শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৫ অপরাহ্ন

হাসতে খেলতে শিখবে শিশু লিখতে পড়তে

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২

নতুন বছরের শুরুতে ছোট্ট ছেলেমেয়েরা নতুন শ্রেণিতে লেখাপড়া করার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিচ্ছে। চলতি ডিসেম্বরেই শুরু হবে বিভিন্ন স্কুলে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম। আজকাল সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে আগ্রহী হচ্ছেন। সন্তান পরীক্ষায় ভালো ফল করে নতুন ক্লাসে উঠবে, পরে ভালো কলেজে, ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাবে, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করবেÍএটাই তো চাওয়া বাবা-মায়ের। বিভাগীয় এবং জেলা শহরের চেয়ে ঢাকা শহরে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ-সুবিধা বেশি। সরকারি স্কুলের বাইরেও রাজধানীতে বর্তমানে বেশ কিছু নামিদামি বেসরকারি স্কুল গড়ে উঠেছে। বেশিরভাগ মা-বাবা, অভিভাবক তাদের সন্তানকে এসব স্কুলে ভর্তি করতে আগ্রহী। ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টারের অভাব নেই রাজধানী শহরে। নার্সারি, প্লে-গ্রুপ থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য রয়েছে কোচিংয়ের ব্যবস্থা। এসব সেন্টারের কোনো কোনো প্রচারপত্রে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা পর্যন্ত দেওয়া থাকে। এসব দেখে শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবকরা প্রলুব্ধ না হয়ে পারেন? ভালো স্কুলে ভর্তির প্রবল আগ্রহকে পুঁজি করে দেশব্যাপী চলছে কোচিং নামের জমজমাট ব্যবসা। শিশু ঠিকমতো হাঁটতে, কথা বলতে শেখার আগেই তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে। এ সুযোগে কোচিং সেন্টারগুলো রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিত্তশীল পরিবারের সন্তানদের নামিদামি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করা যেন একট ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অভিভাবকদের ধারণা, রাজধানীর তথাকথিত ‘এলিট’ স্কুলে একবার ভর্তির সুযোগ করিয়ে দিতে পারলে এসএসসি পর্যন্ত সন্তানের লেখাপড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যাবে। ওখান থেকে ভালো ফলাফল করে পরে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে আর ভাবনা থাকবে না। দেশের লেখাপড়ায় মফস্বলের স্কুলগুলো প্রধান ভূমিকা রাখলেও সরকারের যথাযথ নজরদারির অভাবের কারণে সেগুলো পিছিয়ে আছে। রাজধানীর সব নামকরা স্কুলেই যে দক্ষ শিক্ষক ও সঠিক পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে, এমনটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না। অথচ এ দুয়ের সমন্বয় ছাড়া একটা ভালো মানসম্পন্ন স্কুল গড়ে উঠতে পারে না। রাজধানীর অনেক সরকারি স্কুলে পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা ও অভিজ্ঞ শিক্ষকম-লী থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। অথচ বিগত দিনগুলোতে সরকারি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় ছেলেমেয়েরা ভালো ফলাফল করেছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এগিয়ে থাকত তারা। দেশের সর্বোচ্চ সরকারি পদগুলো থাকত তাদের দখলে। তখন বেসরকারি স্কুলের সংখ্যাও ছিল কম। ছিল না প্রাইভেট টিউশানি বা কোচিং ব্যবসা। শিক্ষকতা পেশাকে শিক্ষকরা নিতেন জনকল্যাণের ব্রত হিসেবে। ক্রমে বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে সংকুচিত হয়ে আসা ভালো সরকারি স্কুলের স্থান দখল করে নিয়েছে বেসরকারি স্কুলগুলো।
আজকাল কোচিং সেন্টার দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর একটা বিষফোড়া হয়ে উঠেছে। খোদ রাজধানীতে রয়েছে কয়েক হাজার কোচিং সেন্টার। সরকারি, বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জড়িত রয়েছেন এসব কোচিং সেন্টারের সঙ্গে। বিত্তশীল অভিভাবকরা সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে টাকা ঢালতে কাপণ্য বোধ করেন না। বেশিরভাগ কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা তো নির্দিষ্ট স্কুলেরও শিক্ষক। কোচিং সেন্টারের পেছনে টাকা বিনিয়োগের বিনিময়ে যদি সন্তান ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের আগাম আভাস পায়, তবে তো সোনায় সোহাগা! অথচ এ কাজটি করে তারা নিজ সন্তানের শিক্ষার গোড়ায় কুঠারাঘাত করছেন। নিজেদের কর্মব্যস্ততার জাঁতাকলে শিশুসন্তানের লেখাপড়া, মনোবিকাশের দিকটা যেন ধীরে ধীরে উপেক্ষিত হয়ে পড়েছে। সরকারি স্কুলে আজকাল শিক্ষা মন্ত্রণায়ের নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয় লটারির মাধ্যমে। ফলে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না।
