‘মহাশোল’ সুস্বাদু এ মাছ ভোজনরসিকদের কাছে কদর থাকলেও দুর্লভ হওয়ায় লোভনীয় এ মাছটি এখন উচ্চমূলেও পাওয়া যাচ্ছে না। নেত্রকোনার পাহাড়ি ঝর্ণার স্বচ্ছ পানি আর সুমেশ্বরী ও কংস নদী মহাশোল মাছের আবাসস্থল। দীর্ঘদিন পর দেশীয় প্রজাতির বিপন্ন মহাশোলের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবনে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। গবেষকরা বলছেন, সফল হলে নদ-নদী ও পুকুরেও মিলবে মহাশোল। কম মূল্যেই খেতে পারবে ভোক্তারা। ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে সৃষ্ট খরস্রোতা সুমেশ্বরী নদী সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোণার দূর্গাপুরে প্রবেশ করেছে। অপরূপ সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম প্রকৃতির মধ্যদিয়ে বহমান পাহাড়ি ঝর্ণার স্বচ্ছ পানি ও খরস্রোতা সোমেশ্বরী ও কংস নদী মহাশোলের আবাস ভ‚মি। নদীর পাথর-নুড়ির ফাঁকে ফাঁকে ‘পেরিফাইটন’ নামের এক রকমের শ্যাওলা জন্মে। যা মহাশোলের প্রধান খাদ্য। মহাশোল সর্বোচ্চ ১৫ মিটার গভীর পানিতে চলাচল করতে পারে। পানির উষ্ণতা ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাদের জীবনধারণের পক্ষে সহায়ক। মহাশোল দেখতে অনেকটা মৃগেল মাছের মতো। তবে এর আঁশগুলো আরও বড়। পরিণত মাছের আঁশ শক্ত, উজ্জ্বল সোনালি রঙের ও দীপ্তিমান। পাখনা ও লেজ রক্তিম। নাকের সামনে ছোট্ট দুটি গোঁফের মতো আছে। সব মিলিয়ে দেখতে খুব সুন্দর। মিঠাপানির মাছের মধ্যে মহাশোল স্বাদেও সেরা। পাহাড়ের পাদদেশে সুমেশ্বরী নদীর উৎসমুখ বন্ধ থাকায় এবং শুকনো মৌসুমে নদী শুকিয়ে মহাশোলের বসবাস ও বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায় এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। কদাচিৎ দু’একটি মহাশোল পাওয়া গেলেও প্রতিযোগিতামূলক দামে বেচাকেনা হয়। এই মাছ সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা কেজি বিক্রয় হওয়ার কথা শোনা যায়। গত কয়েক বছর ধরে এ মাছ পাওয়া না গেলেও এবছর প্রবল বর্ষার কারণে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় পাহাড়ের পাদদেশ থেকে নেমে আসা মহাশোল ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। এসব জেলেদের কাছ থেকে ২৫ টি মহাশোল মাছ কিনে গবেষণা পুকুরে মজুত করেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। জেলেরা এসব মাছ প্রতি কেজি তিন থেকে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি করছে। প্রতিটি মাছের ওজন এক কেজি থেকে সাড়ে পাঁচ কেজি। জেলেদের নিকট থেকে মহাশোল মাছ সংগ্রহকারী ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা মুহাম্মদ খান জানান, মহাশোল মাছ ধরে দেয়ার জন্য তিন মাস আগে থেকেই সুমেশ্বরী নদীর জেলেদের সাথে যোগাযোগ করি। তারা বিভিন্ন সময়ে মহাশোল মাছ ধরে স্থানীয় পুকুরে মজুত করে। এ পর্যন্ত ২৫ টি মাছ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এইচ এম কোহিনুর জানান, দেশীয় প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মহাশোল মাছের কৃত্রিম প্রজনন এবং পোনা উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করার জন্য কয়েক বছর চেষ্টার পর এবার মহাশোলের ব্র্যড মাছ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, দেশী মহাশোল মাছ দূর্লভ প্রজাতির। বাংলাদেশে যে ৬৪ প্রজাতির বিলুপ্ত মাছ রয়েছে, মহাশোল হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম। এ মাছটি সচরাচর দেখা যায়না। এ মাছটি নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার সুমেশ্বরী নদীতে পাওয়া যায়। কয়েক বছর যাবত চেষ্টা করছি মাছটি সংগ্রহ করার। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই মাছটি সংগ্রহ করে পুকুরে ডমোনেস্টিক করে এর প্রজনন ও চাষাবাদ পদ্ধতি আবিস্কার করা। চলতি বছর ৫০ টি মহাশোল মাছ সংগ্রহ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ২৫ টি মাহাশোল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, মহাশোল একটি দামী এবং সুস্বাদু মাছ এবং এটি বিলুপ্তি তালিকায় আছে। বিশ্বে মহাশোল মাছের বহু প্রজাতি আছে। ইতোমধ্যে একটি প্রজাতির (নেপালী) মহাশোলের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ কৌশল গবেষণায় সফল হওয়ায় পর দেশের বিভিন্ন নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। অনেকেই পোনা নিয়ে পুকুরেই চাষ করছেন। শুধু মহাশোল নয়, হারিয়ে যাওয়া আরো ২৩ টি প্রজাতি মাছের কৃত্রিম প্রজনন সফলতার সাথে সম্পন্ন করে চাষি পর্যায়ে পৌছে দিতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। তিনি আরো জানান, এবার দেশীয় প্রজাতির সোনালী মহাশোলের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবনে মাঠে নেমেছে। এই কাজটি যদি সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারি তাহলে এখন যেমন মহাশোল মাছ অনেক দামে বাজারে বিক্রি হয়, সেই মূল্য হ্রাস পাবে এবং হারিয়ে যাওয়া সোনালী মহাশোল সুলভ মূল্যে ভোক্তাদের খাবার টেবিলে ঠাঁই পাবে এমন দাবি এই কর্মকর্তার। প্রসঙ্গত; বাংলাদেশে মহাশোলের দু’টি প্রজাতি আছে যাদের নাম সোনালী মহাশোল (বৈজ্ঞানিক নাম Tor tor) এবং লাল-পাখনা মহাশোল (বৈজ্ঞানিক নাম Tor putitora)। প্রজাতি দ‘টি মহাবিপন্ন।