যৌবনকাল মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ সময়ের ইবাদতের মর্যাদাও বেশি। স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা, শক্তি-সামর্থ্যে ভরপুর যৌবনের দিনগুলো জীবনের শ্রেষ্ঠ যা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। যৌবন মানেই বন্ধু, আড্ডা, গান, মাস্তি নয়। আল্লাহ ক্ষণিকের জন্য মানুষকে তার এই বিশেষ নিয়ামত দিয়ে পরীক্ষা করেন। যারা তাতে উত্তীর্ণ হবে, তারাই সফল। আর যারা তা অবহেলা করবে, তারা চিরব্যর্থ। যে ব্যক্তি তার যৌবনকে আল্লাহর ইবাদতে ব্যয় করবেন, কঠিন কিয়ামতের দিন তিনি আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবেন। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ সাত ব্যক্তিকে তাঁর (আরশের) ছায়ায় স্থান দেবেন; যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। (এর মধ্যে) ওই যুবক, যার যৌবন অতিবাহিত হয় আল্লাহর আনুগত্যে।’ (বুখারি, মুসলিম) আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা প্রতিটি মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব। তাই তাঁর আনুগত্যেই জীবন অতিবাহিত করা যুবসমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
যুগে যুগে সব পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুবসমাজ দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসেই দেখা যায়, তাদের মুক্তি, শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যুবকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তেমনই এক যুবক ছিলেন জাতির পিতা ইবরাহিম আ:, যিনি সর্বপ্রথম নিজ গোত্রের মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। রাসূল সা: যৌবনকে মূল্যায়ন করার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বিভিন্নভাবে। সময় ফুরিয়ে আসার আগে যৌবনের কদর করার জোর তাগিদও দেন তিনি। যৌবনকাল মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত। এ সময় মানুষের ইবাদতের শক্তি ও সুস্থতা দু’টিই থাকে। এ সময় একজন মানুষ যতটা শুদ্ধতা ও দৃঢ়তার সাথে আমল করতে পারে, বৃদ্ধ হয়ে গেলে তা অনেক সময় সম্ভব হয় না। তাই এই মহামূল্যবান নিয়ামত কোনোভাবেই অবহেলায় কাটানো উচিত নয়। কারণ, কিয়ামতের দিন যৌবনকালের সময়ের হিসাব নেয়া হবে। (তিরমিজি)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বর্ণনা করেন- এক ব্যক্তিকে নসিহত করে রাসূল সা: বলেন, ‘পাঁচটি বিষয় আসার আগে পাঁচটি বিষয়ের মূল্যায়ন করো। ১. বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার আগে যৌবনকে; ২. অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থতাকে; ৩. দারিদ্র্য গ্রাস করার আগে স্বনির্ভরতাকে; ৪. কর্মব্যস্ততার আগে অবসরকে; ৫. মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (শুআবুল ঈমান) ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সব নবীকে যৌবনকালে নবুয়ত দান করেছেন, যৌবনকালেই আলেমদের ইলম প্রদান করা হয়।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি (মুসা আ:) যখন পূর্ণ যৌবনে পৌঁছালেন, তখন তাঁকে প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি দান করলাম।’ (সূরা কাসাস-১৪)
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপযুক্ত সময়ে বিশেষ বিশেষ নিয়ামত দান করেন। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের ওই উপযুক্ত সময় হলো যৌবনের শেষ মুহূর্ত। তাই হেলায় খেলায়, মৌজ-মাস্তিতে জীবনের সোনালি সময় নষ্ট করা সত্যিকারের মুসলমানের কাজ নয়। কুরআনে বর্ণিত আসহাবে কাহাফের সাত ধার্মিক ব্যক্তিও ছিলেন যুবক। যারা এক আল্লাহর ইবাদতে বিশ্বাসী ছিলেন। যাদের শত্রুর হাত থেকে আল্লাহ তায়ালা রক্ষা করেছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসূল সা:!) আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করেছি। তারা ছিলেন কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।’ (সূরা কাহাফ-১৩) ইসলাম গ্রহণেও যুবকরা ছিলেন অগ্রণী। বনি ইসরাইলের যুবকরাই প্রথম মুসা আ:-এর ওপর ইমান এনেছেন। রাসূল সা:-এর দাওয়াতে প্রথম শতাধিক যুবকই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আর তাদের বেশির ভাগ ছিল ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সের। ইমাম ইবনে কাসির রা: বলেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আহ্বানে সাড়াদানকারীরা বেশির ভাগই ছিলেন যুবক।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির) যুবসমাজের উচিত, ইসলামের নির্দেশনা মেনে, সুন্নাহর আলোয় যৌবনকে রাঙিয়ে তোলা এবং আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। পুরো জীবনের ব্যাপারে যদিও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে; কিন্তু যৌবনকালের ব্যাপারে বিশেষভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। রাসূল সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আদম সন্তানের দুই পা আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে এক কদমও নড়তে পারবে না: তার জীবনকাল সম্পর্কে, কিভাবে তা অতিবাহিত করেছে; তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কী কাজে তা ব্যয় করেছে, সম্পদ কিভাবে আয় করেছে আর কোন পথে ব্যয় করেছে এবং তার জ্ঞান সে সঠিকভাবে অনুসরণ করেছে কি না?’ (তিরমিজি)
কুরআনে মহান আল্লাহ সময়ের কসম করেছেন, মানুষকে অকল্যাণ থেকে বাঁচানোর জন্য সময়কে গুরুত্ব দিতে তিনি আদেশ করেছেন। যুবকরাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসেই দেখা যায়, তাদের মুক্তি, শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যুবকরাই প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। পাশাপাশি যৌবনের উত্তাল সময়েই গুনাহ ও স্খলনের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাই যুবকদের প্রয়োজন আত্মার পরিচর্যা ও পরিশুদ্ধি। চিন্তা-চেতনা ও আদর্শের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে অবাধ্য মন যেকোনো সময় বিপথগামী হয়ে ওঠে। তাই নিজেকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে উন্নত হৃদয় ও মন-মানসের অধিকারী হতে হবে। কেননা, কিয়ামতের দিন আমাদের যৌবন সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে। অন্তর পরিশুদ্ধ করার সুফল এবং কলুষিত করার কুফল বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, ‘যে তার আত্মা পরিশুদ্ধ করেছে সে-ই সফল এবং যে তার আত্মা কলুষিত করেছে সে ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সূরা আশ-শামস, আয়াত : ৮-৯)
যৌবনের উদ্যম ও শক্তিকে সঠিক পন্থায়, সঠিক কাজে ব্যয় করা হলে সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠে। কারণ, যুবকরাই চালিকাশক্তি। তারা সুসংহত হলে গোটা জাতি সুসংহত হয়, তারা পথ হারালে গোটা জাতিই পথ হারায়। প্রত্যেক যুবকের উচিত তার যৌবনকে পাপমুক্ত রেখে আল্লাহর ইবাদতে সাজানো। আল্লাহকে ভয় করা। মানুষের উপকার করা। সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা। গুনাহমুক্ত জীবন গড়তে যৌবন হিফাজত করতে হবে। হারাম কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক