ভিডিওনির্ভর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে মগ্ন থাকা কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট তৈরি করতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীরা। বিশেষজ্ঞদের এই উদ্বেগে যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে টিকটক বেশ ঝামেলায় পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলাও হয়েছে।
সম্প্রতি টিকটক তার মূল প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সের সূত্রে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্য ও ফেডারেল আইনপ্রণেতাদের উদ্বেগে চাপের মুখে পড়ে। কয়েকজন আইনপ্রণেতা ও গবেষক তরুণ ব্যবহারকারীদের ওপর এই অ্যাপটির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কেও সতর্ক করেছেন। আবার টিকটক ব্যবহারকারী তরুণেরাও এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে বলেছেন। যেমন ২৩ বছর বয়সী ইয়াঙ্কি বলেছেন, ‘টিকটক ব্যবহারের কারণে আমি আমার জীবন নিজের মতো করে গড়ার চেষ্টা করছিলাম না। আমি যা দেখছি, তা ধরেই বাঁচতে চেষ্টা করেছি। আমার ঘুম হতো না। পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছিলাম এবং বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশাও বন্ধ হয়ে যায়। অ্যাপটি মুছে ফেলার পর, আবার নিয়মিত ঘুম আসতে শুরু করল। তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গিয়ে সকালে উঠলে কর্মক্ষমতাও ভালো থাকে।’
এদিকে রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান মাইক গ্যাল্লাঘের সম্প্রতি টিকটককে ‘ডিজিটাল ফেনটানিল’ অভিহিত করে বলেছেন, এই অ্যাপ আমেরিকার তরুণ-তরুণীদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
অন্যদিকে গত মাসে ইন্ডিয়ানা রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল টিকটকের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছেন। একটি মামলায় তিনি অভিযোগ করেছেন, অ্যাপটি ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী ব্যবহারকারীদের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ—এই মিথ্যা দাবি করে শিশুদের প্রলুব্ধ করছে।
অলাভজনক একটি সংস্থা এক সমীক্ষার বরাতে বলেছে, একটি অ্যাকাউন্ট খোলার কয়েক মিনিটের মধ্যে টিকটক কিশোর-কিশোরীদের জন্য আত্মহত্যা ও ক্ষুধামান্দ্য–সম্পর্কিত সম্ভাব্য ক্ষতিকর আধেয় বা কনটেন্ট দেখাতে পারে। টিকটকই একমাত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়, কিশোর-কিশোরীদের ওপর যেটির প্রভাব সম্পর্কে আইনপ্রণেতা ও মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন।
সম্প্রতি টিকটকসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে তোপের মুখে পড়তে হয়। আর চলতি সপ্তাহে সিয়াটল পাবলিক স্কুল ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাট ও ইউটিউবের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, এসব মাধ্যম যুবকদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সংকট তৈরি করছে এবং স্কুলের শিক্ষাগত লক্ষ্য পূরণ কঠিন করে তুলছে। এই ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানী জেন টোয়েঞ্জ বলেছেন, টিকটকের অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীকে ধরে রাখার জন্য খুবই পরিশীলিত ও চিত্তাকর্ষক। তাই এখানে কিশোর-কিশোরীরা দীর্ঘ সময় মগ্ন থাকে। ডিজিটাল বিশ্লেষণ প্ল্যাটফর্ম সেন্সরটাওয়ারের মতে, টিকটকের বিশ্বব্যাপী ১০০ কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে। গত বছর ব্যবহারকারীরা প্রতিদিন গড়ে দেড় ঘণ্টা এই অ্যাপে সময় কাটিয়েছেন, যা অন্য যেকোনো সামাজিক মাধ্যমের চেয়ে বেশি।
টোয়েঞ্জ বলেন, অনেক কিশোর-কিশোরী তাদের টিকটক ব্যবহারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে। তারা বলেছে, তারা ১৫ মিনিটের জন্য অ্যাপে ঢুকে ২ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ব্যয় করেছে, এটিই সমস্যা। কারণ, একজন কিশোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যত বেশি সময় কাটাবে, তার বিষণ্নতার শঙ্কা তত বেশি। আর মাত্রারিক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই কথা আরও বেশি সত্য।
তবে কিশোর-কিশোরীরা বলছে, শুধু টিকটকের ভিডিওই তাদের অ্যাপটিতে ধরে রাখতে প্রলুব্ধ করছে না। অ্যাপটির ‘ফর ইউ’ সেকশনের কনটেন্টও তাদের অ্যাপটিতে মগ্ন রাখতে প্রলুব্ধ করছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০১২ সালের দিকে স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন বেড়েছে, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিষণ্নতাও তেমন বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজ অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, ২০০৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে কিশোরদের মধ্যে বিষণ্নতার হার দ্বিগুণ হয়েছে। আর কিশোরীদের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ২০১৯ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চারজন মেয়ের মধ্যে একজন বিষণ্নতা রোগে ভুগেছে। এসব ব্যাপারে টিকটক বলছে, ব্যবহারকারীরা প্রতিদিন কতক্ষণ এই অ্যাপে ব্যয় করবেন, তার সীমা নির্ধারণে সাহায্য করতে তাদের একটি টুল রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ব্যহারকারীর জন্য অন্যান্য সুরক্ষা আনার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন সমস্যাযুক্ত ভিডিও ফিল্টার করা এবং কে কী দেখছে, তাতে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো।
প্রতিষ্ঠানটি আরও বলেছে, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও আত্মহত্যা–সম্পর্কিত ৯৩ দশমিক ৪ শতাংশ ভিডিও কেউ দেখার আগেই তারা সরিয়ে ফেলেছে। সূত্র: সিএনএন