এশিয়ায় গণতন্ত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছিল সম্ভবত ১৯৮০ এবং ১৯৯০’র দশকে। ওই সময় তাইওয়ান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়ায় একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটেছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার গণতন্ত্র আবারও পিছিয়ে পড়েছে।
ফিলিপাইনের কথাই ধরুন। গত বছর পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তে দেশটির বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের ওপর ভয়ংকর আক্রমণ চালিয়ে গেছেন। কম্বোডিয়ায় হুন সেন তার বিরোধীদের ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াচ্ছেন এবং মিডিয়ায় সমালোচকদের ভয় দেখাচ্ছেন। ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্টের অপমান অপরাধ বিবেচনা করা হচ্ছে। মিয়ানমারে ২০১৫ সালের উৎসবমুখর নির্বাচনে অর্ধশতাব্দীর সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু ২০২১ সালে দেশটির জেনারেলরা সহিংস অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফের ক্ষমতা দখল করে এবং অং সান সু চি ও তার সমর্থকদের কারাগারে নিক্ষেপ করে। এরপর থেকে সন্ত্রাসী কায়দায় দেশশাসন করছে সামরিক জান্তা।
কিন্তু, এত কিছুর মধ্যেও এশিয়ায় গণতন্ত্রের আলো ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, ফিলিপাইনে দুতের্তের উত্তরসূরি তার মতোই সন্দেহজনক ও হুমকিস্বরূপ হবেন। তার ওপর ফার্দিনান্দ ‘বংবং’ মার্কোসের বাবা হচ্ছেন প্রয়াত সেই দুঃশাসক, যাকে ১৯৮৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল ফিলিপিনোরা। গত জুনে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন মার্কোস। তিনি এখন সুশাসনের ওপর জোর দিয়েছেন। তার মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্যরা দক্ষ এবং বাস্তববাদী। তাই কাজের পারফরম্যান্স দিয়ে তাকে বিচার করতে অনুরোধ জানিয়েছেন মার্কোস এবং বলতে হচ্ছে, এখন পর্যন্ত হতাশ করেননি তিনি।
গত বছর পর্যন্ত গোতাবায়ার নেতৃত্বাধীন রাজাপাকসে পরিবারের অবিচার-অপশাসনে ঘুরপাঁক খাচ্ছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু গত জুলাই মাসে গণবিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া দেশ ছেড়ে পালাতে এবং তার পরিবার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। এটি ছিল শ্রীলঙ্কার পুনরুজ্জীবনে একটি অপরিহার্য শর্ত। ফিজিতে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে গত ডিসেম্বরে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক বাইনিমারামাও অভ্যুত্থানের পরে টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি এবার পুনর্র্নিবাচনে জিততে ব্যর্থ হন এবং এ নিয়ে কিছুটা সময় চিন্তাভাবনার পরে সরে দাঁড়াতে রাজি হন। গত মাসে অনেকটাই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর দেখেছে মালয়েশিয়া। সেখানে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সংস্কারপন্থি আনোয়ার ইব্রাহিম।
থাইল্যান্ডে আরেকজন অভ্যুত্থানের নেতা প্রয়ুথ চ্যান-ওচা এবং তার সেনাবাহিনীর বন্ধুরা দৃশ্যত একটি বেসামরিক সরকার পরিচালনা করছেন এবং এ বছরের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার সম্ভাবনা অতটা উজ্জ্বল নয়, যতটা তারা চান। তাদের একটি বিরোধী পক্ষ দ্রুত উঠে আসছে।
যদিও যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারে আপাতত খুশি হওয়ার মতো কিছু নেই। তবে বর্বর জেনারেল মিন অং হ্লাইং গণতন্ত্রের উত্থানে একটি শক্তিশালী সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছেন। ইরানের মতো মিয়ানমারের তরুণ প্রজন্মও স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে ইচ্ছুক প্রমাণ করছে। ফলে আজ হোক বা কাল, মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরবেই। অবশ্য এটিও বলা উচিত, এশিয়ার বিশাল অংশ এখনো জানেই না গণতন্ত্র কী। লেনিনবাদী একনায়কতন্ত্র টিকে থাকা শেষ চারটি দেশের মধ্যে অন্যতম চীন, লাওস, ভিয়েতনাম। এরপর রয়েছে উত্তর কোরিয়া। তবুও এশিয়ার রাজনৈতিক মেজাজ পরিবর্তিত হয়েছে বলেই মনে হয়। এ অ লের আরও অনেক দেশে গণতন্ত্র ফেরার নানা উপায় রয়েছে। ফিজি, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কায় ওয়েস্টমিনিস্টার ধরনের শাসনব্যবস্থা তাদের আরও জবাবদিহিতার দিকে ফেরাতে পারে। ভারত-ইন্দোনেশিয়ায় গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের পথ দেখাতে পারে তাদের অবাধ নির্বাচনের ঐতিহ্য। অন্য যেসব জায়গায় দুর্নীতিবাজ স্বৈরাচারীরা নিজেদের বৈধতা বাড়ানোর জন্য নির্বাচনে কারচুপি করে, তারাও প্রক্রিয়াটির নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। সুতরাং, গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের বীজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এশিয়াজুড়ে।