নতুন শিক্ষাবর্ষে ১ জানুয়ারি স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হয় উৎসবমুখর পরিবেশে। বছরের শুভ সূচনালগ্নে শিশুর কাছে নতুন বইয়ের গন্ধ এক সুখবার্তা বয়ে নিয়ে আসে। শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে লেখাপড়ার নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাংলাদেশে সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বর্তমান সরকার প্রতিটি স্কুলে শিশুদের বিনামূল্যে বই সরবরাহ ছাড়াও বেতন ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে দুপুরের খাবার। এ নিয়ে শিশুদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যও সৃষ্টি হয়েছে। দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মধ্যেও পড়াশোনার বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশে আজও শিশুদের গমনাগমনের জন্য সর্বত্র স্কুল বাস ব্যবহারের সুযোগ গড়ে ওঠেনি। পরিবারের নিজস্ব গাড়িও বেশিরভাগ শিশুর নেই। কাজেই অনেককে রিকশা বা ভ্যানে করে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হয়। নি¤œ ও নি¤œবিত্তের অনেক শিশুকে ভারী ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে স্কুলে হেঁটে যেতে তাদের ভার বহনজনিত স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় সিলেবাসে অতিরিক্ত বই সংযোজনের কারণে শিশুকে ভারী ব্যাগ বহন করতে হচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি। কখনো শিশু শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট লেখকের গাইড বই কিনতে বাধ্য করা হয়। এমনকি নির্দিষ্ট প্রকাশকের বই শিশুদের ওপর অর্থের বিনিময়ে চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কোনো শিক্ষক যদি ক্লাসে শিশুকে পাঠ্যবই অনুযায়ী নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুটি আন্তরিকভাবে বুঝাতে চান এবং বুঝাতে সক্ষম হন, তাহলে একজন সাধারণ মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্য কোনো সহায়ক গাইড বইয়ের প্রয়োজন পড়ে না। শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষকের বকুনি, পিটুনিরও যে অভিযোগ রয়েছে, একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় তা কোনোমতে কাম্য হতে পারে না।
শিশু অবস্থায় লেখাপড়ার পরিধি যদি তার মস্তিষ্কের ওপর অধিক চাপ সৃষ্টি করে, তবে তা পরে উচ্চতর শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এ কারণেই দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষায় ভালো ফলাফল করলেও উচ্চতর শিক্ষায় তারা পিছিয়ে পড়ে। বর্তমানে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ছড়াছড়ির মধ্যেও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে উচ্চতর পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে শিশুর লেখাপড়ায় বয়সের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। কোন বয়সের শিশু কোন ক্লাসে ভর্তি হবে, তা নির্ধারণ করেন শিশুর মা-বাবা অথবা অভিভাবক, যা কাম্য নয়। বিভিন্ন বয়সের শিশু একই শ্রেণিতে পড়ায় শিক্ষার্থীদের একটি অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকার বাইরের মফস্বল শহরের সরকারি স্কুলে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগসহ অন্যান্য সুযোগ সৃষ্টি ব্যতীত ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর শিক্ষার্থীর চাপ কমানো যাবে না। শিক্ষার্থীদের বয়স ও তাদের শারীরিক-মানসিক ধারণক্ষমতার ওপর নির্ভর করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নসহ শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষিত, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের পাঠদান নিশ্চিত করতে পারলে শিশুশ্রেণি থেকেই শিক্ষা ক্ষেত্রে সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com