বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজে মনমাতানো ক্লাস পার্টি অনুষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের সরকারের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান অধ্যাপক ইউনূসের রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ প্রধান বিচারপতির দেশমাতৃকার বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত থেমে নেই: তারেক রহমান তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সাথে জামায়াতের সৌজন্য সাক্ষাৎ চিন্ময় সমর্থক জঙ্গীদের হামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম নিহত অভ্যন্তরীণ বিষয় হস্তক্ষেপ: চিন্ময় ইস্যুতে ভারতের উদ্যোগ শাপলা চত্বরে গণহত্যায় হাসিনাসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমরা চাই না ছাত্র ভাইদের কঠোর হয়ে দমন করতে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনায় যুক্ত থাকলে ছাড় দেয়া হবে না : আসিফ মাহমুদ

চীন-সৌদি আরব আলোচনার কেন্দ্রে কি শুধুই তেল?

লরা হে :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২

বছর ছয়েক পর সৌদি আরব সফর করলেন চীনের প্রেসিডেন্ট ও দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির অত্যন্ত শক্তিশালী নেতা শি জিনপিং। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গেও মিলিত হয়েছেন তিনি। শির সৌদি সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এই কারণে যে, এই সফরের মধ্যদিয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রশ্নে চীন এবং উপসাগরীয় অঞ্চল অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ওপেকের অপরিশোধিত তেল সরবরাহ কমানোর সিদ্ধান্তকে ঘিরে যখন মার্কিন-সৌদি সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে, ঠিক এমন একটি মুহূর্তে সৌদি প্রিন্স সালমানের সঙ্গে শির মিলিত হওয়ার ঘটনা বিশ্বরাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বইকি। এই সফরের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় সৌদি মিডিয়ায় প্রকাশিত শির এক নিবন্ধে। নিবন্ধে শি লিখেছেন, ‘আরব বিশ্বের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক জোরদার করাই এই সফরের মূল উদ্দেশ্য।’ সৌদি প্রেস এজেন্সির (এসপিএ) পক্ষ থেকে জানা যায়, বেশ কিছু বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে দুই পক্ষের আন্তরিকতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে, হাইড্রোজেন এনার্জি এবং সৌদি রাজ্যের ‘ভিশন ২০৩০’ ও চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর মতো বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক অংশীদারত্ব চুক্তিতে যুক্ত করে নতুন মাত্রা। এ বিষয়গুলো ছাড়া আরও বেশ কিছু ইস্যু যে দুই পক্ষের আলোচনা ও চুক্তি-সমঝোতায় জায়গা করে নেবে, তা বলাই যায়। আমরা জানি, সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার ও ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের উৎস হচ্ছে চীন। চীন বিশ্বে জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা; আর এই তেলের শীর্ষ সরবরাহকারী হলো সৌদি। তাছাড়া সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে চীনের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। সব মিলিয়ে অর্থনীতির হিসাবনিকাশের বিচারে সৌদি-চীন পরস্পর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দুই দেশের সম্পর্ক যখন এই, তখন শির তাৎপর্যপূর্ণ সৌদি সফরে কোন কোন বিষয় গুরুত্ব পাবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় সফরের আগে থেকেই। ইউরেশিয়া গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা গবেষণা দলের প্রধান আয়হাম কামেল বলেন, ‘এই সফরে সৌদি-চীন নেতৃত্বের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো শক্তি সহযোগিতা। জ্বালানিই ঘুরেফিরে আসবে আলোচনায়।’ বিশ্ব জুড়ে সরকারগুলো সামনের দিনগুলোতে কার্বন নিঃসরণ ব্যাপকভাবে কমানোর বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নবায়নযোগ্য শক্তি বিনিয়োগ দ্বিগুণ করেছে কানাডা এবং জার্মানির মতো দেশগুলো। এই শতাব্দীর শুরু থেকেই অভ্যন্তরীণ তেল ও গ্যাসের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে ইউরোপ জুড়ে যে জ্বালানি সংকটের সৃষ্টি হয়, তাতে টেকসই জ্বালানির বিষয়ে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় দেশগুলো। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য দায়ী করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল রপ্তানিকারক রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পশ্চিমারা, যার ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হু হু করে বাড়তে শুরু করে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে ওঠে যে, তেলের বাজার ব্যাপকভাবে ঝাঁকুনি খায়। এই অবস্থায় বিশ্বের প্রতিটি দেশের অগ্রাধিকারের শীর্ষ হয়ে ওঠে ‘জ্বালানি’। জ্বালানির প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি চিন্তা-শঙ্কায় পড়ে বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো। বিশ্বের প্রতিটি দেশের মতো স্বাভাবিকভাবেই এর আঁচ পড়ে চীনেওÍযেহেতু দেশটি তেলের বৃহত ক্রেতা। মূলত এরূপ একটা প্রেক্ষাপটের হাত ধরে ক্রমবর্ধমানভাবে চীনের প্রধান অগ্রাধিকার হয়ে ওঠে ‘জ্বালানি নিরাপত্তা’।
চীনা শুল্ক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত বছর সৌদি আরব এবং চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয় ৮৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের, যা ২০২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দুই দেশের বাণিজ্যের বেশির ভাগ জুড়েই ছিল ‘তেল’। ২০২১ সালে সৌদি আরব থেকে ৪৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত তেল আমদানি করে চীন, যা দেশটি থেকে চীনের মোট পণ্য আমদানির ৭৭ শতাংশ। মজার ব্যাপার হলো, বছরটিতে সৌদি আরব চীনে যে পরিমাণে অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে, তা দেশটির বিশ্বে মোট রপ্তানির এক চতুর্থাংশেরও বেশি। এই পরিসংখ্যানকে সামনে রেখে কর্নেল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য নীতির অধ্যাপক এশ্বর প্রসাদ বলেন, ‘মূল্য এবং পরিমাণ তো বটেই, জ্বালানি সরবরাহের স্থিতিশীলতাই এখন শির প্রধান অগ্রাধিকার। এর কারণ সবার জানাÍতেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির ওপর চীনা অর্থনীতি অনেক বেশি নির্ভরশীল।’
সত্যিকার অর্থেই, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন বিদেশি তেল ও গ্যাসের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, গত বছর দেশটি যে পরিমাণ তেল ব্যবহার করে তার ৭২ শতাংশই আমদানি করা হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রেও চিত্র প্রায় একই রকম। বছরটিতে চাহিদার ৪৪ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশটি। গত অক্টোবরে ২০তম পার্টি কংগ্রেসে শি জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিত করাই হবে আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার।’ এই কথার বাস্তব চিত্রই হয়তো শির সৌদি সফর!
