এখন প্রায় প্রতিটি মসজিদের একই চিত্র যে, জামাতে সালাত চলা অবস্থায় মুসল্লির মোবাইলে রিং বেজে ওঠে। সালাত অবস্থায় মোবাইল বেজে উঠলে যার মোবাইল শুধু যে তার সালাতেরই বিঘ্ন ঘটায় এমন নয়; বরং আশপাশের মুসল্লিদেরও খুশুখুজু বিঘ্নিত হয়। সালাত অবস্থায় মসজিদে যেহেতু পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে, তাই মোবাইল বেজে ওঠার সাথে সাথেই সবার ধ্যানখেয়াল চলে যায় মোবাইলের রিংটোনের দিকে। অথচ সালাত অন্য সব ইবাদত থেকে ভিন্ন ধরনের একটি ইবাদত। এ ইবাদতটি হলো সরাসরি আল্লাহ তায়ালার দরবারে হাজিরা দিয়ে তাঁর মহান সত্তার সামনে দণ্ডায়মান হয়ে তাঁর সাথে কথোপকথনের এক অপূর্ব মুহূর্ত। এ কারণেই সালাত অবস্থায় একাগ্রতা ও খুশুখুজুর প্রতি যেভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, অন্য কোনো ইবাদতের বেলায় তেমনটি করা হয়নি।
কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘ওই সব মু’মিন সফলকাম, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়-নম্র।’ (সূরা মু’মিনুন : ১-২) তাই একজন মুসল্লির উচিত মসজিদে প্রবেশের আগেই মোবাইল একেবারে বন্ধ না করলেও অন্তত রিংটোন বন্ধ করে দেয়া। এ অবস্থায় মোবাইলে ভাইব্রেশন দিয়ে রাখাও ঠিক নয়। কারণ ভাইব্রেশন দিয়ে রাখলেও কল এলে মুসল্লির মনোনিবেশ নষ্ট করে। এতে অন্যের সালাতের ক্ষতি না হলেও নিজের সালাতের খুশুখুজু নষ্ট হয় অবশ্যই। তা ছাড়া মোবাইলটি তখন পাশের মুসল্লির শরীরে স্পর্শ করলে তারও সালাতের একাগ্রতা নষ্ট হবে। তাই ভাইব্রেশন দিয়ে রাখাও ঠিক নয়; বরং হয়তো সাইলেন্ট করে রাখবে, কিংবা একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে। কোনো কারণে যদি সালাতের আগে মোবাইলের রিং বন্ধ করা না হয় আর সালাত পড়াবস্থায় রিং বেজে ওঠে তখন করণীয় ও লক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো নিঘ্নরূপ- ১. দুই হাত ব্যবহার না করে নামাজের আপন অবস্থায় থেকেই এক হাতের সাহায্যে মোবাইল পকেটে রেখেই কোনো বাটন চেপে রিং বন্ধ করে দেবে। আর পকেট থেকে বের করার প্রয়োজন হলেও এক হাত দিয়েই করবে। মোবাইল বের করে পকেটের কাছে রেখেই না দেখে দ্রুত বন্ধ করে পকেটে রেখে দেবে। জেনে রাখা প্রয়োজন, সালাতে প্রয়োজনে এক হাত কোনো কাজে ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে যেমন- টুপি উঠানোর জন্য, জামার হাতা নামানোর জন্য, সিজদার স্থানের কঙ্কর সরানোর জন্য, শরীরের কোনো স্থান বিশেষ প্রয়োজনে চুলকানোর জন্য ইত্যাদি। (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ১/৫৬৪, শরহুল মুনিয়াহ-৪৪৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া-১/১০৫, খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ১/১২৯, রদ্দুল মুহতার : ১/৬২৪, শরহে নববী : ১/২০৫)
২. এক হাত দিয়ে বন্ধ করতে গিয়ে মোবাইল পকেট থেকে বের করে দেখে দেখে বন্ধ করা যাবে না। কারণ এমনটি করলে যদিও দুই হাত ব্যবহার হচ্ছে না, কিন্তু মোবাইল দেখে দেখে বন্ধ করা অবস্থায় এ ব্যক্তিকে কেউ দেখলে সে সালাতে আছে বলে মনে করবে না। আর সালাত অবস্থায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সালাত ভেঙে যায়। তাই সালাত অবস্থায় মোবাইল দেখে দেখে বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। (রদ্দুল মুহতার : ১/২৬৪-২৬৫, আলবাহরুর রায়েক : ২/১১-১২) ৩. সালাতে মোবাইল বন্ধের জন্য একসাথে দুই হাত ব্যবহার করা যাবে না। যদি একসাথে দুই হাত ব্যবহার করে তবে সালাত নষ্ট হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ১/২৬৪-২৬৫, আলবাহরুর রায়েক : ২/১১-১২)
