শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৩ অপরাহ্ন

অর্থনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে

আহসান এইচ মনসুর
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২

অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জ বিরাজমান, তা আমাদের দেশের অন্যান্য চ্যালেঞ্জেরই একটি প্রতিফলন। যদিও আমরা অনেক ক্ষেত্রে ভালো করেছি। সেটা অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। অনেক সামাজিক সূচক সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশির ভাগই ইতিবাচক অবস্থানে আছে। আবার নেতিবাচক কিছু জিনিস একসঙ্গে নি¤œমুখী হয়েছে। সামাজিক সূচকগুলোÍযেমন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জন্ম, মৃত্যুহার ইত্যাদিতে আমরা ভালো করেছি। যদিও শিক্ষার মান উন্নয়ন হয়নি, প্রসার বেড়েছে। অর্থনীতি এবং সামগ্রিক দেশ পরিচালনার যে নীতিগুলো আছে, সেটি কিন্তু আলাদা কিছু নয়। আমাদের অর্থনীতিতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবার ক্ষেত্রে। যেমন: ইউএনও অফিস, পুলিশ প্রশাসন, ভূমি অধিদপ্তর, বিআরটিএ, পাসপোর্ট অফিস, স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি ভর্তি, হাসপাতালে বিনা পয়সার ওষুধ পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। এসব জায়গায় সীমাহীন দুর্নীতি হচ্ছে। এসবের প্রতিফলন আমরা অর্থনীতিতে দেখতে পাই। আমাদের ব্যাংকিং খাতেও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বিরাজ করছে। অনেকে বড় বড় ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। তবে অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা ঋণ নিয়ে কাজ করছেন, টাকাও ফেরত দিচ্ছেন। আবার অনেকে আছেন, যারা নিচ্ছেন কিন্তু দিচ্ছেন না। তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে তারা তা ম্যানেজ করছেন। আমরা দেখি সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। রাজস্ব আদায় বাড়ছে না, এ সমস্যা বহু দিন ধরে দেখছি। এটি প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থা দেখছি না। কাদের জন্য সরকার চুপ করে বসে আছে বুঝি না। সরকারকে তারা বিপদে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের বৈদেশিক ঋণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। একটি সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য একটি দেশের নিজস্ব সম্পদ দরকার। যে সম্পদশালী তাকে ইকোনমিক ক্রাইসেস প্রভাব ফেলে না। একটি দেশের যদি তার নিজস্ব সম্পদ বা রাজস্ব থাকে, তাহলে তাকে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয় না। তার সহনশীলতা অনেক বেশি থাকে। কিন্তু সেটা আমাদের খুব কম। আমাদের মাত্র জিডিপির সাড়ে ৯ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়। যেখানে ভারতে আদায় হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। একটি ছোট্ট বৃত্তের মধ্যে আটকে আছি আমরা। এটি আমাদের রাজস্ব নীতির ব্যর্থতা, রাজস্ব প্রশাসনের দুর্বলতা ও দুর্নীতির জন্য দায়ী। এবং এটি আমাদের অর্থনীতিকে ব্যাপক ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। সামনে আরও বেশি ঝুঁকিতে ফেলবে, যদি আমরা এ থেকে বের হয়ে না আসতে পারি।
