শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২৫ অপরাহ্ন

তুরস্কের ভূমিকম্পের জন্য কি আমেরিকার হার্প দায়ী?

আহমদ সিফাত আহমদ সিফাত
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

তুরস্কের ভূমিকম্পের জন্য কি আমেরিকার হার্প দায়ী? হাই ফ্রিকুয়েন্সি অ্যাক্টিভ অরোরাল রিসার্চ প্রোগ্রাম সংক্ষেপে হার্প (ঐঅঅজচ)। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর একটি গবেষণা প্রকল্প যা ২০১৫ সালের ১১ আগস্ট আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করা হয়। উচ্চ তরঙ্গ ব্যবহার করে পৃথিবীর বায়ুম-লের ওজন স্তর বা আয়োনোস্ফিয়ারে এ গবেষণা চালানো হয়।
তবে এই প্রযুক্তি সম্পর্কে পুরো বিশ্বেই বিতর্কিত মতবাদ প্রচলিত আছে। অনেকেই এই প্রযুক্তিকে দানবীয় প্রযুক্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের দাবি এই প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি দেশের বা পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে কৃত্রিম উপায়ে বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, এমনকি ভূমিকম্পসহ মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটানো সম্ভব। তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের পর এই বিতর্ক ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলছে সমালোচনার ঝড়। সবাই আঙুল তুলছে আমেরিকান হার্প প্রযুক্তির দিকে। বলা হচ্ছে বৈশ্বিক রাজনীতির বিরোধীতার অংশ হিসেবে তুরস্ককে উচিত শিক্ষা দিতেই হার্প প্রযুক্তির অপব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্কে ভূমিকম্পের সময় আকাশে বজ্রপাত হতে দেখা গেছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক জন্ম দিয়েছেন তাত্ত্বিকেরা। সেনঝিনা বোয়াহেন নামে এক নারী এমন একটি ভিডিও টুইট করে লিখেছেন ‘তুরস্কের ভূমিকম্প ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্রের একটি শাস্তিমূলক অভিযানের মত দেখাচ্ছে।’ তার দাবি ভূমিকম্পের সময় সাধারণত বজ্রপাত দেখা যায় না কিন্তু হার্প অপারেশনের সময় দেখা যায়।
তবে ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন ভূমিকম্পের সময় বজ্রপাত হওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা। এ নিয়ে অযথা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। কেবল বহির্বিশ্বে নয়, বাংলাদেশেও হার্প নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, ছড়ানো হচ্ছে গুজব। বিতর্কিত তাত্ত্বিকরা আরও সমালোচনায় জড়িয়েছেন এই বলে যে, তুরস্কে ভূমিকম্প হওয়ার একদিন পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলো তুরস্কে তাদের কনসালটেন্ট বন্ধ করে দেয়। গত ৩ ফেব্রুয়ারি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবারের মত কৃষ্ণসাগরের কাছাকাছি আসে মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ। ভূমিকম্পের পূর্বে এহেন কার্যকলাপগুলোকে যথেষ্ট সন্দেহজনক বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন তারা।
তাদের দাবি, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় সব আন্তর্জাতিক ইস্যুতে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে আসছে। রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ঘনিষ্ঠতা চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। তুরস্কের উপর চাপ সৃষ্টি করে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোতে ঢুকাতে চায় তারা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় একই অঞ্চলের তুরস্ক, সিরিয়া ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও ইজরাইল ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি।
তুরস্কে ভূমিকম্প: গেল ৬ ফেব্রুয়ারি এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের শিকার হয় তুরস্ক-সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা কাহরামানমারাস। তুরস্কের গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে স্থানীয় সময় সকাল ৪টা ১৭ মিনিটে প্রথম ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে কাহরামানমারাস অঞ্চলের ভূমিকম্পটি ছিল ৭ দশমিক ৪ মাত্রার। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুসারে এই ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কে মারা গেছেন ১৪ হাজার জন ও সিরিয়ায় ৩ হাজার ১৬২ জন। এর আগে তুরস্কে ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পেও প্রায় ১৮ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। রিখটার স্কেলে সেবারের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬।
