বিভিন্ন সঙ্কটে বিপন্ন দেশ ও বিপর্যস্ত দেশের জনগণ। এর মধ্যে অর্থনৈতিক সঙ্কট, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ আরোপ- এই তিনটি অন্যতম। আজকের আলোচনায় আমরা এই তিনটি সঙ্কটের মাত্রা, দেশের ওপর তার প্রভাব ও সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে আলোচনা করব।
বিধ্বস্ত অর্থনীতি, বিপর্যস্ত দেশ: ডন লুচ্চেসের বিখ্যাত উক্তি ছিল- ‘অর্থনীতি একটি বন্দুক। রাজনীতি জানে, কখন ট্রিগার টানতে হবে।’ উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে অচলাবস্থা ও সামাজিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা থাকলেও অর্থনৈতিক সঙ্কট বাকি দু’টি সমস্যাকে ছাড়িয়ে বড় সঙ্কটের দ্বারপ্রান্তে। অর্থনীতি বিষয়টি জটিল। সাধারণ মানুষ এর হিসাব-নিকাশ খুব কমই রাখে; কিন্তু তাদের জীবনে এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয় প্রতিদিন। সু-অর্থনীতি জনগণের জীবনে আনে সুখ ও সমৃদ্ধি। আর কু-অর্থনীতির দাপটে তাদের জীবন হয় দুঃখ ও কষ্টের। সামগ্রিকভাবে এর প্রভাবে অর্থনীতি হয় বিধ্বস্ত। দেশ হয় বিপর্যস্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির সঙ্কটের মূল কারণ মূলত করোনা অতিমারী নয়। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও দেশের অর্থনীতির সঙ্কটের অন্যতম উৎস নয়; বরং এ যুদ্ধ কেবল সঙ্কটের মাত্রাকে বৃদ্ধি করেছে মাত্র। সঙ্কটের কারণগুলোর সূচনা হয়েছে আরো আগেই; তার একটি উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যা একের পর এক জটিল সঙ্কটের মুখে। রাজনীতিবিদরাও স্বীকার করছেন, ব্যাংকিং খাত থেকে যে পরিমাণ অর্থ লুট হয়েছে, ‘ব্রিটিশরাও এভাবে এ দেশ লুট করেনি’। শেয়ার বাজার লুট ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতে দুর্নীতি ইত্যাদিও দেশের সঙ্কটের অন্যতম। শেয়ারবাজারে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্পর্কে নিরাশ করে তুলছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট সবচেয়ে প্রবল হয়ে উঠছে বৈদেশিক বাণিজ্য, লেনদেন ও বিনিময় হারের ক্ষেত্রে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। এর প্রায় সবই অভ্যন্তরীণ সঙ্কট, বৈশ্বিক নয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যে উত্তাপ-উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে তা বিশ্বপরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলছে; এ কথা সত্যি। দেশের ডলার ক্রাইসিস, জ্বালানি খাতে দুর্নীতি, সার আমদানি এবং গম সরবরাহের ওপর প্রভাব ফেলেছে এই যুদ্ধ। জ্বালানি খাত নিয়ে অতীতে সমালোচনা ও সাবধানবাণীকে ক্ষমতাসীনরা যেভাবে অগ্রাহ্য করেছে, তাতে তাদের কথিত উন্নয়নের কথাবার্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, সরকারের উন্নয়ন-নীতির সুবিধাভোগীরাও এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইছিলেন না। অথচ ২০২২ সালে এসে এসব খাত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈদেশিক খাত ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষের ৪৫.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বৈদেশিক রিজার্ভ ২৬ শতাংশ কমে ৩৩.৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। নিট হিসাবে এই রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারের কোটায় এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এর চেয়েও কম বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। ডিসেম্বরে অবশ্য অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মাত্র ১০ মাসে ডলারের বিনিময় হার ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১০৫ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ সবের প্রতিক্রিয়ায় সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বহুজাতিক আর্থিক সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু গত ছয় বছরে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়াও যে এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের একটি কারণ, তা উপলব্ধি না করলে এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হবে, এমন আশা করা যায় না।
