মাটির উর্বরা শক্তি বাড়িয়ে চাষে উপকারিতা পাওয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় ভোলা জেলায় কৃষকরা দিন দিন কম্পোস্ট সার ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। অনেক কৃষকই এখন বাণিজ্যিকভাবে এ সার উৎপাদন করছেন। উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসাবে কেঁচোর বিষ্ঠা বা মলের মাধ্যমে যে জৈব সার তৈরি করা হয়, তার কেতাবি নাম ভার্মি কম্পোস্ট। কেউ বলে কম্পোস্ট সার। সেই ভার্মি কম্পোস্টকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে সফল হচ্ছেন ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার কৃষকরা। স্থানীয়ভাবে এর পরিচিতি কেঁচো কম্পোস্ট বা কেঁচো সার হিসেবে। উন্নয়ন সংস্থা এফডিএ’র সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রকল্পের মাধ্যমে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় ‘বিভিন্ন ইউনিয়নে নিরাপদ দুগ্ধপণ্যের বহুমুখি ব্যবহার বাড়ানো ও বড় বাজারে প্রবেশযোগ্যতা বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক উপ-প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনে পারদর্শী করা হচ্ছে।
উদ্যোক্তাদের একজন আতাউর রহমান বাবুল (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা)। তিনি চরফ্যাশন উপজেলার দুলারহাট থানার নীলকমল ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা। রাসায়নিক সারের প্রতি অনীহা বাবুলের। তাই চাকরি থেকে অবসরের পর নিজ এলাকার দরিদ্র চাষিদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো সার উৎপাদনে আগ্রহী হন। ২০১৯ সালে প্রশিক্ষণ নেন পরিবার উন্নয়ন সংস্থার (এফডিএ) এসএপি প্রকল্প থেকে। প্রশিক্ষণ নিয়ে ২টি চারি দিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। তিনি সালমা নামের অন্য এক উদ্যোক্তার কাছ থেকে কেঁচো ও স্থানীয় গোখামারিদের থেকে গোবর নিয়ে প্রথমে চারি, বস্তা, নেট, চালনি সব মিলিয়ে চার হাজার টাকা খরচ করে শুরু করেন কেঁচো সার তৈরির কাজ।
আতাউর রহমান বাবুল জানান, তিনি দ্বিতীয় মাসে এ প্রকল্পের সাধারণ সেবা খাত হতে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে প্রথমে ৫ ফুট বাই ৫ ফুট সাইজের ১৬টি পাকা সার তৈরির চৌবাচ্চা বানান, পাশাপাশি গোবর সংরক্ষণের জন্য একটি ঘর এবং ২০০ টি রিং বানান। কেঁচোর খাদ্য হিসেবে কলা গাছ এবং খড় ব্যবহার করেন। বর্তমানে ১৬টি চৌবাচ্চা, ২০০ রিং আর ২৫টি চারিতে মাসে ৩৫ মণ সার উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি সারের বর্তমান বাজার মূল্য ২৫ টাকা হিসেবে প্রতি মণ এক হাজার টাকা করে বিক্রি করতে পারেন তিনি।গোবর সংগ্রহ, খামার দেখভাল, সার তৈরির জন্য ১৫ হাজার টাকা মাসে বেতনে ১ জন লোক সবসময় কাজ করে। সকল খরচ বাদ দিয়ে এ প্লান্ট থেকে মাসে প্রায় ১৫ হাজারের মতো ইনকাম থাকে বলে জানান বাবুল। এরপরই বাণিজ্যিকভাবে সার তৈরিতে আগ্রহ জন্মায় তার।
পরিবার উন্নয়ন সংস্থার (এফডিএ) এসএপি প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছে, সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রকল্পের দেখানো পথ ধরে এই জৈব সার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যুক্ত প্রায় ১৯ জন উদ্যোক্তাকে কমার্শিয়াল মাধ্যমে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তাসহ অনুদানের ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে এই জৈব সার বড় ভূমিকা পালন রাখতে পারে। সে কারণেই প্রান্তিক কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে এই সার ব্যবহার নিয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মাধ্যমে বিষমুক্ত শাক-সবজি তারা উপহার দিতে পারবেন সাধারণ মানুষকে।
শাকসবজির ফেলে দেওয়া অংশ, অর্ধ-পচা গোবর, কলাগাছ ও কচুরিপানা একসঙ্গে মিশিয়ে সেখানে কেঁচো ছেড়ে দেওয়া হয়। কেঁচো সেসব ময়লা খেয়ে মলত্যাগ করে পচিয়ে ফেলে ও বংশবিস্তার করতে থাকে। কেঁচোর পচিয়ে ফেলা দ্রব্যই মূলত জৈব সারে পরিণত হয়। প্রতি কেজি ১৫-২০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। অন্যদিকে এই জৈব সার উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কেঁচো প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকা দরে।
এ বিষয়ে চরফ্যাশন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, চরফ্যাশনে কেঁচো কম্পোস্ট ছিলো না। পরিবার উন্নয়ন সংস্থার (এফডিএ) এসএপি প্রকল্পের মাধ্যমে বেশ কিছু কৃষককে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে কেঁচো ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে পরীক্ষামূলক কেঁচো চাষ শুরু করা হয়। কৃষকরা বর্তমানে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা কমিয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে জৈব সার ব্যবহার করে বিষমুক্ত ফসল ফলাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করতে হলে জৈব সার ব্যবহারের বিকল্প নেই। এখন এই চরফ্যাশনে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন বাড়ছে।