শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৫ পূর্বাহ্ন

মোগলদের আত্মা দিয়ে কেনা শহর লাহোর

শানজিদ অর্ণব
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২৩

আমরা লাহোর কিনেছি আত্মা দিয়ে, আমরা জীবন দিয়েছি এবং আরেকটি স্বর্গ এনেছি। মোগল শহর হিসেবে লাহোরের দিকে তাকালে সবার আগে চোখে ভেসে উঠবে লাল ইটের অসামান্য এক স্থাপনাÍবাদশাহি মসজিদ। লাহোর দুর্গের দিকে মুখ করে আছে এ মসজিদ। উঁচু মিনার, গোলাকার গম্বুজ আর বিস্তৃত চত্বর নিয়ে মসজিদটি আজও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক স্থাপনা। কালে কালে লাহোরের মোগল ইতিহাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে বাদশাহি মসজিদ। কিন্তু এর নির্মাণপর্বে জড়িয়ে আছে মোগল ইতিহাসের এক রক্তাক্ত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের অধ্যায়।
১৬৪৬ থেকে ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে লাহোরের গভর্নর ছিলেন মোগল সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শুকো। তার মেয়াদের শেষদিকে তিনি জয়পুর থেকে লাল ইট আনিয়েছিলেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। দারার প্রিয় সুফি সন্ত মিঁয়া মীরের সমাধি থেকে লাহোর দুর্গ পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করতে দারা এ ইট আনিয়েছিলেন। দারার স্ত্রী নাদিরা বেগম সমাহিত আছেন মিঁয়া মীরের সমাধি চত্বরে। দুটি সমাধির বিন্যাস এমন যে মিঁয়ার কবর যেখানে শেষ সেখান থেকেই এই শাহজাদির কবর শুরু। এ বিন্যাসের প্রতীকী মূল্য আছেÍবিষয়টি এমন যে নাদিরার মস্তক মিঁয়ার চরণে। লাহোরের নওলাখা বাজারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দারা শুকোর নাম। এখন কেউ গেলে এখানে দেখবেন কামার আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের দোকানপাট। কিন্তু এককালে এখানে ছিল মোগলদের বাগান। মোগলদের বাগানের কারণেই লাহোর একসময় ‘বাগানের শহর’ নামে পরিচিত ছিল। এ বাগানে দারা ৯ লাখ রুপি খরচ করে একটি প্যাভিলিয়ন তৈরি করিয়েছিলেন, আর সেখান থেকেই এ এলাকার নাম হয় নওলাখা।
জাহাঙ্গীরপুত্র শাহজাহান মোগলদের রাজধানী লাহোর থেকে দিল্লিসংলগ্ন শাহজাহানাবাদে স্থানান্তর করেন। স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় লাহোরের জৌলুস হ্রাসের আশঙ্কা ছিল। সে রকমটা হয়েছেও, তবে চূড়ান্ত রকম হয়নি শাহজাদা দারা শুকোর কারণে। প্রথমত, দারার উদ্যোগে লাহোর তখনো মোগলদের রাজনৈতিক পরিকল্পনায় উপস্থিত ছিল। শুরুর গল্পে ফেরা যাক, ভাই আওরঙ্গজেবের হাতে দারা নিহত হলেন ১৬৫৯ সালে। রাজস্থান থেকে আনানো লাল ইটগুলো তখনো ব্যবহার করা হয়নি। আওরঙ্গজেবের নির্দেশনায় সেই ইট দিয়ে নির্মিত হয় বাদশাহি মসজিদ।
মোগলদের হাতে বিকশিত নগরগুলোর অন্যতম লাহোর। এ শহরের শাহদারায় শুয়ে আছেন জাহাঙ্গীর। আছে বাদশাহি মসজিদ। ১৫২৪ থেকে ১৭৪৮Íএ দীর্ঘ সময় লাহোর ছিল মোগলদের শাসনাধীন। এ সময়কালে লাহোর ছিল পাঞ্জাবের সাংস্কৃতিক রাজধানী। দিল্লি ও আগ্রার সঙ্গে মোগলদের সবচেয়ে বড় শহরগুলোর একটি। আকবর মোগলদের রাজধানী নিয়ে এলেন লাহোরে। তার এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কৌতূহল রয়েছে। আবুল ফজলের বিবরণী অনুসরণ করলে দেখা যায়, বৈরাম খান লাহোরের বণিকদের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এর ফলে তিনি লাহোরের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। পশ্চিম দিক থেকে আসা নানা ঝামেলা মোকাবেলায় লাহোর তখন মোগলদের জন্য উপযুক্ত স্থান। ১৮ বছরে পা রাখা আকবরের গুপ্তচররা খবর দিলেন বৈরামের উদ্দেশ্য খুব একটা সরল নয়। আকবর বৈরাম খানকে জানিয়ে দিলেন এবার তিনি নিজের মতো চলবেন, তার অভিভাবকত্বের আর দরকার নেই। আকবর বৈরাম খানকে পরামর্শ দিলেন মক্কা গিয়ে বাকি জীবন আল্লাহর প্রার্থনায় দিন গুজরান করার। মাসে বৈরামের জন্য ৫ হাজার রুপির পেনশনও নির্ধারণ করে দিলেন। এরপর দুটো ঘটনা ঘটে। মক্কা যাওয়ার জন্য জাহাজে চড়ার পথে এক আফগানের হাতে খুন হন বৈরাম, অন্যদিকে লাহোরে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বণিককে গ্রেফতার করা হয়। প্রমাণ না থাকলেও বোঝা যায় এসব হয়তো আকবরের অঙ্গুলি হেলনেই ঘটছিল। দরবার থেকে ধর্মীয় শেখদের বের করে দিয়ে আকবর তার ক্ষমতাকে একচ্ছত্র করে তুললেন। অবশ্য বৈরামের প্রভাব থেকে আকবরের তখনো মুক্তি মেলেনি। বৈরামের এক ভক্তের দাস তীর ছুড়লেন আকবরের বুকে। আঘাতপ্রাপ্ত হলেও বেঁচে যান আকবর, হত্যা করা হয় সেই আততায়ীকে। বৈরাম খান এবং তার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা আকবরের পথ থেকে উচ্ছেদ হলে কাবুল থেকে আকবরের এক ভাই হাকিম মির্জা নজর দিলেন লাহোরের দিকে। কাবুলের আরো কয়েকজন দক্ষ সামরিক নেতাও ছিলেন তার সঙ্গে। আকবর তৎক্ষণাৎ বড় এক সেনাদল নিয়ে লাহোর রওনা হলেন। তার সেনারা লাহোর ও সংলগ্ন এলাকা ঘিরে ফেলে। কাবুল সেনারা যা বোঝার বুঝে নেয়, তারা উল্টো পায়ে কাবুল ফিরে যায়। ১৫৬৯ সালে লাহোরের যেন নতুন জন্ম হলোÍআকবরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এল শহর।
কাবুল থেকে আসা ঝামেলা, হুমকি পিছু ছাড়ছিল না। ১৫৮২ সালে আকবর সিদ্ধান্ত নিলেন রাজধানী নিয়ে যাবেন লাহোরে। ফতেহপুর সিক্রিতে আকবরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিন জেসুইট পাদ্রি। তারাও সিদ্ধান্ত শুনে আকবরের সঙ্গে লাহোর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফতেহপুর সিক্রি থেকে লাহোরে রাজধানী স্থানান্তরের কাফেলা ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। হাজার হাজার হাতির বহর নিয়ে রওনা হন আকবর। সে যেন এক চলমান শহর।
পর্তুগাল থেকে আসা জেসুইট পাদ্রিরা লাহোরের বর্তমান তেহসিল বাজারের কাছে তাদের আবাস গড়েছিলেন। চক টাকশালীতে তারা একটি কাঠের গির্জা নির্মাণ করেন। সেটা আবার শাহজাহান পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমানে একই স্থানে একটি ছোট গির্জা আছে। সেই সময় পুরনো লাহোর ঘিরে ছিল কাদার দেয়াল। সুলতানি আমলের লাহোর দুর্গের অনেক দেয়ালও ছিল মাটির। কাবুল থেকে আসা আক্রমণ প্রতিহত করতে আকবর লাহোর দুর্গকে স্থাপনা হিসেবে শক্তিশালী ও সামরিক সুবিধাসম্পন্ন করার পরিকল্পনা হাতে নেন। এমন সময় আবার লাহোরে হানা দেয় দুর্ভিক্ষ। আকবর শাসক হিসেবে দক্ষতা দেখালেন। ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্যের বিনিময়ে ইট তৈরি এবং শহর ও দুর্গে ইটের দেয়াল নির্মাণে কাজে লাগালেন। এ কাজের বিনিময়ে সবাইকে দিনে দুই বেলা খাবার দেয়া হতো। দুর্ভিক্ষ থেকে এভাবে লাহোরের ইতিহাস নতুন পর্বে প্রবেশ করে। লাহোর দুর্গ শক্তিশালী সামরিক স্থাপনা হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তা এ শহরে মোগলদের প্রতিষ্ঠাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়।
১৫৯৮ সালে আকবর লাহোর থেকে রাজধানী নিয়ে যান আগ্রায়। প্রায় ১৪ বছর তিনি লাহোরের বাসিন্দা ছিলেন। এ সময় শহরকে বদলে দেন তিনি। আবুল ফজল আইন-ই-আকবরিতে উল্লেখ করেছেন, আকার ও জনসংখ্যার বিবেচনায় লাহোর সবচেয়ে বড় শহরগুলোর একটি।
আকবরপুত্র জাহাঙ্গীর ১৬০৭ সালে মোগল দরবার পুনরায় লাহোরে নিয়ে আসেন। এক বছর তিনি লাহোরে ছিলেন। এরপর আবার ১৬২২ থেকে ১৬২৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লাহোরে ছিলেন। লাহোরের প্রতি জাহাঙ্গীরের বিশেষ টান ছিল। তার আমলে এ শহরের জৌলুস বৃদ্ধি পায়। যখন তিনি আগ্রায় ছিলেন তখনো তিনি লাহোরের দিকে নজর রেখেছেন। ১৬১২ সালে আগ্রায় অবস্থানকালে জাহাঙ্গীর লাহোর দুর্গে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করান। এ পর্যায়ে নির্মিত হয় দৌলত খানা-ই জাহাঙ্গীরি, কালা বুর্জ ও মাকাতিব খানা। সমসাময়িক বিবরণী থেকে জানা যায় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জাহাঙ্গীরের মৃত্যু পর্যন্ত অনেক শিল্পী, চিত্রকর লাহোর দুর্গে কাজ করতেন।
১৬১৬ সালের পর লাহোরের সজ্জা আর নগরায়ণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সম্রাজ্ঞী নূর জাহান। সে বছর তার পিতা ইতিমাদ উদ দৌলাকে লাহোরের গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। পরবর্তী ১৬ বছর এ পরিবারের হাতেই লাহোরের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ছিল। নূর জাহানের পিতা ও ভাই উভয়ই লাহোরে তাদের হাভেলি নির্মাণ করেন।
১৬২৭ সালে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সময় লাহোরের আয়তন ছিল ইস্তানবুলের চেয়ে বেশি আর এর জনসংখ্যা ছিল ২০ লাখ। এ জনসংখ্যা ছিল তখনকার লন্ডন কিংবা প্যারিসের চেয়ে অনেক বেশি। জাহাঙ্গীরের পর তার পুত্র শাহজাহানও লাহোরের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেন। ১৬২৮ থেকে ১৬৩৪ সালের মধ্যে তিনি লাহোর দুর্গে অনেকগুলো নতুন স্থাপনা যুক্ত করেন। দরবারের ইতিহাসবিদ আবদুল হামিদ লাহৌরি লিখেছেন, এসবের বাইরে লাহোরে ভবন ও বাগান তৈরি করতে শাহজাহান ৫০ লাখ রুপি খরচ করেন। শাহজাহানের নিয়োগ করা লাহোরের গভর্নর ওয়াজির খান ১৬৩৪ সালে কারুকার্যময় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা এ শহরের প্রথম বড় মসজিদ। পরবর্তী সময়ে আওরঙ্গজেব নির্মাণ করেন বাদশাহি মসজিদ, যার ইতিহাস নিয়ে লেখার শুরুতেই আলোচনা করা হয়েছে। তার আমলে লাহোর দুর্গে আওরঙ্গজেব নির্মাণ করান আলমগীরি ফটক, যা পরবর্তীকালে লাহোরের প্রতীক হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের পাঞ্জাবি ইতিহাসবিদ লতিফের মতে, লাহোর হয়ে উঠেছিল শিক্ষিত, কবি, লেখক, বাগ্মী, দর্শন-বিজ্ঞান বিষয়ে প-িতদের আশ্রয়স্থল। বুখারা, সামারখন্দের মতো শহর থেকে প-িতরা লাহোরে ছুটে আসতেন শিল্প-সাহিত্য চর্চায়। (সূত্র: বণিকবার্তা, সিল্করোড) লেখক: শানজিদ অর্ণব: লেখক ও অনুবাদক।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com