শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের রেমিট্যান্স উৎসের শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

বিধি-নিষেধের পর চলতি অর্থবছরেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের রেমিট্যান্স উৎস হিসেবে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশের অর্থনীতিতে বিধিনিষেধের নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছিলেন তারা। যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে এর বিপরীত চিত্র। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান তিনটি খাতেই এখন মার্কিননির্ভরতা সবচেয়ে বেশি। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। ওই সময় বাংলাদেশের মোট রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান ছিল ২০ শতাংশেরও বেশি। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশটিতে পণ্য রফতানি হয়েছে ৫৭২ কোটি ডলারের কিছু বেশি, যা মোট রফতানির ১৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশটি থেকে ২২৬ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। এর আগে গত অর্থবছরে দেশে আসা মোট ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্সের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল প্রায় ৩৪৪ কোটি ডলার বা ১৬ শতাংশের কিছু বেশি। পুঞ্জীভূত এফডিআইয়ের (এফডিআই স্টক) উৎস হিসেবে দেশটির অবস্থান তালিকার প্রথমে। দেশে মোট এফডিআই স্টক প্রায় ২ হাজার ৫৩ কোটি ডলার। এর মধ্যে মার্কিন অবদান প্রায় এক-প মাংশ বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্যে উঠে এসেছে, যার পরিমাণ ৪০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট এফডিআই এসেছে ৪৬৩ কোটি ডলারের বেশি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৭০ কোটি ডলারের কাছাকাছি বা প্রায় ১৫ শতাংশ।
অর্থনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে এ ধরনের বিধিনিষেধের যোগসূত্র কম বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক কূটনীতিকরা। তাদের ভাষ্যমতে, বৈরিতা মাত্রা না ছাড়ালে কোনো একক সংস্থা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিধিনিষেধ ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টিকে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা সাধারণত এক করেন না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। বিধিনিষেধের চেয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ও কাঠামোগত সংকটই এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তুলনামূলক বেশি। দেশের অর্থনীতিতে মার্কিন অংশগ্রহণ ও অবদান আরো অনেক বেশি হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু কাঠামোগত সংকটের কারণেই দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রকৃত সুযোগ ও সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রধান অনুঘটক ব্যক্তি খাত। এখানে সরকারের অংশগ্রহণ কম। সেখানে রফতানি বাড়ার প্রধান অনুঘটক তৈরি পোশাক খাত। বাংলাদেশী পণ্যের মান বেড়েছে। আমাদের দাম প্রতিযোগিতামূলক এবং সেখানে প্রতিষ্ঠিত বাজার আছে। দ্বিতীয়ত, ওখান থেকে রেমিট্যান্স আসছে আমাদের বাঙালি কমিউনিটির কাছ থেকে। দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে স্থায়ী-অস্থায়ী অভিবাসন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়বে। তৃতীয়ত, এফডিআই বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি।’
মূলত কাঠামোগত সংকটের কারণেই দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে মার্কিন সরকার বিনিয়োগ করে না, বিনিয়োগ করে ব্যক্তি খাত। দেশটি থেকে বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো সেখানকার আইন অনুযায়ী কোনো মার্কিন কোম্পানি পৃথিবীর কোথাও ব্যবসা করতে গিয়ে কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বিচার করা যাবে। এ কারণে বাংলাদেশে দুর্নীতির অভিযোগ বেশি থাকায় মার্কিন অনেক কোম্পানি এখানে বিনিয়োগে ভয় পায়। আমরা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছি না এ ধরনের ইস্যুতে। আবার শ্রম অধিকারসহ কাঠামোগত ইস্যুতে আমাদের জিএসপি স্থগিত করে দেয়া হলো। এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশনের বিনিয়োগেও প্রবেশাধিকার হারালাম। ডোনাল্ড লু যখন এসেছিলেন; তাকে জিএসপি সুবিধা পুনরায় চালুর কথা বলা হলে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শ্রম অধিকার নিশ্চিতের কথা বলেছিলেন।’
বিশ্বায়িত বাজার ব্যবস্থার যুগে মার্কিন অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ ও এর কার্যকারিতা এখন অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকরা। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের (পিআইআইই) এক পলিসি পেপারে বলা হয়, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দেশগুলোর পারস্পরিক সংযুক্তি এখন ক্রমেই বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন একতরফা অর্থনৈতিক বিধিনিষেধের সুবিধা-অসুবিধাগুলোকেও ভালোভাবে অনুধাবনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। অধিকাংশ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যাদের ওপর অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, এর প্রভাবে তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন পাওয়া গেছে খুব সামান্যই। পিআইআইইর গবেষণায় দেখা গেছে, সত্তর ও আশির দশকে এক-প মাংশেরও কম ঘটনার ক্ষেত্রে মার্কিন বিধিনিষেধ ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পেরেছে।
বিধিনিষেধের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘২০২১ সালের ওই বিধিনিষেধের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি বা কার্যক্রমের যোগাযোগ নেই। বিধিনিষেধটির ধরনও সে রকম নয়। এতে দ্বিপক্ষীয় ব্যবসার ওপর কোনো প্রভাবও পড়েনি। দেশটির সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো প্রসারিত হওয়ার সুুযোগ রয়েছে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো সমৃদ্ধ হলে বা তারা যদি আমাদের এখান থেকে আরো পণ্য নেয় অথবা তারা যদি আমাদের আরো শুল্ক ছাড় দেয়; তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমাদের অনেক সুযোগ রয়েছে।’ এ মুহূর্তে বৈশ্বিক পরিম-লে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ইস্যুগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার একে অন্যের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লকের পাল্টাপাল্টি বিধিনিষেধ যুদ্ধ থামাতে সক্ষম না হলেও গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
দ্য ফোরাম ফর রিসার্চ অন ইস্টার্ন ইউরোপ অ্যান্ড এমার্জিং ইকোনমিস (ফ্রি নেটওয়ার্ক) প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক পলিসি পেপারে স্টকহোম ইনস্টিটিউট অব ট্রানজিশন ইকোনমিকসের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর মারিয়া পেরোত্তা বার্লিন উল্লেখ করেন, বিধিনিষেধের মাধ্যমে এর পেছনের উদ্দেশ্যটি তাৎক্ষণিকভাবে অর্জন না হলেও তা নানা মাত্রায় বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের ক্ষতির বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষা করার মতো নয়। এক্ষেত্রে যাদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, তারা বা তাদের উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও দীর্ঘমেয়াদে সম্পদ ক্ষয় হয়েই থাকে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্ষেত্রে বিধিনিষেধের প্রভাব পড়ার সুযোগ কম। আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে স্যাংশন কোনো প্রভাব ফেলেনি। দেশটির সব খাত আলাদা। বরং বিধিনিষেধ আরোপের পরও ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটিতে রফতানি হয়েছে ১১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখন খুবই ভালো। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে রফতানি বেশি হয়। আমদানি হয় কম। মূলত অতীব জরুরি পণ্যগুলোই সেখান থেকে আসছে বেশি; যেমন মেডিকেল ডিভাইস। দেশটিতে রফতানীকৃত পণ্যে বৈচিত্র্য আনা গেলে আমাদের সম্ভাবনা আরো বাড়বে। বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীরাও চেষ্টা করছেন। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসও সম্প্রতি একটি কমার্শিয়াল সার্ভিস অফিস চালু করেছে।’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেশের একটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। নীতিনির্ধারণী মহল থেকে তখন পশ্চিমের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমানোর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগাযোগ এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিধি বাড়াতে নানা ধরনের উদ্যোগের কথাও সামনে আসতে থাকে। যদিও ওই সময়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমেনি। বরং এ মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই নির্ভরশীলতা সবচেয়ে বেশি। মোটা দাগে বৈদেশিক মুদ্রার উৎস প্রধানত তিনটি রফতানি, রেমিট্যান্স ও প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে এ তিন উৎস থেকে মোট বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে ৭ হাজার ৭৭৫ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এর মধ্যে রেমিট্যান্স হিসেবে এসেছে ২ হাজার ১০৩ কোটি, রফতানি খাত থেকে এসেছে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ও এফডিআই এসেছে প্রায় ৪৬৪ কোটি। এ সময় খাত তিনটি মিলিয়ে মোট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মার্কিন অবদান ছিল প্রায় ১৯ শতাংশ, যার পরিমাণ ১ হাজার ৪৫৫ কোটি ডলারের বেশি।
এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবেও দেশটির অবস্থান এখন শীর্ষে। পুঞ্জীভূত এফডিআইয়ের উৎস হিসেবেও এখনো তালিকায় প্রথম স্থান যুক্তরাষ্ট্রের। বিধিনিষেধের ওই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছিলেন অনেকেই।
মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে অন্য কোনো দেশের সরকার বা সরকারি সংস্থার ওপর বিধিনিষেধ আরোপকে দেখা হয় চাপ প্রয়োগের বড় একটি মাধ্যম হিসেবে। এছাড়া কোনো ধরনের নিন্দাজ্ঞাপন বা দেশটির চোখে অবাঞ্ছনীয় কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়া হিসেবেও বিধিনিষেধ আরোপের পথ বেছে নেয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরেই বিধিনিষেধ আরোপের মতো পদক্ষেপের প্রয়োগ করে আসছে মার্কিন সরকার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব বিধিনিষেধের ফলাফল সংশ্লিষ্ট দেশের জন্য মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটেরও কারণ হয়ে উঠতে দেখা গেছে। বিশেষ করে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর দেশটির ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরোপিত নানা মাত্রার বিধিনিষেধ দেশটির অর্থনীতিকে মারাত্মক ধসের দিকে ঠেলে দিতে দেখা গেছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com