ইসরাইলি বর্বর আগ্রাসন ও নিষ্ঠুর হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা এখন এক বিধ্বস্ত জনপদ। মাত্র ৪১ কিলোমিটার লম্বা ও ৬-৮ কিলোমিটার চওড়া ছোট্ট একটি ভূখ- যার চারিদিক সাগর, ইসরাইল ও মিসর দ্বারা পরিবেষ্টিত। অবরুদ্ধ ১৮ লাখ জনগষ্ঠির উপর রকেট, শেল ও ফসফরাস বোমা, ছাদ বিধ্বংসি ক্ষেপণাস্ত্র এবং ডেন্স ইন্টারমেন্টাল এক্সপ্লোসিভ ফেলা হয়েছে। বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে মায়ের কোলের শিশুসহ কয়েক শত আবালবৃদ্ধবনিতা। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধুলোয় মিশে আছে অফিস-আদালত এবং বসতবাড়ি, গাজায় নেমে এসেছে মানবতার চরম বিপর্যয়। নিরাপরাধ মানুষের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস কাঁদছে। গাজাবাসীর দুর্ভাগ্য যে, তাদের সেই আর্তচিৎকারে ঘুম ভাঙ্গেনি বিশ্বনেতাদের। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে নিয়োজিত জাতিসংঘ একেবারেই নিশ্চুপ ও নির্বিকার। একইভাবে নির্বিকার মুসলিম বিশ্ব, ওআইসি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসমূহ। গত ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর ইসরাইলের বর্বরতা চলছেই। ইসরাইলের এই বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতায় কত ফিলিস্তিনি মারা গেছে, কত ফিলিস্তিনি আহত হয়ে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, কত ফিলিস্তিনি দেশান্তরিত হয়ে উদ্বা¯ুÍ শিবিরে বসবাস করছে, আর কত ফিলিস্তিনি ইসরাইলের কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী জীবন কাটাচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। গাজায় বারবার ইসরাইলের কেন এই বর্বর আগ্রাসন? হামাসই কেন ইসরাইলের প্রধান শত্রু? ইসরাইলি বর্বরতায় বিশ্বনেতাদের নিরবতা কেন? এই প্রশ্নের সম্ভাবত একটাই উত্তর, তাহলো, পশ্চিমা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা। কারণ, ‘প্রতিটি বৃহৎ শক্তিরই একটি সূচনা থাকে, তার পতনের একটি নিজস্ব শব্দ, লক্ষণ ও প্রকৃতি থাকে। জ্যোতির্বিদরা বলেন, গ্রহ-নক্ষত্র তার আয়ুষ্কালের শেষ প্রান্তে এসে কৃঞ্চগহ্বরে পরিণত হয়। ভূতাত্ত্বিকেরা বলেন, নদী তার শেষ প্রান্তে এসে গভীরতা হারালে দুই পাড়ের ভাঙন বেড়ে যায়। বন্য জানোয়ার ক্ষুধার্ত হলে অথবা নিজেকে নিরাপত্তাহীন মনে করলে তার হিংস্রতা বেড়ে যায়।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের পর তুরস্ক ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে সমগ্র মুসলিম জাহানকে উদ্দেশ্য করে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেয়। অটোমান তুর্কিরা মনে করেছিল, সাম্রাজ্যের ভিতরে ও বাইরে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জিহাদের এই আহ্বান ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে। কিন্তু তাদের এ আশা ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ, তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত আরবদের একটি বড় অংশ মক্কার শরিফ হুসাইনের নেতৃত্বে নিষ্ক্রীয় থাকে। আরবদের আরেক শক্তিশালী নৃপতি ইবনে সাউদও জিহাদের ডাকে সাড়া দেন নাই। দক্ষিণ আরবের প্রভাবশালী শাসক ইদ্রিসি মোহাম্মদও তুর্কিদের ডাকে কর্ণপাত করেননি। তাছাড়া কুয়েতসহ শেখ শাসিত অন্যান্য আরব অঞ্চলের সঙ্গে ব্রিটেনের চুক্তি থাকায় এসব অঞ্চলের শাসকগণও তুর্কিদের ডাকে সাড়া দেননি। অন্যদিকে ১৯১৪ সালের ৩১ অক্টোবরে ব্রিটিশ যুদ্ধ-মন্ত্রী লর্ড কিচেনার শরিফ হুসাইনকে এই বলে আশ্বাস দেন যে, যদি শরিফ হুসাইন এবং তার সমর্থকগণ যুদ্ধে তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটেনকে সাহায্য করে তাহলে ব্রিটিশ সরকার