সাবধান! ‘শয়তানের শ্বাস’ নিঃস্ব করতে পারে যে কাউকে। সাম্প্রতিক সময়ে শয়তানের শ্বাস ব্যবহার করে ছিনতাই শুধু ছিনতাই নয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও নিজের নামে লিখে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। এই চক্রের উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় পথেঘাটে ঘটছে অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনা। প্রায়ই তাদের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন পথচারীরা। পথেঘাটে, বাজারে, পাড়ার অলিগলি, স্বর্ণের দোকানের আশেপাশে এবং বিভিন্ন মার্কেটের বাইরে এসব চক্রের আনাগোনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তারা প্রকাশ্য বিশেষ ড্রাগটি ব্যবহার করে মানুষকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে টাকা-গহনা দামী মোবাইল নিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ ব্যবহার করে অনেক মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে র্যাব এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছিল। ওই প্রতারক কাজ করতো এক নারী উদ্যেক্তার সঙ্গে। ওই নারীর একটি রেস্টুরেন্ট, ১টি কনসালটেন্সি ফার্ম ছাড়াও আরও কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। তিনি নিজেই ব্যবসা পরিচালনা করতেন। কিন্তু ওই প্রতারক বিশেষ ড্রাগ ব্যবহার করে ওই নারীকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে লিখে নেয় একটি এক্সিও গাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্বর্ণালঙ্কার, নগদ ১৫ লাখ টাকাসহ আরও অনেক কিছু। শুধু তাই নয় অন্তত ৫ মাস ওই নারীকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখে। পরে ওই নারী প্রতারকের কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় তাকে র্যাব গ্রেপ্তার করে।
একটি জাতীয় দৈনিক সূত্রে প্রকাশ,সাতষট্টি বছর বয়সী আলেয়া বেগম। থাকেন ঢাকার কল্যাণপুরের ১১ নম্বর সড়কের একটি বাসায়। বাসার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে প্রায়ই তিনি মুদির দোকানে যান। গত ২৫শে ডিসেম্বর তিনি পণ্য কিনতে বাসার পাশের একটি দোকানে যাচ্ছিলেন। এ সময় অজ্ঞাতনামা বোরকা ও মাস্কপরা এক নারী তার কাছে এসে কিছু একটা বলে পশ্চিম আগারগাঁওয়ের একটি বাসার গ্যারেজে নিয়ে যায়। তারপর তার সঙ্গে ঘটে যায় সিনেমার কাহিনীর মতো কিছু। অজ্ঞাতনামা ওই নারীর কথামতো তিনি তার গলায় থাকা ১ ভরি ওজনের একটি স্বর্ণের চেইন, ৮ আনা ওজনের এক জোড়া কানের দুল তার হাতে তুলে দেন। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই নারীর সামনে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার কথামতো আচরণ করেন। বাসায় ফেরার পর তার কথাবার্তা অগোছালো মনে হলে পরিবারের সদস্যরা তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেন। গত বছরের আগস্ট মাসে মধ্যবয়সী জাহেদা বেগম তেজগাঁও এলাকা থেকে কাওরান বাজার যাচ্ছিলেন।
তখন একজন অজ্ঞাত পুরুষ এসে তার হাতে একটি ছোট কাগজের টুকরো ধরিয়ে দিয়ে ঠিকানাটি কোথায় জানতে চান। কাগজের লেখাগুলো অনেক ছোট থাকায় জাহেদা চোখের কাছে নিয়ে তাতে কী লেখা আছে বোঝার চেষ্টা করেন। অগোছালো লেখা থাকায় তিনি বুঝতে পারছিলেন না। ততক্ষণে তাকে আরও দুজন ঘিরে ধরে। জাহেদা অন্যমনষ্ক হয়ে যান। ওই অজ্ঞাত ব্যক্তিদের কথামতো তার কাছে থাকা টাকা, মোবাইলসহ সঙ্গে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু তুলে দেন। জাহেদা বলেন, কাগজের টুকরোটি পড়ার চেষ্টা করছিলাম আমি। তখন আমার কেমন জানি মনে হলো। পরের ঘণ্টাখানেক কি হয়েছে সেটি আমি বুঝতে পারিনি। পরে যখন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলো তখন বুঝতে পারি আমার সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেছে। ডেভিল্স ব্রেথ বা শয়তানের শ্বাস বা মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ দিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটায় ছিনতাইকারী চক্র। অনেকটা অজ্ঞান বা মলমপার্টির আদলেই চক্রটি কাজ করছে। বলা হচ্ছে এটি ছিনতাইয়ের নতুন কৌশল। তবে অন্য ছিনতাইয়ের চেয়ে নতুন এই কৌশলটি একটু ভিন্ন। অন্যান্য ছিনতাইয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে জোরপূর্বক বা কিছু খাইয়ে অথবা কিছু নাকে লাগিয়ে অচেতন করে টার্গেট ব্যক্তির কাছ থেকে নেয়া হয় মূল্যবান সবকিছু। কিন্তু শয়তানের শ্বাস দিয়ে ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে পুরো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায় প্রতারক চক্রটি। বিশেষ ধরনের এই ড্রাগ যখন প্রতারকরা ভুক্তভোগীর সংস্পর্শে নিয়ে আসে তখন কিছু সময়ের জন্য ভুক্তভোগী স্বাভাবিক অবস্থায় থাকেন না। প্রতারকরা তাকে যা বলেন তিনি তাই করেন। আর এই সুযোগেই তারা ভুক্তভোগীর কাছ থেকে সবকিছু লুটে নেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই ড্রাগটি লিকুয়িড ও পাউডার জাতীয় হয়। খাবারের মাধ্যমে অথবা শ্বাসের মাধ্যমে কিংবা হ্যান্ডশেকের সময় ব্যবহার করা হয়। মূলত এটি ৬ থেকে ১২ ইি র দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করে। যার প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ১ ঘণ্টা। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীরা সম্পূর্ণভাবে প্রতারকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আবার স্কোপোলামিন খাবারের সঙ্গেও খাওয়ানো হয়। খাবারের সঙ্গে মানব দেহে গেলে এটির প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ৫ থেকে ৭ দিন। এটা প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের প্রাথমিক স্মৃতি বা ইনিশিয়াল স্টেজ অব মেমোরিকে ব্লক করে দেয়। সেইসঙ্গে ব্রেনের অংশকে আক্রান্ত করে যা তার মস্তিষ্কের চিন্তা করার অংশকে ব্লক করে দেয়। এর ফলে তার চিন্তা করার ক্ষমতা চলে যায়। কোনো প্রতিক্রিয়া বা বোধশক্তি থাকে না। আচরণ হয়ে যায় বশীভূত। চিকিৎসকরা জানান, নাসা তাদের অ্যাস্ট্রোনাটদের ওপর ০.৩৩ মিলিগ্রাম ইউজ করে তাদের মোশন সিকনেস কাটানোর জন্য। আর যেকোনো সাধারণ মানুষের ওপর যদি এর ৫-৭ মিলিগ্রাম ইউজ করা হয় তবে তাকে দিয়ে যা ইচ্ছা করানো যাবে। আর যদি ১০ মিলিগ্রাম বা তার বেশি হয় তবে রোগী কোমায় চলে যাবে এবং সেখান থেকে মারা যেতে পারে।
এদিকে, ভয়ঙ্কর এই ড্রাগ দিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতারকরা মানুষকে প্রতারিত করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এখন এসব ঘটনার তদন্ত করে কুলকিনারা পাচ্ছেন না। প্রতারকদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায়ও আনা যাচ্ছে না। এমনকি প্রতারকরা কোথা থেকে ড্রাগটি সংগ্রহ করে তারও হদিস মিলছে না। থানায় যেসব অভিযোগ জমা পড়ছে সেগুলোরও তেমন কোনো অগ্রগতি নাই। এতে করে প্রতারকরা অধরা থেকেই মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডিএমপি’র মিরপুর মডেল থানায় এ রকম অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী এক নারী। এ ছাড়া আরও কিছু অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবি’র লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, আমাদের কাছেও বেশকিছু অভিযোগ এসেছে। আমরা তদন্ত করছি। আশা করছি এই ধরনের অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে পারবো।