৪. সিজদাবস্থায় রিং বেজে উঠলে কেউ কেউ সিজদা থেকে প্রায় বসে গিয়ে মোবাইল বের করে বন্ধ করে থাকে। অথচ তখনো ইমাম-মুসল্লি সবাই সিজদাতেই থাকে। সালাতের এ অবস্থা থেকে মোবাইল বন্ধের জন্য বসে যাওয়াতে নামাজ ভেঙে যাবে। যদিও মোবাইল বন্ধ করাতে তিন তাসবিহ পরিমাণ সময় ব্যয় না হয়। কারণ যেখানে দুই হাতের ব্যবহারকেই সালাত ভঙ্গের কারণ বলা হয়েছে, সেখানে পুরো শরীরকে সালাতের অবস্থা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা নিঃসন্দেহে সালাত ভঙ্গের কারণ হবে। এ ছাড়া এ অবস্থায় কোনো আগন্তুক তাকে দেখলে সে সালাতে নেই বলেই মনে করবে। এটিও আমলে কাসিরের অন্তর্ভুক্ত, যা সালাত নষ্টকারী।
৫. তিনবার বিশুদ্ধভাবে ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ বা ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ বলা যায়- এ পরিমাণ সময়ের ভেতর উপরন্তু দু’বার পর্যন্ত এক হাতের সাহায্যে উপরোক্ত ১ নম্বরে উল্লেখিত নিয়মে রিং বন্ধ করা যাবে। এ সময়ের ভেতর দুইবারের বেশি বন্ধ করা যাবে না। যদি করে তবে সারাত নষ্ট হয়ে যাবে। হ্যাঁ, একবার বা দু’বার বন্ধ করার পর তিন তাসবিহ পরিমাণ বিলম্বে আবার রিং বেজে উঠলে তখন বন্ধ করা যাবে। মোট কথা, তিন তাসবিহ বলা যায় এ সময়ের ভেতর তিনবার রিং বন্ধের জন্য এক হাতও ব্যবহার করা যাবে না। এতে সালাত নষ্ট হয়ে যাবে। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ১/১২৯, রদ্দুল মুহতার : ১/৬২৫, আহসানুল ফাতাওয়া : ৩/৪১৮-৪১৯)
৬. মোবাইল প্যান্টের পকেটে থাকলে তা বের করে বন্ধ করার জন্য দুই হাত ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। তদ্রুপ ফোল্ডিং সেট হলেও রিং বা ফোন বন্ধ করতে কখনো কখনো দুই হাত ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। অথচ দুই হাত ব্যবহার করলে সালাত ভেঙে যায়। তাই এ ক্ষেত্রে কি নিজের সালাত নষ্ট করে হলেও রিং বন্ধ করবে? নাকি করবে না। মূলত সালাতে খুশুখুজুর গুরুত্ব অনেক বেশি। এতই বেশি যে, কোনো মুসল্লির মল-মূত্রের বেগ হওয়ার দরুন খুশুখুজু বিঘ্নিত হলে তার জন্য সালাত ছেড়ে দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। ফিকহের কিতাবাদিতে এ ক্ষেত্রে সালাত ছেড়ে দেয়াকে উত্তম বলা হয়েছে। কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। (তাহতাবি আলাল মারাকি-১৯৮, হিন্দিয়া : ১/১০৭, আল বাহরুল রায়েক : ১/২৮৭, রদ্দুল মুহতার : ১/৬৫৪)
তাহলে সালাত অবস্থায় মোবাইল বেজে উঠলে যার মোবাইল শুধু তার সালাতেরই বিঘ্ন ঘটায় না; বরং আশপাশের মুসল্লিদেরও খুশুখুজু বিঘ্নিত হয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সালাত নষ্ট না করে বন্ধ করা সম্ভব না হলে সালাত ছেড়ে দিয়ে হলেও মোবাইল বন্ধ করা জায়েজ তো বটেই; বরং এমনটি করাই কর্তব্য। আর রিংটোন যদি গান বা মিউজিকের হয়, তবে এর খারাবি তো আরো অধিক। সুতরাং এ ধরনের পরিস্থিতিতে সালাতে থেকে উপরোক্ত নিয়ম অনুযায়ী এক হাত দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হলে তাই করবে। আর তা সম্ভব না হলে নিজের সালাত ছেড়ে দিয়ে হলেও রিং বন্ধ করে দেবে। এরপর মাসবুকের ন্যায় আবার নতুন করে জামাতে শরিক হবে। (রদ্দুল মুহতার : ১/৬৫৫) লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলুম, তালতলা, ময়মনসিংহ