পরিচিত-অপরিচিত যেকোনো মেহমানের মেজবানি করা সব নবী-রাসূলের সুন্নাত, সাহাবায়ে কেরামের সিফাত এবং ইসলামের তাগিদপূর্ণ নির্দেশ। আতিথ্য দ্বারা কার্পণ্য দূর হয়, মহাব্বত সৃষ্টি হয়, সুসম্পর্ক তৈরি হয় এবং আত্মীয়তার বন্ধন হয় সুদৃঢ়, সুসংহত।
ইবরাহিম আ:-এর মেহমানদারি : হজরত ইবরাহিম আ:-এর অকৃপণ মেহমানদারি সম্পর্কে কুরআনে এসেছে, (হে রাসূল!) আপনার কাছে কি ইবরাহিমের সম্মানিত অতিথিদের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে? যখন তারা ইবরাহিমের কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘সালাম’। তখন ইবরাহিমও বলল, ‘সালাম’, (আর সে মনে মনে ভাবল যে) এরা তো অপরিচিত লোক। তারপর সে চুপিসারে নিজ পরিবারের কাছে গেল এবং একটি মোটাতাজা বাছুর নিয়ে এলো। অতঃপর তা সেই অতিথিদের সামনে এগিয়ে দিলো এবং বলল, আপনারা খাচ্ছেন না যে? (সূরা জারিয়াত, আয়াত : ২৪-২৭)
তাফসিরে কাশশাফে এসেছে, হজরত ইবরাহিম আ: মেহমান ছাড়া আহার গ্রহণ করতেন না। (২/৬৪৩) মুনাবি রহ: বলেন, ইবরাহিম আ:-কে বলা হতো ‘আবুয যয়ফান’ বা মেহমানদের বাবা। কখনো কখনো মেহমানের তালাশে এক-দুই মাইল পর্যন্ত হাঁটতে থাকতেন …। (তাফসিরে সামআনি-৫/২৫৭)
রাসূল সা:-এর মেহমানদারি : আর আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মেহমানদারি তো ছিল প্রবাদতুল্য। মেহমান এলে তার আদর-আপ্যায়ন ও খাতির-যতেœ সাধ্যের সবটুকু ব্যয় করতেন। অল্প বেশি যা থাকত প্রশস্ত হৃদয়ের সাথে তাই পেশ করতেন। মেহমানের মেহমানদারিতে এতটুকু কৃপণতা বা সঙ্কীর্ণতা করতেন না তিনি। এমনকি আগন্তুক মেহমান অমুসলিম হলেও এর ব্যত্যয় ঘটত না। এ জন্যই তো প্রিয় নবী সা: প্রথম ওহি লাভ করার পর যখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঘরে ফেরেন তখন প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনী হজরত খাদিজা রা: চরিত্রের মহোত্তম রূপ তুলে ধরে তাকে সান্ত¡নার পরশ বুলিয়ে দেন এভাবে- ‘কিছুতেই না, আল্লাহ কখনো আপনাকে অপদস্থ করতে পারেন না। কেননা, আপনি আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখেন, অন্যের বোঝা বহন করেন, নিঃস্ব ব্যক্তির উপার্জনের ব্যবস্থা করেন, মেহমানের সামনে খাবার পেশ করেন এবং সত্যের পথে আসা বিপদ-দুর্যোগে সহায়তার হস্ত সম্প্রসারিত করে দেন।’ (বুখারি-৩)
এক সাহাবির মেহমানদারি : প্রিয় নবী সা:-এর দরবারে এক লোক এলো। মেহমানদারির চিরাচরিত অভ্যাস অনুসারে নবীজী ঘরে সংবাদ পাঠালেন খাবার সম্পর্কে জানতে। স্ত্রীগণ উত্তর পাঠালেন, ঘরে পানি ছাড়া কিছুই নেই। তখন আল্লাহর নবী বললেন, কে এ লোকের মেহমানদারি করতে প্রস্তুত? তখন এক আনসারি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে বললেন, আমি প্রস্তুত। অতঃপর সেই লোককে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছলেন এবং স্ত্রীকে বললেন, আল্লাহর নবীর মেহমানকে একরাম করো। স্ত্রী বলল, আমাদের কাছে তো সন্তানদের খাবার ছাড়া কিছুই নেই। সাহাবি বললেন, আচ্ছা যা আছে তাই প্রস্তুত কর। নির্দেশ মোতাবেক স্ত্রী বাতি জ্বালাল, সন্তানদের অভুক্ত রেখেই ঘুম পাড়াল, তারপর যৎসামান্য যা ছিল মেহমানের সামনে পেশ করল। একটু পর বাতি ঠিক করার অজুহাতে এসে বাতি নিভিয়ে দিলো এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ে আওয়াজ করে মুখ নাড়াতে থাকল, যেন মেহমানের সাথে তারাও খাচ্ছে। এভাবে মেহমানকে খাইয়ে নিজেরা অনাহারেই রাত পার করলেন ওই সাহাবি ও তাঁর স্ত্রী। সকালে রাসূল সা:-এর খেদমতে উপস্থিত হলে বললেন, আজ রাতে তোমরা তোমাদের মেহমানের সাথে যে অপূর্ব আচরণ করেছ তাতে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং কুরআনে কারিমের এ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন- ‘ক্ষুধার্ত থাকার পরও তারা নিজেদের ওপর অন্যদের প্রাধান্য দেয়। বস্তুত যাদের মনের কৃপণতা থেকে মুক্ত করা হয়েছে তারাই সফলকাম। [সূরা হাশর-৯] [সহিহ বুখারি-৩৭৯৮]
মেহমানদারি ঈমানি দায়িত্ব : তাই বাড়িতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-অপরিচিত কোনো মেহমান এলে খুশি হওয়া এবং পুণ্য লাভের অপূর্ব সুযোগ মনে করে তা লুফে নেয়া মানবিক কর্তব্য। ঈমানি দায়িত্বও বটে। মেহমান আসার কথা শুনে ভ্রƒকুটি করা কিংবা মনোক্ষুণœ হওয়া মোটেও সমীচীন নয়। রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করেন, আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী ব্যক্তিমাত্রই যেন আপন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়, আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী ব্যক্তিমাত্রই যেন আপন মেহমানকে সম্মান করে, আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী ব্যক্তিমাত্রই যেন ভালো কথা বলে কিংবা নীরব থাকে। [সহিহ বুখারি-৬০১৮]
মেহমানদারিতে পূণ্য ও প্রতিদান : তাছাড়া মেহমানদারিতে যে অপরিসীম সাওয়াব রয়েছে সেদিকে লক্ষ্য করেও স্বতঃস্ফূর্তচিত্তে এগিয়ে আসা উচিত মেহমানের আপ্যায়নে। নবীজী সা: বলেন, জান্নাতে এমন কিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আলোকভেদ্য বালাখানা রয়েছে যার ভেতর-বাইর সম্পূর্ণ পরিদৃষ্ট হবে। এক বেদুইন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল! এগুলোর হকদার হবে কারা? উত্তর দিলেন, ওই সব লোক যারা নম্র ভাষায় কথা বলে, খাবার দান করে, বেশি বেশি রোজা রাখে এবং রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন আল্লাহর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করে। [সুনানে তিরমিযি-১৯৮৪]
অন্যত্র বলেন, তোমরা করুণাময়ের ইবাদত করো, খাবার দান করো, সালাম বিস্তার করো, তাহলে বিনিময়ে নিরাপত্তার সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। [সুনানে তিরমিজি-১৮৫৫]
আত্মীয়তা রক্ষারও এক মাধ্যম : তদুপরি যতœ-আত্তি ও মেহমানদারি আত্মীয়স্বজনদের মাঝে সম্পর্ক ও সম্প্রীতি বজায় রাখারও অন্যতম মাধ্যম, যা ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূল সা: বলেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক আরশ ধরে বলতে থাকবে, যে আমার সম্পর্ক বজায় রেখেছে আল্লাহ তায়ালা যেন তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, আর যে আমার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আল্লাহ তায়ালা যেন তার সম্পর্ক ছিন্ন করেন। (মুসলিম-২৫৫৫) লেখক : মুহাদ্দিস, ইদ্রিস আলী বিশ্বাস ইসলামিয়া মাদরাসা, আলারদর্গা, কুষ্টিয়া