আমাদের দেশের রাজনীতি যেন কথাশিল্পী জর্জ অরওয়েল কল্পিত মিথ্যা বলার জন্য একটি সত্য মন্ত্রণালয়। এ কথা বলার প্রসঙ্গ হচ্ছে, গেল ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালের গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের ৫০তম বার্ষিকী বেশ উৎসাহ নিয়ে উদ্যাপন করতে দেখা গেল আওয়ামী লীগ সরকারকে। সরকারের বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয় ভেবেছেন শাসনতন্ত্র বার্ষিকী উদযাপন করলে বিদেশীরা বুঝবেন যে, দেশে শাসনতন্ত্র কাজ করছে। অথচ সত্য হচ্ছে, একদলীয় বাকশাল গঠনের পর ১৯৭৫ সালে সেই গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রকে বাতিল কাগজের মতো ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এখনো তার অস্তিত্ব আছে; কার্যকারিতা নেই। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, অবৈধভাবে সংশোধনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের রূপ-চরিত্র নষ্ট করা হয়েছে। তিনি যদি অবাধ নির্বাচন পরিহার করার বর্তমান সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক এবং নজিরবিহীন শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনকে অবৈধ মনে করে থাকেন তাহলে তাকে সাধুবাদ জানাতে হবে। আসল সমস্যা হচ্ছে, গণতন্ত্র ও জনগণের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখার মতো আমাদের কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। সরকারে এমন কোনো বিজ্ঞ ব্যক্তি নেই যিনি বোঝার ক্ষমতা রাখেন যে, নির্বাচন ব্যতীত শাসনতান্ত্রিক সরকার হয় না। অবস্থা দেখে বলতে হয়, হয় সরকার নির্বোধ নতুবা জনগণকে নির্বোধ মনে করা হচ্ছে। এটি শিক্ষিতজনদের জন্য মহা লজ্জার বিষয়। আইনের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে জনগণকে গ্রেফতার করা, রিমান্ডে নেয়া এবং কারাগারে পাঠানো খুব সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ কেবল ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ পালনের কথা মাথায় রাখছে, তারা ভাবছে না এই কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কিভাবে কারারুদ্ধদের পরিবার-পরিজনদের জীবন-জীবিকা সচল থাকবে। পুলিশসহ সব সরকারি কর্মচারীদের অর্থের জোগান যে জনগণ দেয় সেই তাদের খবর না রাখা কোনো বিবেকবানের পরিচয় নয়। একজন দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগে তাকে জেল খাটানো ন্যায়বিচার নয়, এটাও পুলিশের কাছে কোনো গুরুত্ব পাচ্ছে না; যদিও জেলে পাঠানোর কাজ আদালতই করছে। জনৈক দলীয় নেতার দাবি, বর্তমানে তার দলের চার লাখের মতো রাজনৈতিক নেতাকর্মী বিনা বিচারে জেল খাটছেন। অন্যদের হিসাব নেয়ারও প্রয়োজন মনে হয় না। জেল-জুলুম যে রাজনীতি নয়, দেশের সাধারণ মানুষরাও তা বোঝেন। দোষী-নির্দোষ নির্বিশেষে লোকদের জেলে রাখা অমানবিক এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করার পরিণতি ভয়াবহ হয়ে থাকে। সরকারে এমন লোক নেই যে, রাজনীতি যারা করে মিলিয়নার-বিলিয়নার হননি। দেখা যাচ্ছে মেগা প্রজেক্ট করতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অবিলম্বে সরকার পরিবর্তনের দাবিতে সভা-সমাবেশে জমায়েত হতে শুরু করেছেন। সভা-সমাবেশ এবং মিছিলে যে বিপুল মানুষ শামিল হচ্ছেন তারা সবাই যে দলবিশেষের সমর্থক তা নয়, এ কথা বিএনপি কতটা বুঝতে পারছে সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। জনগণ জানে নির্বাচনের কোনো নামনিশানা দেশে নেই এবং নির্বাচনের জন্য আরো এক বছর অপেক্ষা করে বেঁচে থাকার মতো আর্থিক সঙ্গতিও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নেই।
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বিএনপি একমাত্র বড় দল, যার বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী জেল-জুলুম ভোগ করছেন। তাই বিএনপি নেতাদের যখন ময়দানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে; তখন বিভ্রান্তির মধ্যেও জনগণ আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। তাই এ মুহূর্তে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার গঠনের দাবি তোলা, বর্তমান সময়ের জনস্বার্থে নির্দলীয় সরকার গঠনের দাবি নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করা। বিএনপির নেতারা সুযোগ পেলে রাষ্ট্রদূতদের সাথে আলোচনা করেন নির্বাচন নিয়ে। এক বছর পরে কী ধরনের নির্বাচন হবে তা নিয়ে যত চিন্তাই রাজনীতিবিদদের থাকুক না কেন, মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার যে সঙ্কট বিরাজ করছে তা বুঝতে হবে। বিএনপির ছয়জন সংসদ সদস্যের পদত্যাগ জরুরি। জরুরি ভিত্তিতে সরকার পরিবর্তনের জাতীয় দাবি গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। বিএনপির দলীয় রাজনীতিতে বিএনপির স্বচ্ছতা থাকতে হবে। চাওয়া-পাওয়ার অতীত রাজনীতির আশা ত্যাগ করতে হবে।
