বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাস বিতরণে যত অনিয়ম আর দুর্নীতি এর দায় পুরোটাই বহন করতে হয় গ্রাহকদের। ঘটনা ঘটার পর আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে কর্তৃপক্ষ সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রাষ্ট্রীয় এসব কোম্পানির নির্বাহীরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিম্নপদস্থ কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীকে শাস্তি দিয়েই পার পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জে মসজিদে প্রাণহানির পর ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েছে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। তিতাস প্রাথমিকভাবে ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে তিতাসের সামগ্রিক কর্মকা- নিয়ে। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ঢাকা থকে যারা পর্যবেক্ষণ করে কেন তাদের কোনও শাস্তির মুখোমুখি করা হলো না। নাকি এসব দায়িত্বই কেউ পালন করে না?’
তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি সূত্র বলছে, তিতাসের প্রত্যেকটি বিভাগ দেখাশোনা করার জন্য পৃথক পৃথক বিভাগ রয়েছে। এসব বিভাগে মহাব্যবস্থাপক, উপ-মহাব্যবস্থাপকসহ কর্মকর্তারা রয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে কোনও সময়ই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। যে কোনও অনিয়ম বা দুর্ঘটনা ঘটলেই নিচের দিকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তি দিয়ে অভিযোগ উতরে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, ‘একের পর এক ঘটনা ঘটছে। আর তারা তদন্ত কমিটি আর সাময়িক বরখাস্ত করেই শেষ। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ও হয়রানি থেকেই যাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিলের সময় যেমন একের পর এক তদন্ত কমিটি করেছে তেমনি নিচের কিছু কর্মকর্তা সাসপেন্ড করেই শেষ। এদিকে বাড়তি বিল কিন্তু কমেনি। এখনও অভিযোগ আসছে বাড়তি বিলের এবং সাধারণ মানুষ বিচার না পেয়ে বাধ্য হয়ে সেই বাড়তি বিল দিচ্ছে। একইভাবে তিতাসের ঘটনাও একই নাটক। কয়েকজন সাসপেন্ড আর সেই তদন্ত কমিটি। অথচ মারা গেছে ২৮ জন, আরও ১০ জনের অবস্থা আশংকাজনক। এই তো গেলো আহত ও নিহতের সংখ্যা। এদের পরিবারের সংখ্যা হিসেব করলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তারপরও কি তিতাস তাদের লিকেজ নিয়ে কিছু করবে? সারা ঢাকায় পুরনো লাইন আর লিকেজ ছড়িয়ে আছে, এর আগেও এই ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সমাধান না করলে ভবিষ্যতেও প্রাণ যাবে সাধারণ মানুষেরই। তারা শুধু তদন্ত কমিটি আর সাসপেন্ড করেই দায় সারছেন। বছরের পর বছরের ভোগান্তি আর হয়রানি রেখে দিচ্ছেন সাধারণ মানুষের জন্য।’
অতি সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিলে অনিয়ম নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় হয়েছে। প্রায় এক লাখ গ্রাহক এই বাড়তি বিলের ভোগান্তিতে পড়েন। কোম্পানিগুলো বিল ঠিক করে দেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে অনেক গ্রাহক বাড়তি বিলই দিতে বাধ্য হন। এমনকি এখন পর্যন্ত অনেক গ্রাহক বাড়তি বিলের অভিযোগ করছেন বলে জানা যায়।
এসব ক্ষেত্রেই মিটার রিডার, বিল প্রস্তুতকারীসহ সর্বোচ্চ কোনও এলাকার নির্বাহী প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু পরে যখন দেখা গেছে বিতরণ কোম্পানির ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশেই এই ভুয়া বিল করা হয়েছে তখন সমালোচনা সামলাতে নতুন তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটির কার্যক্রম আর আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, ‘রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা না থাকলে তার অধীন কর্মকর্তাদেরও দায়বদ্ধতা থাকে না। তারা জানে এত বড় অপরাধের পরও তাদের কোনও শাস্তি হবে না। সাময়িক বরখাস্ত করে পরে আবার অন্য জায়গায় তার চাকরি হবে। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কারও দায়বদ্ধতা নেই। ফলে সেই দায় গিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। হয়রানি ভোগান্তি সবই তাদের। তাদের বাড়তি বিলে দিতেই হবে, গ্যাসের লিকেজেও জীবন যাবে।’
এদিকে এসব কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তারা তাদের চাকরির নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন। কোনও ঘটনা ঘটনা তদন্ত কমিটি করা, সাময়িক বরখাস্ত করাই নিয়ম। এর বাইরে তাদের কিছু করার নেই। মন্ত্রণালয় বা তাদের ঊর্ধ্বতন সংস্থা থেকে নির্দেশনা না পেলে তারা কিছু করতে পারেন না। বিদ্যুৎ বা গ্যাসের এই চরম ভোগান্তিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ হতাশাজনক বলেও অনেকে মন্তব্য করেন।-বাংলাট্রিবিউন