শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৫ পূর্বাহ্ন

আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্য নায়ক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ

স্পোর্টস ডেস্ক :
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২

তিন যুগের শিরোপা খরা ঘোচালো আর্জেন্টিনা। ফ্রান্সকে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরল মেসি-ডি মারিয়ার আর্জেন্টিনা। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ট্রফি জিতলেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসি। তবে এই বিশ্বকাপে মেসি-আলভারেজ-ডি মারিয়াদের নামের পাশে আসবে আরো একটি নাম। তিনি আর্জেন্টাইনদের আনসাং হিরো, বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্য নায়ক দলটির গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
কাতার বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের শুরু থেকেই বল পজেশন ও আক্রমণাত্মক খেলায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল আর্জেন্টিনা। মেসি-ডি মারিয়ার আধিপত্যে প্রায় একপেশে হয়ে গিয়েছিল ম্যাচটি। কিন্তু ম্যাচের চিত্রনাট্য বদলে যায় ৬৯ মিনিটের মাথাতেই। অতর্কিতে পাওয়া পেনাল্টি যেন লাইফলাইনের মত কাজ করে ফরাসিদের জন্য। সেই পেনাল্টি থেকে গোল করেন লে ব্লুজদের স্ট্রাইকার কিলিয়ান এম্বাপ্পে। সেই রেশ না কাটতেই ৯৭ সেকেন্ডের মাথায় ফের গোল করেন তিনি। ফলে নাটকীয়ভাবে সমতায় ফেরে ফ্রান্স; খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। এই সময়েও আর্জেন্টিনা জয়ের কাছাকাছি এগিয়ে গিয়েছিল বটে। কিন্তু আবারও ভাগ্য সহায়তা করে ফরাসিদের। হ্যান্ডবলের সুবাদে পাওয়া পেনাল্টি থেকে গোল করে নিজের হ্যাট্রিক পূরণ করে আবারো ৩-৩ সমতায় ফেরান দলকে। খেলা গড়ায় পেনাল্টি শ্যুট আউটে। যেখানে আর্জেন্টিনার স্বপ্ন বাঁচানোর কঠিন দায়িত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আরোপিত হয় গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের ওপর।
পেনাল্টি শ্যুট আউটের বাকি গল্পে যাওয়ার আগে, ফিরে তাকানো যাক মার্টিনেজের ক্যারিয়ারের কঠিন দিনগুলোয়। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ প্রথম খেলেছিলেন ২০১১ সালে। সে বছরের জুনে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার গোলকিপার ওস্কার উস্তারির পরিবর্তে খেলতে ডাক পান তিনি। এরপরে দ্বিতীয়বারের মত দলে ডাক পেতে তার অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। ২০১৯ সালে জার্মানি ও ইকুয়েডরের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে ডাক পড়ে তার। কিন্তু দুটো ম্যাচের একটিতেও কোচ নামাননি তাকে, থেকে গিয়েছেন আন ইউজড সাব হিসেবে। ২০১১-২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্লাব ক্যারিয়ারেও বেশ ওঠাপড়া হয়েছে তার। ধারে খেলেছেন অক্সফোর্ড ইউনাইটেড, শেফিল্ড ওয়েডনেসডে, রোথারহাম ইউনাইটেড, ওলভারহ্যাম্পটন, গেতাফে ও রিডিং ক্লাবে। শেষ পর্যন্ত ২০২০-২১ মৌসুমে ২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে কিনে নেয় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব অ্যাস্টন ভিলা।
