জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দ্রুত নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে যথোপযুক্ত পরিবেশ তৈরি ও তাদের গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র ও মানবাধিকার সংগঠন। ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সাম্প্রতিক চার বছর : টেকসই সমাধান নিশ্চিতের চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সাইড ইভেন্টে প্রদত্ত বক্তব্যে একথা বলেন জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশন উপলক্ষে বাংলাদেশ, কানাডা, সৌদি আরব ও তুরস্ক ইভেন্টটির আয়োজন করে। আলোচনা পর্বে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন মিয়ানমার বিষয়ক স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়ার (আইআইএমএম) প্রধান নিকোলাস কৌমজিয়ান। আলোচনা সভায় রাবাব ফাতেমা বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটে প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান। যা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মধ্যে নিহিত রয়েছে। আর এ প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সমস্যার প্রধান কারণগুলোকে চিহ্নিত করে তা নিষ্পত্তি, যথোপযুক্ত পরিবেশ তৈরি ও দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি অবনতির বিষয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
রাবাব ফাতেমা আরো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলমান এ সঙ্কটের বহুমাত্রিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করে তা আমলে নিয়ে এর স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। দায়বদ্ধতার দিক থেকে তিনি আইআইএমএমসহ আন্তর্জাতিক তদন্ত ও জুডিশিয়াল প্রক্রিয়া সমূহের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করতে এবং এই নৃশংস অপরাধে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণ খুঁজে বের করতে আসিয়ানসহ আঞ্চলিক অন্যান্য দেশগুলোকে আরো জোরদার ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান রাষ্ট্রদূত ফাতিমা। এছাড়া ২০১১ সাল থেকে মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ ও তথ্যাদি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে সংগ্রহের জন্য আইআইএমএম’র প্রধান নিকোলাস কৌমজিয়ান তার প্রচেষ্টা তুরে ধরেন। তাদের কাজ সম্পূর্ণ করতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানকারী দেশসমূহের কাছে যে সকল তথ্য রয়েছে তা আইআইএমএমকে সরবরাহ করার অনুরোধ জানান তিনি। রোহিঙ্গা ইস্যুটি কানাডা সরকারের ধারাবাহিক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি বিষয় জানিয়ে কানাডার স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত বব রায় এ সমস্যার মানবিক ও রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সমর্থনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের আওতাধীন বিচার কার্যসহ দায়বদ্ধতা নিরূপন প্রক্রিয়াগুলোতে তার সরকারের সমর্থন রয়েছে। সঙ্কটের শুরুতে পূর্ণ মানবিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে এবং এ পর্যন্ত এই বোঝা বহণ করে বাংলাদেশ যে উদারতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন সৌদি আরব ও তুরস্কের স্থায়ী প্রতিনিধি। রোহিঙ্গা নারীদের প্রতি নিপীড়ন ও সহিংসতাসহ ভয়াবহ এই অপরাধের দায়ভার নিরূপনের প্রতি জোর দেন যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যাম্বাসেডর রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
ইভেন্টটিতে আরো বক্তব্য রাখেন গাম্বিয়ার বিচার মন্ত্রণালয়ের আইন-উপদেষ্টা হুসেইন থামাসি, যুদ্ধকালে যৌন সহিংসতাবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি মিজ্ প্রমিলাপ্যাটেন, নিউইয়র্কস্থ জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই-কমিশনার মিজ্রুভেন মেনিকদিওলা, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজ-এ গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের মধ্যকার মামলার গাম্বিয়া পক্ষের আইন উপদেষ্টা ড. পায়াম আখওয়ান, গ্লোবাল সেন্টার ফর রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’র নির্বাহী পরিচালক ড. সাইমন অ্যাডামস্, গ্লোবাল জাস্টিজ সেন্টারের প্রেসিডেন্ট মিজ্ আকিলারাধা কৃষ্ণান, আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়নের মহাপরিচালক ড. ওয়াকার উদ্দিন। এছাড়া জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত সৌদি আরব, তুরস্ক, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস ও ইন্দোনেশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধিসহ অনেকেই সাইড ইভেন্টটিতে বক্তব্য প্রদান করেন। তাদের বক্তেব্যে প্রায় সকলেই এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।