রেমিট্যান্সেও ভালো খবর নেই। ২০২০-এর ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২২-এর ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স কমেছে ১৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৮.৮ বিলিয়ন ডলার, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ২.১ শতাংশ বেশি হলেও তার আগের বছরের চেয়ে ১৯ শতাংশের মতো কম। এই সঙ্কটেও বাংলাদেশের রফতানি আয় কিছুটা সন্তোষজনক। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭.৩১ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ১০ শতাংশ বেশি। তবে এই রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি যতটা না পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তার চেয়ে বেশি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক খাতের সঙ্কট ঘোচানোর জন্য শুরু থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়া হয়। এর ফলে চলমান অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ২৭.৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ৬.৭২ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে ৭০ থেকে ৭৫ বিলিয়ন ডলার হতে পারে আমদানি ব্যয়। আর রফতানি আয় হতে পারে ৫২ থেকে ৫৫ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সের যে ধারা তাতে এটি ২০ বিলিয়ন ডলারের কোটায় থাকতে পারে। ফলে ২০২৩ সালে বৈদেশিক খাতের যে চাপ তা অব্যাহত থাকতে পারে। একই সাথে বাংলাদেশী টাকা ডলারের বিপরীতে আরো মান হারাতে পারে। বৈদেশিক খাতে চাপ সৃষ্টির একটি বড় কারণ হলো সরকারি-বেসরকারি বৈদেশিক ঋণ। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ৯৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৮৩ বিলিয়ন ডলারের মতো। বাকিটা স্বল্পমেয়াদি ঋণ। মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে ২০২৩ সালে সরকারি খাতে ২.৫ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি খাতের ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে। ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটের মুখে সরকার তেল রফতানিকারক দেশ সৌদি আরব, কাতার ও কুয়েতের কাছ থেকে জ্বালানি তেল বিলম্বে পরিশোধের শর্তে সরবরাহ পাওয়ার চেষ্টা করছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে জ্বালানি তেল আমদানির নতুন ঋণপত্র স্থাপন ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২.৬২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে এই খাতের ঋণপত্র নিষ্পত্তি ১১১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৯৭ বিলিয়ন ডলারে। পেট্রোলিয়াম খাতের এভাবে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপর। রাশিয়ার কাছ থেকে বিলম্বে পরিশোধ অথবা পণ্য বিনিময় ভিত্তিতে জ্বালানি সংগ্রহের বিকল্পকে সামনে রাখা হচ্ছে। ব্যাংক খাত ২০২২ সালের শেষার্ধে চাপে পড়ে যায়। বছরজুড়ে কয়েকটি ব্যাংকে বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটলেও শেষ দিকে এসে আলোচনায় স্থান পায় চারটি ইসলামী ব্যাংকের বৃহৎ কেলেঙ্কারি। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে এমনকি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে একটি প্রভাবশালী গ্রুপ। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হলেও দেয়া হয়েছে নানা ধরনের নীতিসহায়তা। এই সংবাদ প্রকাশিত হলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ব্যাপকভাবে আমানত উত্তোলন শুরু হয়। এভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকায়। কেবল ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৩১ হাজার কোটিতে দাঁড়িয়েছে। তবে আইএমএফসহ অনেকেই মনে করে, অবলোপনকৃত ঋণ, মামলার মাধ্যমে নিয়মিত করে রাখা আদায় অযোগ্য ঋণ এবং কৃত্রিমভাবে নিয়মিত দেখানো ঋণ হিসাব করা হলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে মারাত্মক খবর হলো- এক লাখ ১৮ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদৌ আদায়যোগ্য নয়। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক সঙ্কট সৃষ্টি করছে, এর ফলে বিরাজমান ডলার সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। এ দিকে, ব্যাংকগুলো ডলার সঙ্কটের কারণে ঋণপত্রের দায় শোধে অপারগ হয়ে পড়লে বৈশ্বিক রেটিং সংস্থা মুডিস ব্যাংকের ঋণমানের অবনয়ন শুরু করে। দেশের গমের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ এবং ভুট্টার এক-পঞ্চমাংশ আসে ইউক্রেন থেকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যাতে সমস্যা হচ্ছে। বিশ্বের বেশির ভাগ সার রফতানি করে রাশিয়া ও বেলারুশ। রাশিয়ার ওপর রফতানি নিষেধাজ্ঞার কারণে সার সংগ্রহে সমস্যা হবে। ফলে এ বছর কৃষিপণ্য উৎপাদনে সমস্যা না হলেও আগামীতে কৃষককে সময়মতো সার সরবরাহে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে রাশিয়া বছরে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি তৈরী পোশাক আমদানি করে। রাশিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংককে বৈশ্বিক আন্তঃব্যাংক লেনদেন সংক্রান্ত সুইফট সিস্টেমে নিষিদ্ধ করায় বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি হুমকির মুখে পড়েছে। যে সব তৈরী পোশাকের অর্ডার শিপমেন্ট হয়েছে তার পেমেন্ট পাওয়াও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। দেশের বর্তমান অর্থনীতির সঙ্কটের একটি খুব বড় কারণ দুর্নীতি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল। অথচ ২০১৪ সাল থেকে গত আট বছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করে চলেছে। সব মিলিয়ে বিগত প্রায় ১৫ বছরে অর্থনীতিতে দুর্নীতি, অর্থপাচার ও নৈরাজ্যের চিত্র ভয়াবহ। এর মধ্যে মেগা প্রজেক্টের নামে মেগা দুর্নীতি অন্যতম। দুর্নীতির মহাস্মারক হিসেবে স্থাপিত পদ্মা সেতু। রূপকথাকে হার মানানো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেলেসমাতি। রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র ও পায়রা বিদ্যুৎপ্রকল্পের অচিন্তনীয় দুর্নীতি। রেল ও সড়ক নির্মাণে বৈশ্বিক রেকর্ড সৃষ্টিকারী অপচয়। প্রতিটি কাজ ও টেন্ডারে হয়েছে লুটপাটকারীদের মহোৎসব। শেয়ার বাজারের মহাকেলেঙ্কারি। জ্বালানি সঙ্কটে মহাদুর্নীতি। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি হয়ে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে। অনিয়মের আরেকটি উদাহরণ হলো দেশের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত ও প্রশংসিত ইসলামী ব্যাংকের জবর দখল।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭-৯ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এর সাথে আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রফতানির আন্ডার ইনভয়েসিং ও রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনা, ইত্যাদির কারণে প্রতি বছর কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। স্মর্তব্য, দেশ থেকে বছরে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে। বিশ্ব অর্থনীতি নিয়েও কোনো ভালো পূর্বাভাস নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগ্রাসীভাবে চলতি বছরেই ছয়বার নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। তারপরও মূল্যস্ফীতি তেমন কমছে না। দেশের মূল্যস্ফীতি বর্তমানে হার ৯ দশমিক ১ শতাংশ। বর্তমানে ডলারের দর গিয়ে ঠেকেছে ১০৭ টাকায়। অধিকন্তু, বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অস্থিতিশীল দেশের রাজনীতি: প্রবাদ অনুযায়ী ‘রাজনীতি জানে কখন অর্থনীতির বন্দুকে ট্রিগার টানতে হবে।’ সঙ্গত কারণে প্রশ্ন জাগে, দেশের চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে তাহলে কি রাজনীতিই একমাত্র সমাধান? ২০২৩ সাল দেশে জাতীয় নির্বাচনের বছর। নির্বাচনী সঙ্কটের সুরাহার কোনো আলামত রাজনীতিতে নেই। নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে মীমাংসা না হওয়ায় ভোট যতই এগিয়ে আসছে, ততই রাজনীতিতে উত্তাপ বাড়ছে। সরকারি দল যেমন বর্তমান সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন করতে চায়, বিরোধী দল তেমন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করাতে চায়। এই লড়াইয়ে মিত্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে তারা। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে সরকার একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেই চূড়ান্ত আন্দোলনে নামবে তারা। ফলে দেশের সঙ্কট নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে আগানোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সরকারবিরোধী যেকোনো আন্দোলন শক্ত হাতে মোকাবেলার কথাই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে সরকার দল থেকে। প্রশাসনের ওপর সরকার দলের শক্ত প্রভাব থাকায় আগামী দিনে বিরোধী দল নিয়ন্ত্রণ কৌশল হতে পারে তাদের দিয়েই। চলমান পরিস্থিতিতে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে বাংলাদেশকে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। সাধারণ জনগণ সঙ্ঘাতের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। একদিকে সরকার বলছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে ২০২৩ সাল আরো কঠিন হতে পারে, অন্য দিকে জোরদার হচ্ছে- একটি রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের ঝুঁকি। ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল সবাই জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে গেলেও এখন ঘটনাচক্রে জনগণের মুখোমুখি হয়েছে। এ সময়ের বাস্তবতায় বিরোধী দল অনেকটা সুবিধাজনক জায়গায় আছে। সরকারি দল যে, কিছুটা অস্থিরতার মধ্যে আছে, তা তাদের কণ্ঠের শব্দমালা ও দেহভঙ্গিমায় বোঝা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা অনেকে নানা ক্ষেত্রে সরকারি দলের নেতা-নেত্রীর দাম্ভিক আচরণ, বিশেষ করে দুর্নীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার জন্য সরকারি দলের কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে জাতিসঙ্ঘের রয়েছে উদ্বেগ। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট, বিশেষ করে রাজনৈতিক সঙ্কটের সুযোগে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক মহল। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর উন্নত বিশ্বের বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব খাটানোর চর্চা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যেন বৈধতা পেয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের সুযোগে তা অনেক বছর থেকেই বেশি মাত্রায় ছিল, এখন তা মাত্রা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে প্রকাশ্যে বাগযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। দুই পরাশক্তির পেছনেই নিজ নিজ বলয়ের দেশগুলোর সমর্থন রয়েছে প্রকাশ্যে। ইতোমধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব বাহিনী ও ওই বাহিনীর বর্তমান এবং অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সাত কর্মকর্তার ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। আরো বড় ধরনের অবরোধ আসার আশঙ্কা রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এতে আন্তর্জাতিকভাবে আস্থার সঙ্কটে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে দেশটির।
বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক গিউয়েন লুইস আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করছি এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দের সরকার গঠন করতে পারবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও উদ্বেগ জানানো এবং কোনো ধরনের দমন-পীড়ন ও বাধা ছাড়াই বিরোধী দলগুলোর প্রচারণা চালানোর নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানাই।’ গিউয়েন লুইস বলেন, ‘গত মাসগুলোতে মানুষ আহত হয়েছেন, প্রাণও হারিয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা উদ্বিগ্ন (কনসার্নড)।’ এ পরিস্থিতি থেকে জনগণকে রক্ষা করতে প্রত্যেকটি দল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য অংশীজনের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে জাতিসঙ্ঘ। তবে সরকার জাতিসঙ্ঘের এই কর্মকর্তার উদ্বেগ বিবেচনায় নিচ্ছে না বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গিউয়েন লুইসের উক্তির উদ্বেগ শব্দ নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘কনসার্ন অনেক কঠিন শব্দ। গৃহযুদ্ধ অথবা যে ক্ষেত্রে প্রতিদিন অনেক মানুষ সহিংসতায় মারা যাচ্ছে তেমন অবস্থার ক্ষেত্রে কনসার্ন শব্দ প্রয়োগ করা হয়। বাংলাদেশে পরপর দু’টি সাধারণ নির্বাচন যেহেতু খুব ভালোভাবে হয়নি এবং দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে বলা যেতে পারে যে, এখানে অনিশ্চয়তা রয়েছে।’ জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধির মুখ থেকে এই শব্দ ব্যবহারের একটি বার্তা আছে। আমার মনে হয়, তিনি এই শব্দ ব্যবহার করে সরকারকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন যাতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়; আবার পুলিশও যেন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে।
বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির দিকে নজর রয়েছে বহির্বিশ্বেরও। ২০২৩ সালে এই নজরদারি আরো বাড়তে পারে। বিগত দু’টি জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে প্রভাবশালী বেশ কিছু দেশ ও সংস্থা আগামীতে বাংলাদেশে একটি ‘নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন দেখতে চায়। নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর এক ধরনের প্রচ্ছন্ন চাপও ইতোমধ্যে তৈরি করেছে তারা। এই চাপ নতুন বছরের রাজনীতির গতিবিধিতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে পরাশক্তির মধ্যে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তা সতর্কতার সাথে সামাল দিতে হবে। বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই পরাশক্তির ‘শক্তি পরীক্ষার মাঠে’ পরিণত না হয়। সর্বোপরি বলতে হয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক এই তিনটি চাপেরই দেশের নিজ নিজ সেক্টরে বেনিফিশিয়ারি রয়েছে। তবে তিনটি চাপেরই আলটিমেট ভিকটিম দেশের অসহায় জনগণ এবং বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে দেশের; সতর্ক হই, দেরি হওয়ার আগে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com