আর এটাই ছিল তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। সেই মৌসুমে ১৫টি ম্যাচে ক্লিনশিট ধরে রেখে নতুন রেকর্ড গড়েন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। ফলে নতুন করে জাতীয় দলের চোখে পড়েন তিনি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে ২০২১ সালে চিলির বিপক্ষে অভিষেক হয় তার। মেজর ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট কোপা আমেরিকার জন্য লিওনেল স্কালোনির ঘোষিত দলেও তিনি অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। সেই টুর্নামেন্টেই জাতীয় দলের জার্সিতে নিজের জাত চিনিয়েছেন মার্টিনেজ। সেমিফাইনালে ইকুয়েডরের বিপক্ষে ম্যাচটি গড়িয়েছিল পেনাল্টি শ্যুট আউটে।
সেই ম্যাচে ইকুয়েডরের তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেন মার্টিনেজ। কোপা আমেরিকার হাই ভোল্টেজ ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতে শিরোপা জিতে নেয় আর্জেন্টিনা। এরকম উত্তাপ ছড়ানো ফাইনাল ম্যাচেও কোনো ভুল করে সুবিধা আদায়ের সুযোগ দেননি ব্রাজিলকে। বরং ধরে রেখেছেন ক্লিনশিট। কোপা আমেরিকায় অনবদ্য পারফরমেন্সের পর জিতে নেন টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপারের পুরস্কারটিও। কোপা আমেরিকার পওে নিশ্চিত হয়েই গিয়েছিল যে বিশ্বকাপেও আর্জেন্টাইনদের গোলকিপার থাকবেন তিনিই। ততদিনে সতীর্থ ও সমর্থকদের কাছে হয়ে উঠেছেন ভরসার আরেক নাম।
বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে সৌদি আরবের কাছে হেরে যাত্রা শুরু করেছিল আর্জেন্টিনা। অবশ্য তারা ঘুরে দাঁড়ায় পরের দুই ম্যাচেই। সেই দুই ম্যাচে তেমন কোনো পরীক্ষা দিতে হয়নি মার্টিনেজকে। তার আসল লড়াই শুরু হয় নক আউট পর্বে। কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের সাথে স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচ শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছিল পেনাল্টি শ্যুট আউটে। সেই শ্যুট আউটে নেদারল্যান্ডসের দু’টি পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেন মার্টিনেজ। তার বিশ্বস্ত হাতের জাদুতে শেষ চারে পৌঁছায় আর্জেন্টিনা।
এবারে ফিরে আসা যাক ফাইনাল ম্যাচের গল্পে। ফ্রান্সের সাথে ৩-৩ সমতায় থাকা ফাইনাল ম্যাচ গড়ালো টাইব্রেকারে। প্রথম পেনাল্টি নিতে এসেছিলেন এমবাপ্পেই। পুরো ম্যাচে তিনবার তার কাছে পরাস্ত হওয়া মার্টিনেজ এবারেও ঠেকাতে পারলেন না। ওদিকে মেসিও পেনাল্টি মিস করেননি। দ্বিতীয়বারে পেনাল্টি নিতে আসেন কিংসলে কোম্যান। তার পেনাল্টিটি ঠেকিয়ে দেন তিনি। আর তাতেই আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে আসে।
নার্ভাস ফ্রান্সের হয়ে এরপর শট নিয়েছিলেন অরিলিয়েন চুয়ামেনি। কিন্তু ইস্পাত কঠিন নার্ভ নিয়ে খেলতে নেমেছেন মার্টিনেজ। ১২০ মিনিট খেলার পরেও এক সেকেন্ডের জন্য মনঃসংযোগে কোনো ব্যঘাত ঘটতে দিচ্ছেন না তিনি। স্থির হয়ে দাঁড়ালেন পোস্টের সামনে, মাইন্ড গেম খেলে ঠেকিয়ে দিলেন চুয়েমেনির শট। তার পর একটি নাচের ভঙ্গি করে সেটি উদযাপন করলেন। পরে দুটি কঠিন পেনাল্টি ঠেকিয়ে শ্যুট আউটে আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে জয় এনে দিলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজই। বিশ্বকাপের অনবদ্য পারফরমেন্সের পুরস্কার স্বরূপ এমিলিয়ানো মার্টিনেজ জিতেছেন গোল্ডেন গ্লাভস, টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপারের পুরস্কার। বিশ্বকাপের মে পা রাখার আগেই মেসির জন্যই শিরোপা জিততে চান বলেছিলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। কোপা জয়ের পর এই গোলরক্ষক বলেছিলেন মেসির জন্য জীবনও দিতে প্রস্তুত আর্জেন্টাইন দল। শেষ পর্যন্ত কথা রাখলেন তিনি। যোগ্য সতীর্থের মত নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেললেন মার্টিনেজ, মেসির হাতে এনে দিলেন বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com