শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩০ পূর্বাহ্ন

নানা কারণে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসছে না

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

দেশ থেকে প্রতিবছরই টাকা পাচার হচ্ছে। মার্কিন গবেষণা সংস্থাসহ কয়েকটি বিদেশি সংস্থা থেকে প্রতিবছরই এ নিয়ে তথ্য প্রকাশ করা হলেও নানা কারণে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেরত আনার প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় অর্থপাচারের মতো অবৈধ সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির ব্যক্তি। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তারা বলছেন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা খুবই জটিল প্রক্রিয়া ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে অসম্ভব নয়। বাংলাদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার নজির আছে। এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা অর্থ ফেরত এসেছে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন দফায় সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে থাকা ২১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ফেরত আনা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফএফআই) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিএফএফআই ছাড়াও আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টার ফলে কোকোর পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা একটি জটিল প্রক্রিয়া। অর্থ পাচার হয়েছেÍএটা প্রমাণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ। তারপর দুই দেশের আদালতের বিষয় থাকার কারণে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।’ কোকোর বিষয় ছাড়াও আরও কয়েকটি পাচারের ঘটনায় মামলা চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি।
পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার পদ্ধতি: সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অর্থপাচারের ব্যাপারে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের আদালতে রাষ্ট্রপক্ষকে মামলা করতে হবে। স্থানীয় আদালতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় থাকতে হবে। আদালতের এই রায়ের কপি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে যে দেশে অর্থপাচার করা হয়েছে, ওই দেশের অ্যাটার্নি জেনারেলের অফিসকে অবহিত করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাটার্নি জেনারেল অফিসের আগ্রহের ওপর নির্ভর করে পাচারের অর্থ ফেরত আসবে কী আসবে না। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে ওই দেশের আগ্রহ থাকলে তবেই ফেরত পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে ওই দেশের আদালতে মামলা করবে দেশটির অ্যাটার্নি জেনারেল অফিস। সংশ্লিষ্ট দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা রয়েছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করবে দেশটির অ্যাটার্নি জেনারেল অফিস। পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা না থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালত থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরেই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, সবকিছু অনুকূলে থাকলে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অর্থ ফেরত আনতে ৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
তবে মামলা মোকদ্দমায় না গিয়েও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা যায়, যদি সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি কোনও জটিলতা না থাকে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দুই দেশকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হতে হবে। এক্ষেত্রে এক দেশের অ্যাটার্নি জেনারেলের অফিস থেকে অন্য দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পাসপোর্ট নম্বরসহ সুনির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করবে। ওই দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তথ্য যাচাই-বাছাই করবে। যাচাই-বাছাইয়ে তথ্যের গড়মিল না পেলেই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেও ৮ থেকে ২০ বছর লেগে যেতে পারে।
এদিকে টাকা পাচারকারীর প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও বছরে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে তার ধারণা পাওয়া যায় মার্কিন গবেষণা সংস্থাসহ কয়েকটি বিদেশি সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনে।
জানা গেছে, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পদক্ষেপ হিসেবে এ পর্যন্ত দেশে ৫০টির মতো মামলা হয়েছে। এই মামলা দুদক ছাড়াও সিআইডি এবং পুলিশের অন্যান্য বিভাগও করেছে।
বর্তমানে বিএনপির সাবেক নেতা মোরশেদ খান ও তার পরিবারের সদস্যদের হংকংয়ে পাচার করা ৩২১ কোটি টাকা ফেরত আনার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ১৬ কোটি টাকা ফেরত আনার জন্য হংকংয়ের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এদিকে অর্থপাচারের তথ্য উদ্ঘাটনে বড় ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফএফআই)। প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত ৬৮টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। টাকা পাচারের তথ্য আদান-প্রদান করার জন্যই মূলত এই চুক্তি করা হয়। যদিও টাকা পাচার থেমে নেই, বরং বেড়েই চলছে।
বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানো অনেকটা কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন তারা।
তারা বলছেন, ভারতের মতো চুক্তি করে সুইস ব্যাংকের টাকা ফেরত আনা সম্ভব। তবে তার জন্য লাগবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। একইসঙ্গে অর্থ পাচারকারীদের ওপর সামাজিক ও প্রশাসনিক চাপ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি অর্থপাচারের ফাঁক-ফোকর বন্ধ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সরকার চাইলেই পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা সম্ভব। কারণ, এখন আর সুইস ব্যাংক আগের মতো গোপনীয়তা রক্ষা করে না। তারা অনেক কিছুই শেয়ার করে। ফলে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসবে। আবার পাচারও অনেকাংশে কমে যাবে।’
জানা গেছে, চুক্তি করায় সুইস ব্যাংকে ভারতীয় হিসাবধারীদের তথ্য পাওয়া শুরু করেছে নয়াদিল্লি। ইতোমধ্যেই সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের তরফে প্রথম দফায় তথ্য ভারত সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন নিয়মিত সুইস ফেডারেল ব্যাংক ভারতকে আমানতকারীদের সম্পর্কে তথ্য দেবে। একইভাবে বাংলাদেশও সুইস ব্যাংকে রাখা টাকা ফেরত আনতে পারলে করোনার দুর্দিনে কাজে লাগবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, আমাদের সরকারের উচিত হবে, ভারতের আদলে চুক্তি করে সুইস ব্যাংকে কারা টাকা রাখছেÍতা খুঁজে বের করে তাদের আইনের আওতায় আনা।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৮’ শীর্ষক যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশি টাকায় পাঁচ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা।

 




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com