বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্য ও সফলতার মানদ- হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বিসিএস ক্যাডার হওয়া’! সমাজের প্রায় প্রত্যেক অভিভাবকের ইচ্ছা—তার সন্তান একজন বিসিএস ক্যাডার হোক। অন্যদিকে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতায় একজন শিক্ষার্থীর মধ্যেও এমন বোধ জাগ্রত হয়—যেন বিসিএস ক্যাডার হতে পারাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য! কী অদ্ভুত প্রবণতা! বুয়েট, কুয়েটে পড়ে বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার উদাহরণ আমাদের দেশে ভূরি ভূরি। এ থেকে খুব স্পষ্টই বোঝা যায়, সমাজে বিসিএস উন্মাদনা কতটা প্রকট। শিক্ষা মানুষের জীবনযাপনের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি হলেও আমরা শিক্ষার সার্থকতা মূল্যায়ন করি শুধু সার্টিফিকেট দিয়ে। কিন্তু এ শিক্ষা একজন সুন্দর মানুষ হতে কিংবা সুন্দর জীবনযাপনে কতটুকু ফলপ্রসূ তা থেকে যায় আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে! ফি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, সবার লক্ষ্য যেন একটাই—বিসিএস ক্যাডার হওয়া। এই সংস্কৃতি দিনদিন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে—এই কথা বলাই বাহুল্য। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, চাকরি প্রার্থীরা প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষিত। সবারই রয়েছে নতুন কিছু সৃষ্টির যোগ্যতা। কিন্তু তাদের মধ্যে সেই সৃষ্টির ক্ষুধা তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশে ব্যর্থ। এমনকি আমাদের সমাজ সৃজনশীল ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান, মর্যাদা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতেও যেন প্রস্তুত নয়। সাংঘাতিক পরিতাপের বিষয়! মূলত এ কারণেই আমাদের যুবসমাজ বিসিএসের গত-বাঁধা মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়।
এ সমাজে বিসিএস ক্যাডারদের সবচেয়ে মেধাবী ও সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য সৃজনশীল কিংবা সৃষ্টিশীল হওয়ার বিশেষ কোনো প্রয়োজন পড়ে না। মুখস্থবিদ্যাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলেই কেল্লা ফতে—বিসিএস ক্যাডার হওয়ার রাস্তা ফাঁকা!
শিক্ষানীতি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান সঞ্চারণ, নতুন জ্ঞান উদ্ভাবন এবং সেই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। কিন্তু আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত খুব কম সংখ্যক মানুষ আছেন, যারা সৃজনশীল অর্থাৎ নতুন জ্ঞান উদ্ভাবনে আগ্রহী। উচ্চশিক্ষা মুক্তমনা অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, মননশীলতা ও চিন্তার স্বাধীনতা বিকাশে সহায়তা করে। এক্ষেত্রেও আমরা ক্রমাগত পেছনের দিকে হেঁটে চলেছি। বাস্তবতা হলো, শিক্ষাব্যবস্থা নির্দিষ্ট সিলেবাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মুক্তচিন্তা কিংবা নিজেকে সৃষ্টিশীলতার দিকে ধাবিত করার অনুকূলে নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশও। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেন বলেও মনে হয় না।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে ১৫ কোটি ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা কর্মের জন্য এই বরাদ্দকে কি কোনোভাবেই যথেষ্ট বলা যায়? উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? দুঃখজনক সত্য হলো, গবেষণার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিতেও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে, পড়ছে। এবং সত্যি বলতে, শিক্ষার্থীরা গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ না পেয়ে মুখস্থনির্ভর বিসিএসের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার নেশায় শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট কিছু বইয়ের সঙ্গে টেবিল-চেয়ারে নিজেদের সৃষ্টিশীল জীবনকে বন্দি করে ফেলছেন। এতে করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নিজের যে নতুন জ্ঞান উদ্ভাবনের যোগ্যতা রয়েছে, তা অনাবিষ্কৃতই থেকে যাচ্ছে!
একবিংশ শতাব্দীর এই প্রতিযোগিতার বিশ্বে টিকে থাকতে বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল, দূরদর্শী, অসাম্প্রদায়িক ও উদারনৈতিক জাতি গঠনের বিকল্প নেই। এজন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে। দেশে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে গেঁড়ে বসা মুখস্থনির্ভরতার সংস্কৃতির পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়কেও গুরুত্ব সহকারে আমলে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যেন প্রতিটি শিক্ষার্থী নিজের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করার সুযোগ পান। গত-বাঁধা মুখস্থবিদ্যার খোলস থেকে বেরিয়ে এসে সৃজনশীলতা, গবেষণা, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতে হবে চাকরির বাজারে। কেবল এর মধ্য দিয়েই উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়