আমাদের কোনো উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ভালোভাবে অর্জন করতে সক্ষম হবো না। আমরা টাকা পাব কোথায়? আমরা ধার করে অনেকগুলো বড় প্রকল্প করছি। আর কত? গত সাত-আট বছরে আমাদের বৈদেশিক ঋণ তিন গুণ বেড়ে গেছে। আরও তিন গুণ বাড়লে কি অবস্থা হবে। আলটিমেটলি আমাদের বেশির ভাগ অর্থায়ন আমাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়েই করতে হবে। গত বাজেট ও এর আগের বাজেটের কথা যদি ধরি, আমাদের সার্বিক যে উন্নয়ন বাজেট, সেটা ঘাটতি অর্থায়নের চেয়েও ছোট। তার মানে আমি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পুরো টাকাটাই ধার করছি। এটি একটি সুস্থ ফিসকাল ম্যানেজমেন্টের অংশ হতে পারে না। অর্থাৎ, আমার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। এ জায়গা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। ডলারসংকট ও অর্থপাচার: আমাদের যে ডলার সমস্যা, সেটা আমরা সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারছি না। চার থেকে পাঁচ মাস হয়ে গেল সমাধান হচ্ছে না। আমদানি কমিয়ে আনা হয়েছে, সেটা দরকার ছিল। ইতিমধ্যে ডলারসংকটে অনেক উন্নয়ন কাজ আটকে আছে।
আমদানি বাড়তে দিতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। আমরা বিদেশে বেশি লোক পাঠাচ্ছি। যেসব দেশে লোক যাচ্ছে, সে দেশগুলোর অবস্থা ভালো। কিন্তু রেমিট্যান্স আসছে না। অর্থনীতি ভালো, তাহলে টাকা আসছে না কেন ? অর্থাৎ টাকা পাচার হচ্ছেÍহুন্ডি বা অন্য কোনো মাধ্যমে। এটার জন্য দায়ী কারা? কেন আমরা টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। এর দুটো কারণÍএকটি হচ্ছে, টাকাটা বৈধ আয় নয়, আরেকটি হচ্ছে, দেশে রাখা নিরাপদ নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। সামনে নির্বাচন। সে কারণে টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। যারা অনিয়ম করে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়েছে, তারা টাকা শোধ করবেÍনা বাইরে পাঠিয়েছে, আমরা কি খোঁজ নিয়েছি? মানুষ জানতে চায় টাকা দেশে আছে, তা সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ায় হোটেল কিনে রাখা হয়েছে, নাকি আমেরিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব চলতে থাকলে অর্থনৈতিক সংকট কাটবে না। বিদেশে পাচারের এক টাকাও ফেরত আসেনি। কারণ, কারো বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একমাত্র খালেদা জিয়া-পুত্র কোকোর বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছিল। সে টাকা চলে এসেছে। আর কারো বিরুদ্ধে সরকার এমন জিহাদ ঘোষণা করেনি, ব্যবস্থাও নেয়নি। এজন্য টাকা ফেরত আসছে না। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়ে দিচ্ছে, কীভাবে পাচারের টাকা ফেরত আনতে হয়। আমরা তো প্রচেষ্টাই করছি না, ইচ্ছেটাই করছি না। তাহলে টাকা ফেরত আসবে কী করে?
সার্বিকভাবে আমি বলব, বাংলাদেশ সামনের দিকে এড়িয়ে যাচ্ছে, আরও যাবে। এটা প্রত্যাশা করি। বাংলাদেশ এখন যথেষ্ট শক্তিশালী ও দৃঢ়অবস্থানে আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্ভিক্ষ হবে। আমি বলব, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। এখনো শূন্য। এ আত্মবিশ্বাসের কারণ, আমরা এখন ১৯৭৪ সালে নেই। আমরা ৯৫ শতাংশ ধান উৎপাদন করি। ৫ শতাংশ আমদানি করার সে সক্ষমতা আমাদের আছে, সে রিজার্ভও আমাদের আছে, সে অর্থনীতি বাংলাদেশের আছে। আমরা এক বিলিয়নের নিচে রপ্তানি করি না। আমরা ৫২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করি। তবে দীর্ঘমেয়াদিভাবে আমাদের প্রকল্পগুলো শেষ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতি করতে হবে, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। দৈনিক ইত্তেফাকের আজ জন্মদিন। এ উপলক্ষে দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাটির প্রতি রইল আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। ইত্তেফাক সুনামের সঙ্গে সামনের দিনগুলিতেও যেন পাঠকদের তথ্যসেবা দিয়ে যেতে পারে, এই কামনা রইল। ( সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক) লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com