ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুন্ডু উপজেলার কাপাশহাটিয়া ইউনিয়নের বাওড় পাড়ের একটি গ্রাম হিজলী। গ্রামের প্রবেশদ্বারে লাগানো হয়েছে সুন্দর একটি বোর্ড। যেখানে লেখা আছে “স্বাগতম, স্মার্ট ভিলেজ হিজলী। এই গ্রাম বাল্য বিবাহমুক্ত, অপরাধমুক্ত, আত্মহত্যামুক্ত, স্বনির্ভর, ডিজিটাল এবং পরিবেশ বান্ধব। দারুন উদ্যোগ উপজেলা প্রশাসনের এটি। এক সময় এটি ছিল একটি চরমপন্থীদের অধিক্ষেত্র এবং বসবাসরত মানুষের সাথে উন্নয়নের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না বললেই চলে। বর্তমান সরকারের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোয়ায় এই ভীতি, কুসংস্কার এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদ আলোর মুখ দেখলেও এখানকার মানুষ এখনো অপরাধপ্রবণ, শিক্ষাগ্রহনে অনাগ্রহী এবং প্রচলিত কৃষি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থার যাবিত জীবনে অভ্যস্ত। আত্মহত্যার প্রবণতা, মাদকাসক্তি, স্মার্ট ফোনের যথেচ্ছাচার অপপ্রয়োগসহ সুদে কারবারি মরণ ফাদে। ৩৩৪টি পরিবার রয়েছে হিজলী গ্রামে। যেখানে ৪৯৩ জন পুরুষ ও ৫১৯ জন মহিলার বসবাস। এই গ্রামের ২৩৯জন পুরুষ এবং ২৬৮জন মহিলা লিখতে পড়তে পারে। যে গ্রামের মাত্র ২জন মহিলা ও ২জন পুরুষ চাকুরি করে। কৃষি কাজই গ্রামের মানুষের মুল পেশা। সব মিলিয়ে বলতে গেলে পিছিয়ে পড়া একটি গ্রাম হিজলী। হিজলী গ্রামটিকে স্মার্ট ভিলেজে বা মডেল করার উদ্দেশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগকে বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রটোকল তৈরি করা যা অনুসরন করে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্টির ভাল থাকা নিশ্চিত করা যায়। এই গ্রামটিতে ক্ষুদ্র/ কুটির/হস্তশিল্পের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে গ্রামবাসীদের বিশেষ করে নারীদের দক্ষতা বাড়ানো এবং অফলাইন অনলাইন উভয়ক্ষেত্রেই বাজার ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্তকরন করা। ইন্টারনেট সংযোগ শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে কানেক্টিভিটি বৃদ্ধিকরন, চাষযোগ্য জমি বিশেষ করে বাড়ির আঙিনার অনাবাদি জমিসহ শতভাগ জমিকে চাষের আওতায় এনে দেশের উৎপাদনশীলতাকে ত্বরান্বিতকরন করা। বাল্য বিবাহ বন্ধ করার মাধ্যমে মাতৃস্বাস্থ্যের কল্যাণ এবং সুস্থসবল ভবিষ্যত প্রজন্ম নিশ্চিতকরন। কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা বিশেষ করে যুবক শ্রেণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। ঝড়ে পড়া, অটিষ্টিক এবং এতিম বাচ্চাসহ সকল শিশুদের শিক্ষার মুলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা। সন্ত্রাস, নেশা এবং মোবাইল আসক্তি থেকে কিশোর কিশোরীদের দুরে রাখা। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারি অফিসসমুহকে সেবাগ্রহিতাদের দোড়গোড়ায় পৌছে দেওয়া এবং রিনিউবল শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরন করাই স্মার্ট ভিলেজ ধারনা। হরিণাকুন্ডুর প্রেক্ষাপটে এখানকার মানুষকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের স্বাদ দিতে দরকার ছিলো একাবারে নতুন কিছু। একটি আধুনিক এবং নিজস্বতায় সমৃদ্ধ সমাজ ও মাননীয় প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ স্বপ্নের সাথে এতাত্মতা প্রকাশের চিন্তা থেকেই এই ধারণার উৎপত্তি। স্মার্ট ভিলেজ এর কারনে এই গ্রামে এখন ৩টি বাড়িতে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। জাইকা প্রকল্পের সহায়তায় ৫টি সোলার স্ট্রীট লাট স্থাপন, গ্রামের নামে ফেসবুজ গ্রুপ খোলা হয়েছে, গ্রামের ৭০ শতক জমিতে পারিবারিক পুষ্টির বাগান স্থাপন