তাকে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারসহ হেজাজের গ্রান্ড শরিফ হিসাবে নিযুক্তির নিশ্চয়তা দেবে এবং যে কোন প্রকার বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। এছাড়া সাধারণভাবে আরবদের মুক্তিতে সহযোগিতা এবং হুসাইন কর্তৃক একটি আরব খেলাফত ঘোষিত হলে তাকে ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি প্রদানের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক আরবদের যে ফেডারেশনের স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল যথা: উত্তরে মার্সীন ও আদানা হতে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত। পূর্বে পারস্য সীমানা হতে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত; দক্ষিণে এডেন ব্যতীত ভারত মহাসাগর পর্যন্ত; পশ্চিমে লোহিত সাগর হতে ভূমধ্যসাাগর হয়ে পুনরায় মার্সিন পর্যন্ত।
ফিলিস্তিনকে প্রস্তাবিত আরব রাজ্যর সীমানাভুক্ত করা হয়েছিল কি না প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই বিষয় তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। আরবদের মতে, ব্রিটেন কর্তৃক প্রতিশ্রুত আরব রাজ্যের সীমানার মধ্যে ফিলিস্তিনও ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার জানায়, ফিলিস্তিন বিষয় আরবদের কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। হুসাইন ম্যাকমোহন পত্রালাপে মূল বিষয়বস্তু ছিল প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ। সুতারাং পত্রগুলির যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই কেবল ফিলিস্তিনের বিষয় পরস্পর বিরোধী বক্তব্য এবং এর ফলে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান ঘটানো সম্ভব। মজার ব্যাপার হলো, এই পত্রালাপের কোথাও ফিলিস্তিন শব্দটির উল্লেখ নেই। এই প্রসঙ্গে হুসাইনের নিকট ম্যাকমোহনের দ্বিতীয় পত্রে উল্লেখিত দামেস্ক, হমস, হামা ও আলেপ্পো জেলাসমূহর পশ্চিমে অবস্থিত সিরীয় ভূখ- (Portion of Syria lying to the west of the districts of Damascus. Homs, Hama one Alleppo) বাক্যাংশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সরকারের বক্তব্য হলো, এই বাক্যাংশটি ব্যবহারের মাধ্যমে ম্যাকমোহন যেসব অঞ্চল প্রস্তাবিত আরব রাজ্য থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন তার মধ্যে ফিলিস্তিন ছিল। ১৯২২ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশিক মন্ত্রী উন্সটন চার্চিল এই বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, ফিলিস্তিন বিষয় আরবদের কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। তিনি যুক্তি দেখান যে, বাক্যাংশে ব্যবহত ফরংঃৎরপঃং শব্দটি দিয়ে আরবী ারষধুবঃং কে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু উক্ত বাক্যাংশটি যথাযথ বিশ্লেষণ করলে উইন্সটন চার্চিলের এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। প্রথমত, আরবী শব্দ ভিলায়েত অর্থ প্রদেশ, যা কোনভাবেই ইংরেজি districtsএর প্রতিশব্দ নয়। বরং districts-কে আরবী সানজাক বা জেলার প্রতিশব্দ বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। দ্বিতীয়ত, ম্যাকমোহন কর্তৃক ব্যবহৃত এই বাক্যাংশে ফরংঃৎরপঃং শব্দটি ারষধুবঃং বুঝতে যে ব্যবহৃত হয়নি তারও প্রমাণ রয়েছে। কেননা দামেস্ক, হমস, হামা নামে কোনো ভিলায়েত ছিল না। তখন সিরিয়া ভিলায়েত নামে একটি মাত্র ভিলায়েত ছিল, যা আরবীতে ‘ভিলায়েত-আস-সুরীয়’ নামে পরিচিত ছিল। দামেস্ক ছিল এই ভিলায়েতের রাজধানী। আর হমস এবং হামা ছিল ক্ষুদ্র প্রশাসনিক ইউনিট ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। সুতারাং ম্যাকমোহনের ব্যবহৃত ফরংঃৎরপঃং শব্দটি একমাত্র জেলাসমূহ শব্দের সমার্থক শব্দ হিসাবে বিবেচনা করলেই বাক্যাংশটি অর্থপূর্ণ হয়। এর ফলে উল্লেখিত চারটি শহর সংলগ্ন সিরিয়ার পশ্চিম অঞ্চলকে বুঝায়, যা সাইদন থেকে আলেকজান্দ্র্রা পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু চার্চিল দামেস্ক শহরটিকে সিরিয়া ভিলায়াতের সমর্থক বিবেচনা করে আকাবা পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রদেশের পশ্চিমাংশকে প্রস্তাবিত আরব রাজ্য থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। ফলে জর্ডান নদীর পশ্চিমে অবস্থিত ফিলিস্তিনিও প্রস্তাবিত আরব রাজ্যের বাইরে বলে যুক্তি দেখান, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি ফিলিস্তিনকেও আরব রাজ্যের বাইরে রাখার ইচ্ছা থাকতো তাহলে নিশ্চয় তিনি আলেপ্পো ও বৈরুত ভিলায়েতের সঙ্গে জেরুজালেম সানজাক বা জেলার কথাও উল্লেখ করতেন।
অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্ক যোগ দেয় জার্মানির পক্ষে। এ সময় যুদ্ধে জেতার জন্য গ্রেট ব্রিটেন আরবদের সহায়তা লাভের জন্য প্রতিশ্রুতি দেয় যে, আরবরা যদি তুরস্কের বিপক্ষে ব্রিটেনকে সহায়তা দেয়, তবে ব্রিটেন যুদ্ধের পর আরব ফেডারেশন গড়ার সহায়তা করবে। একইসঙ্গে তারা ইউরোপের ইহুদিদের যুদ্ধ সহযোগিতা পাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয় যে, গ্রেট ব্রিটেন যুদ্ধে জয়ী হলে তারা প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহযোগিতা করবে; অর্থাৎ একইসাথে আরবদের দেয় একরকম প্রতিশ্রুতি আর ইহুদীদের দেয় আরেক রকম প্রতিশ্রুতি। ম্যাকমোহন আরবদের প্রতিশ্রুতি দেয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ১৯১৫ সাালের অক্টোবর মাসে এবং লর্ড বেলফোর ইহুদিদের প্রতিশ্রুতি দেয় ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর মাসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অ্যাসিটনের অভাব দেখা দেয়। অ্যাসিটন বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরি করতে লাগে। জাইনিস্ট নেতা ছিলেন বিলাতের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং প্রথম শ্রেণির জীবাণুবিদ ও জৈব রসায়নবিদ। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে বলেন, অ্যাসিটন তৈরির গোপন এক কৌশল তিনি আবিষ্কার করেছেন। ব্রিটিশ সরকার যদি প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র গড়তে দেয় তবে তিনি অ্যাসিটন তৈরি করে দেবেন।
আবার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে দুটি কারণে, আর্থিক সংকট ও জনক্ষয়। তখন ব্রিটেন ইহুদি নেতা রথচইল্ডকে দুটি বিষয়ে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেন। প্রথমত, আর্থিক সাহায্য, দ্বিতীয়ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে আনা। রথচাইল্ড রাজি হলেন একটি শর্তে, তাকে যুদ্ধ শেষ হলে প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সুযোগ দিতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন জয়ী হলে বেলফোর ঘোষণা করেন যে, প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে দেবে। ব্রিটেন ইহুদিদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা রক্ষা করেছে। অথচ, বিশ্বযুদ্ধের সময় আরবরা তুর্কিদের বিপক্ষে ব্রিটেনের সহযোগিতা না করলে তুর্কিদের সাথে যুদ্ধে জেতা ব্রিটেনের জন্য খুবই কঠিন হতো। সুতারাং আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন ভূখ-কে কেন্দ্র করে ইসরাইল যে আগ্রাসন চালাচ্ছে তার পথ সুগম করে দেয় ব্রিটেন। মূলত ব্রিটেনের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। লেখক: প্রভাষক বিভাগ, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা