্যে রয়েছে ৪০ হাজার পংক্তি। ২৫ হাজার শ্লোক নিয়ে রচিত তার সঙ্কলনের নাম মসনবি। মসনবি হচ্ছে শিক্ষামূলক নীতিবাক্যের সমাহার। এবং মানুষকে নীতিবোধে উজ্জীবিত করাই এর একমাত্র লক্ষ্য। Literary History of the Arabs গ্রন্থের বিখ্যঠু লেখক R A Nicholson (১৮৬৮-১৯৪৫) মসনবির পুরোটাই ইংরেজিতে অনুবাদ করে ইংরেজি ভাষাভাষীদের কাছে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমিকে একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে তুলে ধরেছেন। রুমি বিশারদ নাদের খলিল তার ‘সুফি পাথ টু লাভ’ গ্রন্থে ৭৫টি গজল ও বিক্ষিপ্তভাবে ১ হাজার শ্লোক অনুবাদ করেছেন।
রুমি বিশ্বাস করেন, সৌন্দর্য মানব মনের চিরন্তন কাম্য। কেননা আল্লাহ নিজেই সুন্দর এবং তিনি সব সৌন্দর্যের উৎস। আর মানবাত্মার প্রকৃত চাহিদা হচ্ছে খোদ আল্লাহর সান্নিধ্য। R A Nicholson, Arther John Arbery, William C Chittick, Ancara UniversityÔs History of Religions-Gi Professor Annemarie Schimmel এবং আমেরিকার শৌখিন রুমি গবেষক ইব্রাহিম গামার্দ (Ibrahim Gamard)-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও অনুবাদ দ্বারা আজকের ইউরোপের শিক্ষার্থীরা ব্যাপকহারে রুমির সাহিত্য রস আস্বাদন করতে পারছেন। ইতোমধ্যে তারা যে রুমির সাহিত্য রস নিংড়ে পরিতৃপ্তির সাথে পান করছেন তা-ও জোরালোভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। গবেষকরা এখন বিশ্ব সাহিত্যের বদ্ধমূল ধারণায় অন্তত কিছুটা হলেও চিড় ধরাতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের মধ্যে সাহিত্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নতুন করে বোধদয় ঘটতে শুরু করেছে।
রুমির সাহিত্যকর্ম অধ্যয়নের পর এতকাল দোর্দ- প্রতাপশালী ইংরেজ সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মকে রীতিমতো পানসে বলে মনে হচ্ছে। তারা এখন রীতিমতো নিক্তি দিয়ে ওজন করছেন কার সাহিত্যকর্মের গভীরতা কতটা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রিসার্স স্কলার এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত সামির আসাফ The Poet of the Poets- শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন, গভীরতার মানদ-ে রুমির তুলনায় শেক্সপিয়রের মান হচ্ছে মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ। পশ্চিমা সাহিত্যিকদের মান প্রসেঙ্গ তিনি আরো লিখেছেন, ‘পাশ্চাত্যের গ্যাটে, চসার ও ইমারসন পর্যন্ত রুমির প্রভাব প্রতিপত্তি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, রুমির সমকক্ষ যেমন গাজ্জালি, গালিব, জামি, সাদি, জিবরান, এমনকি কাজমি, দেহলভি বা জাউকের (Zauk) সাহিত্যকর্মের তুলনায় পশ্চিমা সাহিত্য বলতে গেলে হাস্যকর পর্যায়ের অগভীর।
ভাষাবিদরা পশ্চিমা সাহিত্য, বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যের এই অগভীরতার পেছনে অন্যতম তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে, উর্দু বা ফারসির তুলনায় এসব ভাষার প্রকাশভঙ্গির অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা, পাশ্চাত্যে মরমিবাদের সহজাত ঘাটতি এবং সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সমাজ ও সংস্কৃতি তুলনামূলকভাবে অস্খিতিশীল। পক্ষান্তরে রুমি এ জগতের মানুষ হয়েও সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের বাসিন্দা তথা আধ্যাত্মিক চেতনার মানুষ ছিলেন। তার কবিতা তাই যেন আকাশ থেকে বারিধারার মতো নেমে আসত।
মাওলানা রুমীর সাহিত্য আজ ভূগোলের সীমানা ,স্থান কালের ব্যবধান অতিক্রম কওে গোটা বিশ্বের মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান কওে নিয়েছে। আজ বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ম্যাডোনা ও তার মতো আরো অনেকে রুমির কবিতাকে গানে রূপ দিয়ে গেয়ে বিশ্বের দরবারে তাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করার প্রয়াস পাচ্ছেন।
বাংলাভাষাভাষী কবি,সাহিত্যিক, অনুবাদক ও গবেষকগণ আরো বেশী বেশী মাওলানা রুমীর সাহিত্য চর্চায় এগিয়ে আসলে এ অমূল্য সম্পদের সাহিত্যে রসে এদেশের পাঠকরা সিক্ত হওয়ার দুর্লভ সুযোগ পাবে।
সূত্র: ইন্টারনেট। Email: hiharun@hotmail.com