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের চরম ঘাটতি ও জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিশ্বের প্রতিটি দেশ চরম বেকায়দায় পড়ে যায়। আক্রমণের পরের মাসগুলোতে পশ্চিমারা রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল পরিহার করে। আশ্চর্যজনকভাবে এই সুযোগকে কাজে লাগায় চীন। নতুন ক্রেতার সন্ধানে মস্কো যখন মরিয়া, তখন রাশিয়ান তেলের অনেকটা একচ্ছত্র ক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় চীন। এভাবে চলতে থাকে মে থেকে জুলাই পর্যন্তÍরাশিয়া হয়ে ওঠে চীনের অন্যতম ও এক নম্বর তেল সরবরাহকারী। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় আগস্টে। চীনে তেল সরবরাহের শীর্ষ স্থান ফিরে পায় সৌদি আরব। ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের মিডল ইস্ট প্রোগ্রামের ফেলো আহমেদ আবোদহ মত প্রকাশ করে বলেছেন, ‘চীনের দীর্ঘমেয়াদি শক্তি সুরক্ষার চিন্তা বৈচিত্র্যপূর্ণ হবেÍসেটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, সবগুলো ডিম এক ঝুড়িতে রেখে নিজেকে অন্য কোনো শক্তি এবং ভূ-কৌশলগত স্বার্থের বন্দিতে পরিণত করার মতো অতটা বোকা নয় চীন।’ আবোদহর পরের কথাটি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘ জ্বালানির প্রশ্নে চীনের জন্য রাশিয়া যদিও সহজ ও সস্তা সাপ্লাই চেইনের অন্যতম উৎস, কিন্তু তা সত্ত্বেও চীন শুধু রাশিয়াকে ধরেই পড়ে থাকবে না। এর কারণ, কেউ পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলতে পারবে না যে, আগামী ৫০ বছরে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক এখনকার মতোই থাকবে নাকি অন্যদিকে মোড় নেবেÍচীনেরও এ কথা অজানা নয় নিশ্চয়!’ সৌদি জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমানের উদ্ধৃতি দিয়ে সৌদি প্রেস এজেন্সি অবশ্য জানিয়েছে, এই ক্ষেত্রে চীনের ‘বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য অংশীদার’ থাকবে সৌদি। ইনস্টিটিউট ফর দ্য গ্লোবাল সিকিউরিটি এনালাইসিসের সহপরিচালক গ্যাল লুফেটর মতে, ‘চীনের সঙ্গে জ্বালানি সম্পর্ক গভীর করার জন্য বেশ আগ্রহী সৌদি আরব। রাশিয়া এবং ইরানের অপরিশোধিত তেলের সুনামির মুখে চীনা বাজারের শেয়ার হারানোর বিষয়ে সৌদিরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন। এই অবস্থায় সৌদির লক্ষ্য এটা নিশ্চিত করা যে, প্রতিযোগীরা সস্তা ও সহজ মূল্যের অফার করলেও বিশ্বস্ত গ্রাহক হিসেবে সৌদির সঙ্গেই থেকে যাবে চীন।’
উল্লেখ করার মতো বিষয়, তেল সরবরাহ নিরাপত্তা ছাড়াও বেইজিংকে বড় ভূ-রাজনৈতিক সুবিধাসহ আরও একটি পুরস্কার দিতে পারে সৌদি আরব। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের কাছ থেকে তেল বিক্রির কিছু মূল্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে নিতে পারে রিয়াদ, যা চীনের জন্য বাড়তি সুবিধা এনে দেবে। এর ফলে চীনা মুদ্রার বৈশ্বিক প্রভাব সম্প্রসারণের জন্য বেইজিংয়ের দীর্ঘদিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ সুগম হবে। বেইজিং ও রিয়াদ রিপোর্টটির বিষয়ে মুখ খোলেনি যদিও, তবে উভয় পক্ষের আলোচনার টেবিলে বিষয়টি উঠবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এসব সত্ত্বেও রিয়াদ ও বেইজিংয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ সেন্টারের মধ্যপ্রাচ্য প্রোগ্রামের পরিচালক জন বি. অল্টারম্যান মনে করনে, ‘চীনকে মোকাবিলা করার অংশ হিসেবে নীতি ও অগ্রাধিকারগুলোকে পুনর্নিমাণ করছে বাইডেন প্রশাসন। এমন একটি পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে সৌদির অতি মাখামাখি সৌদি-মার্কিন সম্পর্কের দীর্ঘদিনের গভীরতাকে ফেলে দেবে প্রশ্নের মুখে। এক্ষেত্রে যে জটিলতা তৈরি হবে তা উভয় পক্ষের জন্যই পরিস্থিতিকে বেশ ফ্যাকাশে করে তুলবে।’মূলত, বাস্তবতাও বলে সেই কথাই। হয়তো-বা সৌদি আরবের নতুন সঙ্গী হয়ে উঠছে চীন, কিন্তু ওয়াশিংটনের সঙ্গে রিয়াদের পথচলা তো বহুকালের। সুতরাং, রিয়াদ-বেইজিং সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই খুব বড় করে ভাবাটা একটু বেশিই ‘তড়িঘড়ি চিন্তা’ হয়ে যায়! ( দৈনিক ইত্তেফাকের সৌজন্যে) লেখক : সিএনএনের রিপোর্টার ও ডিজিটাল প্রডিউসার ইংরেজি থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com