হার্প বিতর্ক: হার্প নিয়ে বিতর্ক এবারই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন ঘটনায় একাধিকবার হার্প প্রযুক্তিকে দোষারোপ করা হয়েছে। এই বিতর্ক শুরু হয় মূলত ২০১০ সালে হাইতির ভূমিকম্পের পর। এ ছাড়াও ২০১০ সালে চিলিতে ভূমিকম্প ও সুনামি, ২০১১ সালের জাপানে ভূমিকম্প ও সুনামি, ২০১৩ সালে ওকলাহোমায় টর্নেডো এমনকি ২০০৬ সালে ফিলিপাইনে ভূমিধসে হাজারেরও বেশি নিহতের ঘটনার জন্য হার্প প্রযুক্তিকে দায়ী করা হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রযুক্তির প্রভাব বিষয়ে হার্পের দিকে আঙুল তুলেছেন বিশ্ব নেতারাও। ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদেনিজাদ ২০১০ সালে পাকিস্তানের বন্যার কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের হার্প প্রকল্পের বৈদ্যুতিক চুম্বকীয় তরঙ্গকে অভিযুক্ত করেছিলেন। একই বছর ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ হার্পকে টেকটোনিক অস্ত্র আখ্যা দিয়ে হাইতির ভূমিকম্পের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রকল্পকে দায়ী করেছিলেন। তবে এসব বিতর্ক বরাবরই অস্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ইউএসএ টুডে। তারা হার্পের একাধিক গবেষকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছে। তাদের দাবি আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তনের কোনো সক্ষমতাই হার্প প্রযুক্তির নেই। আর আবহাওয়াবিদ এবং জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, বড় আকারের আবহাওয়া কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যায় না। এসব বিতর্কের তোপের মুখে ২০১৪ সালে হার্পের গবেষণা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী। তবে বৈজ্ঞিনাকি গবেষণার প্রয়োজনে পরে তা আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন: পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আলাদা বিট দিয়ে গঠিত, যাকে প্লেট বলা হয়, যা একে অপরের পাশাপাশি অবস্থান করে। এই প্লেটগুলি প্রায়শই নড়াচড়া করার চেষ্টা করে। কিন্তু পাশে থাকা অন্য আরেকটি প্লেটের সাথে ঘর্ষণের মাধ্যমে এই নড়াচড়া প্রতিরোধ করা হয়। তবে চাপ বেশি বেড়ে গেলে কখনো কখনো একটি প্লেট হঠাৎ করে ঝাঁকুনি দেওয়ায় ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ সরে যায়। এবার এরাবিয়ান প্লেটটি উত্তর দিকে সরে যায় এবং উত্তর দিকে সরে যাওয়া আনাতোলিয়ান প্লেটে গিয়ে ধাক্কা দেয়। প্লেটগুলোর এ ধরণের ঘর্ষণের কারণে অনেক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। ক্ষতিকর আফটারশক প্রায় এক বছর ধরে চলতে থাকে। বর্তমান ভূমিকম্পের পরে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি আফটারশক হয়েছে এবং বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে, এটি এই অঞ্চলে এর আগে হওয়া ভূমিকম্পের মতোই হবে।
তুরস্কের ভূমিকম্পটি ফল্ট লাইন বরাবর প্রায় ১০০ কিলোমিটার ধরে আঘাত হেনেছে এবং এ কারণে ভবনগুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যান্ড ডিজাস্টার রিডাকশনের প্রধান অধ্যাপক জোয়ানা ফাউর ওয়াকার বলেছেন: ‘যে কোনো বছরের তুলনায় সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প। গত ১০ বছরের মধ্যে মাত্র দুটি ভূমিকম্প এ মাত্রার ছিল, আর এর আগের ১০ বছরে মাত্র চারটি ভূমিকম্প এ মাত্রার ছিল।’ পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভলকানো এন্ড রিস্ক কমিউনিকেশন বিভাগের রিডার ড. কারমেন সোলানা বলেছেন ‘দুর্ভাগ্যবশত দক্ষিণ তুরস্ক এবং বিশেষ করে সিরিয়ায় অবকাঠামোগুলো খুব একটা ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়। তাই জীবন বাঁচানো এখন নির্ভর করবে উদ্ধার তৎপরতার উপর। জীবিতদের উদ্ধারে পরবর্তী ২৪ ঘন্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৪৮ ঘণ্টা পর জীবিত মানুষের সংখ্যা অনেক কমে যায়।
আসলে হার্প কি? হার্প সম্পর্কিত আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে হার্প হল একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প যার লক্ষ্য আয়নোস্ফিয়ার বা ওজন স্তরের বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ অধ্যয়ন করা। আয়োনস্ফিয়ার সম্পর্কে নাসা বলেছে আয়নোস্ফিয়ার পৃথিবীর পৃষ্ঠের উপরে প্রায় ৫০ থেকে ৪০০ মাইল প্রসারিত একটি নিরপেক্ষ পর্দা। যা পৃথিবীর উপরের বায়ুম-লের সঙ্গে যেখানে আমরা বাস করি ও শ্বাস নেই সেই নি¤েœর বায়ুম-লের সীমানা হিসেবে কাজ করে।
সমবায় গবেষণা ও উন্নয়ন চুক্তির আওতায় ২০১৫ সালে আয়নোস্ফিয়ারিক ঘটনাবিদ্যার অন্বেষণ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী থেকে এ প্রকল্প আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। হার্প আয়নোস্ফিয়ার অধ্যয়নের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে সক্ষম উচ্চ-শক্তি, উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি ট্রান্সমিটার। এই প্রকল্প একটি বিশ্বমানের আয়নোস্ফিয়ারিক গবেষণা সুবিধা বিকাশের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্ব তথ্যকোষ উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে হার্প প্রকপ্লের যাত্রা শুরু ১৯৯০ সালে। যার অনুমোদন নিতে সাহায্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রিপাবলিকান সিনেটর টেড স্টিভেন। এবং ১৯৯৩ সালে প্রকল্পটির নির্মাণ শুরু হয়। তবে আদৌ কি মানব সৃষ্ট প্রযুক্তি দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটানো সম্ভব না কি নয় সে সম্পর্কে কোনো শক্তিশালী প্রমাণ আজও দিতে পারেনি কোনো পক্ষই।- ঢাকা প্রকাশ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com