করা হয়েছে। যেখান থেকে নিয়মিত নিরাপদ বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন হচ্ছে। ২০টি বাড়িতে রান্নাঘরের আবর্জনা দিয়ে জৈব সার তৈরি করা হচ্ছে। মৃদু প্রতিবন্ধিদের মধ্যে থেকে ৩ জনকে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। গ্রামের শিক্ষিত যুবকতের কর্মসংস্থানের জন্য ৯জনকেআউটসোসিং কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। স্মার্ট ভিলেজ হিজলীতে ইন্টারনেট সুবিধা বাড়ানোহয়েছে। গর্ভবতী মায়েদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের কাউন্সিলিং করা হচ্ছে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিক্ষা করা হচ্ছে। গ্রামের ২০২টি টিউবওয়েল আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে হিজলী গ্রামে স্মার্ট যুব ক্লাব স্থাপন করা হয়েছে যাতে গ্রামের যুব সমাজ মোবালই ফোনে আসক্তি কমানো যায়। উপজেলা কৃষি অফিসার মো: হাফিজ হাসান জানান, হিজলী গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজ করতে গ্রামের প্রায় ৪৫০টি উঠানের অনাবাদী জমির অর্ধেক অংশে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে। অবশিষ্ট সকল জমিও আবাদের আওতায় আসবে এবং বিষমুক্ত সবজি চাষাবাদ করা হবে। তিনি জানান, নারী ও মাতৃস্বাস্থ্য ঠিক রাখার পাশাপাশি সুস্থসবল ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ার অংশ হিসেবে ও গ্রামে কার্যক্রম চলছে। স্মার্ট ভিলেজ ঘোষনার পর এই গ্রামে একটিও বাল্য বিবাহ হয়নি। সরকারি সেবা সমুহকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দিতে সপ্তাহে একদিন হিজলূী গ্রামের বৈঠকখানায় ইউডিসি উদ্যক্তা বৈঠকখানা এ্যাপস ব্যবহার করে অপর প্রান্তে থাকা উপজেলার সকল দপ্তরসমুহর সাথে ভার্চুয়ালী যুক্ত রা হচ্ছে। এছাড়াও এসপিডিপি তৈরির অংশ হিসেবে স্মাার্ট ভিলেজ হিজলী নামের একটি ফেসবুজ গ্রুপে গ্রামবাসী এবং উপজেলার সকল অফিসারকে সংযুক্ত করা হয়েছে। যেখানে গ্রামবাসীদের পক্ষে যে কেউ কোন সমস্যা, অভিযোগ বা প্রস্তাবনা পেশ করেন তা যাচাইবাছাই পূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মুন্সি ফিরোজা জানান, স্মার্ট ভিলেজের সুফল ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছে। এই উদ্যেগের আওতায় ৫০টিও বেশি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এবং যে গুলোর বেশিভারই সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের নিয়মিত কার্যক্রমেরই অংশ। হিজলী গ্রামের নারীদেরকে উপার্জনক্ষম করে গড়ে তুলতে ইতিমধ্যে আয়েশা আবেদন ফাউন্ডেশন এবং স্থানীয় নারী উদ্যেক্তা লিয়া পারভীন এবং নাসরিন এর সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয়েছে একটি উদ্যেগ। হাতের কাজের তৈরি সমুহ পণ্য উপাদনের সাবসেন্টার। যেখানে বর্তমান৪০জন নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। হরিনাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুস্মিতা সাহা জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ ঘোষণার নিয়ে স্মার্ট ভিলেজ তৈরিতে কাজ করছি। একটি গ্রামকে স্বনির্ভর করা, গ্রামকে সবুজয়ান করা, সন্ত্রাসমুক্ত, বেকারমুক্ত করার। ২০২২ সাল থেকে কাজ শুরু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে গ্রাম সার্ভে করা হয়েছে। কোথায় কোথায় সমস্যা সব বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা, তরুন তরুনী, গ্রামের নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। যুবক ও নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই উদ্যেগটি একটি মডেল যা অনুসরন করে বাংলাদেশের যে কোন গ্রামকে স্মার্ট ভিলেজ রুপান্তরিত করা সম্ভব।