জনগণ তাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে সক্ষম একটা সৎ ও যোগ্য সরকার পাওয়ার আশায় পরিবর্তন প্রত্যাশা করছে এখনই। গণমানুষ ব্যাপক হারে সরকারি বাধা-প্রতিরোধ ডিঙিয়ে জনসভায় যোগদান করছে এ আশায় যে, সরকার পরিচালনায় দ্রুত পরিবর্তন আসবে এবং তাদের ভোগান্তি থেকে মুক্তির জন্য সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া যাবে। লুটেরা রাজনীতি জনগণের জন্য দুর্ভোগই ডেকে এনেছে। উন্নয়নের মিথ্যা আশ্বাস শুনিয়েছে।
ধারণা করা হয়, নিছক জেলে পুরার নাম সাজা নয়; ব্যাপারটা হচ্ছে বিচারিক প্রক্রিয়ার সূচনা। এ ধরনের ধারণা বর্তমান যুগে অচল হওয়া উচিত। কারাগারে বন্দী জীবনের শাস্তিই ভোগ করতে হয়। বিচারে দ-িত হওয়ার পর কারাগারে পাঠানোর ব্যাপারে কারো আপত্তি থাকে না। অপরাধ করেছে, তাই সাজা তাকে পেতে হবে। দেশের রাজনীতির কারণে বিনা বিচারে জেলে রাখা সহজ হচ্ছে, মিথ্যা মামলার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের বিষয়টি প্রচলিত রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাদ্যসামগ্রীর মূল্য যে, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সরকারের সহজ উত্তর, কিছু লোক ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে।
আমাদের অর্থনীতিবিদদের অনেকে অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করেন শুধু বই পড়া থিওরি নিয়ে। তারা রাজনৈতিক সুশাসনের প্রশ্ন তোলেন না। তাদের সুবিধাবাদী চিন্তাভাবনা বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের জন্য কম দায়ী নয়। এখন কেউ কেউ বলছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঠামো গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ সৃষ্টির ৫০ বছর পর এ কথা শুনলে লজ্জাই হয়।
নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামানোর জন্য অনেক সময় আছে। বিএনপি আপস না করলেও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবেই প্রচেষ্টা চলছে। এখনকার দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু অনাহারে কিংবা একবেলা খেয়ে বেঁচে আছে। বিএনপি নেতাদের এ ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকা সমীচীন নয়। তাদের দায়িত্ব এখন জনদুর্ভোগকে জোরালোভাবে তুলে ধরা। নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসা এত তাড়াতাড়ি হচ্ছে না। জনগণের ক্ষোভ যখন বিস্ফোরণ ঘটাবে তখন নির্বাচনী রাজনীতি চিন্তার বাইরে চলে যাবে। তার জায়গায় দেখা যাবে হিংসা-হানাহানি ও নৈরাজ্য। সরকার রাজনীতিকে দেখছে দুর্বৃত্তদের মধ্যে মাঠের লড়াই হিসেবে। ক্ষমতাসীনরা ১০ ডিসেম্বর বিরোধী দলকে ময়দানে পেশিশক্তি প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছেন, যে দিন বিএনপি ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছে। সরকারের প্রদর্শিত শক্তির সাম্প্রতিক মহড়া নিয়ে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস উদ্ভূত উদ্বেগসহ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছেন। আমাদের মতে, জনসমাবেশে সাহসী বাগাড়ম্বর সরকারকে বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তায় ফেলে না। সরকারও রাষ্ট্রীয় শক্তি ও অর্থের অপব্যবহার করে বিরাট সভা-সমাবেশ করার ক্ষমতা রাখে। যদি পুলিশ নিজেদের ক্ষমতার রাজনীতি থেকে দূরে রাখে, যেমনি বলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সরকারের জন্য সঙ্কট সৃষ্টি হবে। আমেরিকাও সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতা পরিবর্তনকামীদের পাকিস্তানে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পাকিস্তানি আর্মিকে মোকাবেলা করার বদলে যারা ভারতে চলে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে যারা ভারতকে নিজেদের পছন্দের দেশ মনে করেন, ভারতে যাওয়ার প্রশ্ন আসবে তাদের জন্য। তাদের এজেন্ডা অনুযায়ী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক একনায়কত্বের রাজনীতি চাপানো সম্ভব হয়েছে।
সাহসী বাংলাদেশীরা দেশে ছিলেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের হাতে জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছিলেন, সেই সাহসী বাংলাদেশীদের পাকিস্তানে চলে যাওয়ার কথা যারা বলছেন, তাদের ঔদ্ধত্য কোনোভাবে সহ্য করার মতো নয়। যেভাবে হোক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারও তো তদানীন্তন পাকিস্তানে ছিলেন। তারা ভারতে যাননি। বাংলাদেশের জনগণ তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম করে যাবে। এ দেশে জনগণের কাছে স্বাধীনতার অর্থ, নিজেদের ভোটে সরকার নির্বাচিত হওয়া। জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা স্বাধীনতা নয়। লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট