শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৬ অপরাহ্ন

সৈয়দ আলী আহসান : সান্নিধ্যের শান্তি ও আনন্দ

সরদার আবদুস সাত্তার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২২

প্রকৃত জ্ঞানী, বহুদর্শী ও বহু বিদ্যাবিশারদ, মানুষের দুর্ভিক্ষপীড়িত এই দেশে মন ও মননে ঐশ্বর্যবান মনীষী সৈয়দ আলী আহসানকে তার ৯৬তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করি ১৯৭১-এর যুদ্ধতাড়িত সেই ভয়াল দিনগুলোতে সব কিছুই যখন অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কায় হতমলিন হয়ে পড়েছিল, একটুখানি আশ্বাস ও অভয়বাণীর জন্য যখন হাপিত্যেশ করে মরছিলাম- সেই বিবর্ণ দিনগুলোতেই প্রথম শুনেছিলাম তার কণ্ঠ।
শুনেছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানে। সে এক বিস্ময়জাগানো অনুভূতি, আলো আর আনন্দে মাখামাখি করা অনুভূতি! আর সেই অমীয় কণ্ঠের অধিকারী মানুষটি- সৈয়দ আলী আহসান যার নাম, তিনি তখন হয়ে উঠেছেন আমাদের আত্মার আত্মীয়। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে এক প্রজ্ঞাবান ও সাহস-সঞ্চারী বন্ধু, প্রায় নিয়মিতভাবেই সন্ধ্যার পর ইথারে ভেসে আসে তার কণ্ঠ। সেই কণ্ঠের আশ্চর্য গাম্ভীর্য ও কোমলতা আমাদের বরাভয় বিলিয়ে যায়। একরাশ স্বস্তি ও আশ্বাস ছড়িয়ে দিয়ে যায় আমাদের চার পাশে।
মনের মধ্যে সাধ ও স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, স্বাধীন স্বদেশে দাঁড়িয়ে এই অসাধারণ কণ্ঠ আর প্রচার অধিকারী মানুষটিকে কাছে থেকে দেখবার। সেই সোনার স্বপ্নের সাধও একদিন পূর্ণ হলো। তবে স্বাধীনতার ঠিক পরপরই নয়, বেশ ক’বছর পরে; কেননা তার কর্ম ও বিচরণস্থল থেকে আমার অবস্থানস্থল ছিল অনেক দূরে। কিন্তু অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই সেই দূরত্বও একদিন ঘুচে গেল।
আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। সৈয়দ আলী আহসান এলেন উপাচার্য হয়ে। মতিহার চত্বরের ঘাসে ঘাসে, ফুলে ফুলে, পাতায় পাতায়, মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সে সংবাদ। আমার মতো আমার বন্ধুরাও তখন সামনে থেকে কেউ তাকে দেখেনি। অথচ টেলিভিশনের পর্দায় দেখা হয়ে গেছে অনেকবার। আমরা নড়েচড়ে বসলাম তাকে দেখবার জন্য। তার কথা এবং বক্তৃতা শোনবার জন্য।
প্রায় সাত শ’ একরের এক বিশাল ক্যাম্পাস নিয়ে গড়ে ওঠা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তখন সব দিক থেকেই মনোরম ও প্রাণচঞ্চল। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার আওতায় গড়ে ওঠা অজস্র ভবন সুসজ্জিতভাবে চার দিকে ছড়ানো। কোনোটিই চার-পাঁচতলার বেশি উঁচু নয়। চার পাশে অনেক খোলা জায়গা, গাছপালা, বাগান, পুকুর মাঠ আর এঁকেবেঁকে চলা ছিমছাম সংযোগ-সড়ক। যে দিকেই তাকানো যাক- চোখের তৃপ্তি, মনের শান্তি। সেই শান্তি ও আনন্দময়তার মধ্যে নতুন এক আনন্দের মাত্রা ছড়িয়ে দিলেন
সৈয়দ আলী আহসান- তার নিজস্ব উপস্থিতি ও নান্দনিক কর্মকা-ের দ্বারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন যে ক’জন উপাচার্যকে পেয়েছিলাম, তারা সবাই সুবক্তা; কিন্তু বক্তৃতাও যে একটা বিশুদ্ধ শিল্প হয়ে উঠতে পারে, সৈয়দ আলী আহসানই আমাদেরকে তা প্রথম বোঝালেন এবং করে দেখালেন। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি অন্যদের সাথে মঞ্চে বসে থাকতেন, অন্য অভ্যাগতদের সাথে তার পার্থক্য তেমন বোঝা যেত না। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াতেন, সেই মুহূর্তেই তিনি হয়ে যেতেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মানুষ। তখন তাকে মোটেই আর একজন সাধারণ মানুষ মনে হতো না। মনে হতো এক ঐন্দ্রজালিক- যার করতলে বন্দী হয়ে পড়েছে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সব শ্রোতার মন। তাই সম্মোহিতের মতো তার বক্তৃতা শোনা ছাড়া অন্য কিছু করার কোনো শক্তিই যেন কারো মধ্যে অবশিষ্ট নেই। মনের সবটুকু মনোযোগ ও আকর্ষণ তখন শুধু তার বক্তৃতা শোনারমধ্যেই কেন্দ্রীভূত, আর তাতেই যেন যত শান্তি, যত স্বস্তি, যত আনন্দ, যত মুগ্ধতাভরা বিস্ময়। বাংলা ভাষার শব্দগুলো তখন তার অপরূপ কণ্ঠলাবণ্যের ছোঁয়ায় তখন এক একটা রঙিন ফুলের মতো, অথবা সন্ধ্যাকাশের কোমল ও মনোহর বর্ণচ্ছটার মতো চার দিকে অপূর্ব আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর সেই আবেশের মধ্যে ডুবে গিয়ে শ্রোতার আসনে বসে থাকা আমরা সবাই তখন তার অনর্গল বলে চলা কথামালায় একইসাথে মোহিত এবং ঋদ্ধ হয়ে চলেছি। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা! কেমন করে পারেন একজন মানুষ, অলৌকিকের আনন্দভরা এমন অসাধারণ কা- নিরন্তর ঘটিয়ে চলতে? প্রশ্ন করেনই নিজেকে এবং অন্যকে। কিন্তু সদুত্তর জোটেনি তেমনটি। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তিনি (সৈয়দ আলী আহসান) সদালাপী এবং বক্তৃতামঞ্চে তার কাছে ঘেঁষতে পারে, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে।’ জনাব সিদ্দিকীর এ বক্তব্যে সত্যতা আছে কিন্তু চমৎকারিত্ব নেই। বরং সেই অন্বিষ্ট চমৎকারিত্বের অনেকখানি খুঁজে পাওয়া যায় কবি আল মাহমুদের একটি বক্তবে। সৈয়দ আলী আহসানের বক্তৃতার অসাধারণত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘বক্তা হিসেবে তিনি যখন মঞ্চে স্পন্দিত হতে থাকেন, তখন মনে হয় আমাদের অনুসন্ধিৎসা এক ঐন্দ্রজালিকের সম্বোধনের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।’
আমি যখন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালায় সৈয়দ আলী আহসানের কণ্ঠ ও কথিকা প্রথম শুনি, তিনি তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সৈনিক হিসেবে কলকাতায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই বেতারের সান্ধ্যকালীন নিয়মিত অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতা প্রচারিত হতো। হতাশা আর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে থাকা পরাধীন স্বদেশের নানা প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বাধীনতাকামী মানুষ তার সেই বক্তৃতা-কথিকা শুনে নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হতেন। এক নতুন
আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ওঠার প্রয়াস চালাতেন। কিন্তু ইথারের সাহায্যে শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে সে দিন তিনি শুধু তার স্বদেশবাসীকেই উজ্জীবিত করার মাধ্যমে তার কর্মপ্রয়াসকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। প্রবাসের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আনার জন্য পালন করেছেন এক অনন্যসাধারণ ভূমিকা। যেহেতু একাধিক ভাষার ওপর তার দখল ছিল অনবদ্য, তাই এ কাজে সাফল্য অর্জন করতে মোটেই তাকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। কলকাতার বাঙালি সমাজকে কিভাবে তিনি মোহিত করে ফেলেছিলেন সে গল্প অনেকের কাছেই শুনেছি। আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটি লেখাতেও তার একটি রোমাঞ্চকর বর্ণনা পড়েছি। সেটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম দিককার ঘটনা। কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীরা সবাই মিলে ঠিক করলেন, কলকাতার বাঙালি সমাজের কাছে বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র এবং বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার কথা তুলে ধরতে তারা কলকাতার শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সহায়তা নিয়ে একটি বড় সভা করবেন। অন্নদাশঙ্কর রায় থেকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তথা পশ্চিমবঙ্গের সব লেখক শিল্পী-সাহিত্যিকেরা তাতে সাগ্রহে সম্মতি জানালেন। কলকাতার সবচেয়ে বড় এবং আকর্ষণীয় প্রেক্ষাগৃহ রবীন্দ্রসদনকে নির্বাচন করা হলো সভাস্থল হিসেবে। আমন্ত্রণ জানানো হলো কলকাতার সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সৈয়দ আলী আহসানের ওপর ভার পড়ল মুখ্য বক্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করার। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগ তখন তুঙ্গে। সেই আবেগ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদেরও দারুণভাবে আলোড়িত করেছে। তাই সভা শুরুর বেশখানিকটা আগেই পুরো রবীন্দ্রসনদ শ্রোতা-দর্শকে পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের দেখা ও তাদের কথা শোনার জন্য সবাই ব্যস্ত। যথাসময়ে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা শ্মশ্রুম-িত সৈয়দ আলী আহসান মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু সামনের শ্রোতা-দর্শকদের একটি বড় অংশের মধ্যে তখন উসখুস শুরু হয়ে গেছে। অতি সাধারণ বেশবাসের দাড়িওয়ালা এমন একজন মানুষকে বাংলাদেশের প্রধান বক্তা হিসেবে তারা ঠিক আশা করেননি। অনেকের চোখেমুখেই তখন হতাশার আঁকিবুঁকি, অনেকেই আবার তাদের অপ্রসন্নতার কথা স্পষ্ট করেই প্রকাশ করছিলেন। ফলে গোটা প্রেক্ষাগৃহজুড়ে ফিসফাস আর মৃদু কোলাহল ছড়িয়ে পড়েছে। একটা বিব্রতকর ও প্রতিকূল পরিবেশ। কয়েকটি মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে সৈয়দ আলী আহসান সব কিছু ভালো করে দেখে এবং বোঝে নিলেন সম্ভবত মনে মনে একটু হেসেও নিলেন। তার পর সেই গুঞ্জনের মধ্যেই শুরু করলেন তার বক্তৃতা। এবং সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেল পালাবদলের প্রক্রিয়া। যারা এতক্ষণ কথা বলছিলেন, কোলাহল করছিলেন; দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই তারা থেমে গেলেন। লাবণ্য আর গম্ভীর্যে মেলামেলি করা তার অপূর্ব আবেদনকারী কণ্ঠধ্বনি তখন বাকি সব কণ্ঠকেই নিস্তব্ধ করে দিয়েছে। যাদের চোখেমুখে এতক্ষণ হতাশা কিংবা অপ্রসন্নতার ছাপ ছড়ানো ছিল। ভোজবাজির মতো নিমেষে তাও উধাও হয়ে গেছে। সবাই তখন নির্বাক শ্রোতা। মনোযোগী, স্বপ্নাতুর ও মোহাবিষ্ট। গোটা হলজুড়ে পিনপতন নিস্তব্ধতা। বাঙাল-মুলুকের একজন মানুষের কথায় এমন জাদু থাকতে পারে, কলকাতাবাসীর কাছে এর আগে একেবারেই তা অজানা ছিল। তাই বক্তৃতা থামতেই আবার কোলাহল। তবে এই কোলাহল আনন্দের আর উচ্ছ্বাসের আর ভঙ্গির, আর ভালোবাসার শুধু এক বাঙাল প-িতই সে দিন কলকাতা জয় করেননি, করেছিলেন তার যুদ্ধাক্রান্ত মাতৃভূমিও।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাকে আমি প্রথম চাক্ষুস দেখেছিলাম। সামনাসামনি বসে তার মধুঝরা কণ্ঠের অপূর্ব বক্তৃতা শুনে অনুভব করেছিলাম। কণ্ঠ উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি তার বক্তৃতার অন্যতম আকর্ষণ হলেও তার প্রজ্ঞাম-িত বক্তব্যই ছিল তার বক্তৃতার প্রাণ। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েছিলেন তিনি। তবে শুধু বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যচর্চার মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখেননি তিনি। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন একজন বহুবিদ্যায় পারদর্শী মানুষ।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা সম্পর্কেই ছিল তার সমান ঔৎসুক্য। তাই সব বিষয়ের পুস্তকই তিনি পড়তেন এবং অসাধারণ স্মৃতিশক্তির কারণে তারপ্রায় সবটুকুই মনে রাখতে পারতেন। ফলে যেকোনো বিষয়েই তিনি অনর্গল কথা বলে যেতে পারতেন, অনায়াসেই মিশেল দিতে পারতেন সাহিত্যের সাথে দর্শন অথবা বিজ্ঞানের। ফলে বহুমাত্রিকতা চলে আসত তার কথা ও লেখায়। আর এই অতুল্য প্রজ্ঞা ও বিষয়বৈচিত্র্যই তার শ্রোতাকে মোহাবিষ্ট করে রাখত, সেই সাথে ছিল বক্তব্যের প্রাঞ্জলতা ও তাৎক্ষণিক উপমা প্রয়োগের দক্ষতা। প্রসাদগুণ বলে যে কথাটা প্রচলিত আছে তার বক্তৃতায় তা পুরোমাত্রায় বজায় থাকত।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাকে দেখবার ও কথা শোনার সুযোগ পেলেও তার কাছে যাওয়ার কিংবা কথা বলার কোনো সুযোগ হয়নি।
কিন্তু এই দূরের মানুষটিও আবার একসময় খুব কাছের মানুষ হয়ে পড়লেন। বলা যেতে পারে এক বিশাল স্বপ্ন পূরণ হলো। আর এ অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললেন তার জামাতা প্রফেসর মাহমুদ শাহ কোরেশী। তিনি তখন আইবিএসের প্রফেসর এবং আমার গবেষণাকর্মের নির্দেশক ছিলেন। মাঝে মধ্যে ঢাকায় এলে কলাবাগানে সৈয়দ আলী আহসানের বাড়িতেই উঠতেন। ঢাকায় চলে আসার পর কোনো এক প্রয়োজনে এক সকালে আমি কলাবাগানের ওই বাড়িতে যাই। একটা ছিমছাম একতলা বাড়ি। সামনে গ-িবারান্দা। পেছনে সবুজ ঘাসে ছাওয়া একটা চোখজুড়ানো ফুলের বাগান। পাশেই হাইভবন। প্রফেসর আবদুল হাইয়ের বাসভবন। মুগ্ধ চোখে আমি চার পাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। সেই সকালটা আসলে আমার জন্য ছিল একটা চমৎকার শুভসকাল। ড. কোরেশী আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন সৈয়দ আলী আহসানের সাথে। আমি তাকে শ্রদ্ধা জানালাম। তিনি তার পুরু লেন্সের চশমার আড়াল থেকে দু’টি উজ্জ্বল চোখের পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে আমাকে দেখলেন। মায়াবী কণ্ঠে অনেকটা
স্বগতোক্তির মতো করে কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করলেন। আমার কাছে তা কবিতার ধ্বনির মতো ব্যঞ্জনাময় মনে হলো। কেমন করে তিনি উচ্চারণ করেন অমন মনোময় শব্দগুলো? সেই পুরনো বিস্ময় এবং প্রশ্ন আমাকে তখন আলোচিত করছে। আমি একটু একটু কাঁপছি। কাঁপছে আমার চোখের পাতাও। তিনি আমাকে তার পাশে বসতে বললেন। আমি বসলাম বেশখানিকটা দ্বিধা ও জড়তা নিয়ে। হয়তোবা খানিকটা ভয়ও। তবুও বসলাম। ঠিক তার পাশের আসনেই। সেই মুহূর্তটি এখনো আমার কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। তখন তিনি পুরোপুরি অবসরে। কোনো কোনো বিশেষ কিংবা সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য বাড়ি থেকে বাইরে গেলেও বাকি সময় ঘরেই থাকেন। প্রতিদিন সকালে বেশ কিছুটা সময় নিয়ম করে কোনো না কোনো লেখার শ্রুতি নির্দেশনা বা ফরপঃধঃরড়হ দিতে বসেন। শামসুজ্জোহা নামে এক চটপটে তরুণ শ্রুতিলিখনের দায়িত্বটা ঠিকঠাকভাবে পালন করত। কোনো দিন যদি হঠাৎ করে সেই শ্রুতিলিখনের সময় পৌঁছে গেছি। মুখে কোনো কথা না বলে চোখের ইঙ্গিতে তিনি বসতে বলতেন।
চুপচাপ একটা আসনে বসে পড়ে গোটা শ্রুতিলিখন পর্বটা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে আমি দেখতাম ও শুনতাম। কখনো সাহিত্য, কখনো ইতিহাস, কখনো ধর্ম, কখনো দর্শনের মতো গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে মুখে মুখে তিনি অবিরাম শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে যেতেন। শামসুজ্জোহা তার পেশাগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অতি দ্রুত স্পষ্ট হস্তাক্ষরে তা লিখে ফেলত। গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে মনে হতো বলা ও লেখার এক চমৎকার যুগলবন্দী খেলা। শামসুজ্জোহাকে আমি খুব কম সময়েই কোনো শব্দ বা
বাক্যকে দু’বার জিজ্ঞেস করতে কিংবা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। একবার শুনেই গোটা বাক্যটা সে মনে রাখতে পারত। সেটা দেখে আমি মুগ্ধ হতাম। তবে তার চেয়ে অনেক বেশি মুগ্ধ ও বিস্মিত হতাম, শ্রুতিলিখনের বিষয়টি নিয়ে সৈয়দ আলী আহসানের অনর্গল কথা বলে যাওয়ার অপরিসীম দক্ষতা দেখে। কখনো তার চোখ দুটো খোলা, কখনো বা বন্ধ, কিন্তু তিনি শব্দের পর শব্দ উচ্চারণ করে চলেছেন একইভাবে। আর কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে সেই শব্দগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে এক নিপুণ শব্দবন্ধ ও বাক্যবন্ধ গড়ে চলেছে। কোথাও কোনো ফাঁক নেই, অস্পষ্টতা বা আড়ষ্টতাও নেই। আর কী তার ব্যঞ্জনা এবং কী তার গভীরতা! প্রথমে তা কানকে তৃপ্ত করে, তারপর বোধ ও বুদ্ধিকে। অতি অল্প সময়েই জানা হয়ে যায় অনেক কিছু। কিন্তু যিনি জানাচ্ছেন তার যেন কোনো কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই। শ্রাবণের ধারার মতো অথবা নদীর কল্লোলের মতো কিংবা বাতাসের প্রবাহের মতো তার মুখ থেকে অবিরাম কথার ফুল ঝরে পড়ছে। যেমন তার বর্ণ, তেমনি তার গল্প।
দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে, মুগ্ধ হতে হতে বহু পুরনো সেই প্রশ্নটাই আবার আমার মাথায় এসে ভর করে- কেমন করে পারেন তিনি এমন জ্ঞানগর্ভ এবং অনির্বাচনীয় বাক্যস্রোতের অবিরল উৎসারণ ঘটিয়ে যেতে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার বলেছিলেন, ‘বিধাতা যাহারে দেন অলৌকিক আনন্দের ভার’। এ কী তবে তা-ই? মনে মনে ভেবেছি- হবে হয়তোবা। কেননা এ ছাড়া কোনো যোগ্য উত্তর যেমন পাইনি, তেমন এখনো তা সেই ‘না’-এর দোরগোড়াতেই থমকে আছে। কত বিচিত্র রুচি, বিশ্বাস ও পেশার মানুষই না আসতেন তার কাছে- স্বস্তি সান্ত¡না আর আনন্দে মেশামেশি করা কথা শুনতে। অথচ তিনি কোনো সিদ্ধপুরুষ ছিলেন না। ছিলেন না শুদ্ধতম মানুষও। তবুও তার প্রজ্ঞা ও লাবণ্যস্নাত কথা এবং প্রশান্ত ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ ছিল দুর্বার। ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ আসত তার কাছে। যখন তিনি অধ্যাপক, তখন ছাত্ররা আসতেন, যখন তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক, তখন সাহিত্যিকেরা আসতেন, যখন তিনি উপাচার্য তখন অধ্যাপকেরা
আসতেন, যখন তিনি উপদেষ্টা তখন রাজনীতিবিদ ও আমলারা আসতেন এবং যখন তিনি সব কিছু ছেড়েছুড়ে শুধু সৈয়দ আলী আহসান- তখনো আসার বিরাম ছিল না গুণগ্রাহীদের। উর্দিপরা লোকজনও আসতেন, হাতে চমৎকার কবিতা কিংবা গল্পের বই নিয়ে। কবিরা আসতেন, অকবিরা আসতেন, আসতেন সাহিত্য যশপ্রার্থীরা। সবার জন্যই তার দুয়ার খোলা ছিল। আর তার বাড়ির বসার ঘরটিও ছিল যথেষ্ট বড়, একসঙ্গে অনেকে সেখানে বসতে পারতেন। কথা শুনতে কিংবা বলতে পারতেন। বিত্তবৈভব কিংবা ক্ষমতার বাহাদুরী নয়। শুধু কথার জাদুতেই তিনি সম্মোহিত করে রাখতেন সবাইকে। অশান্ত মনকে প্রশান্ত করে দিতেন। যেকোনো বিষণ্নতার বাতাবরণকে শরৎ আকাশের স্নিগ্ধ আলো নিয়ে ধুইয়ে দিতে পারতেন। মনে আছে, কবি আল মুজাহিদীকে একবার তার বসার ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিলাম- ‘স্যারের এই ঘরের জানালা দিয়ে যখন আকাশের দিকে তাকাই, তখন আকাশকে অনেক বেশি স্নিগ্ধ, প্রসন্ন ও নীলাভ মনে হয়।’




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com