ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকার সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছে, কিন্তু সম্প্রতি ইথিওপিয়ায় নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতকে আফ্রিকান ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলন থেকে বহিষ্কার করা নিয়ে হইচই হলেও সুদান ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ করছে। চলতি ২ ফেব্রুয়ারি সুদানে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফর করেন এবং সুদান ও ইসরাইলের মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে একমত হয়েছেন।
সুদানের অর্ন্তর্র্বতীকালীন সরকার বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ওয়াশিংটনে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। সুতরাং সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কোর পরে সুদান চতুর্থ দেশ হিসেবে তেলআবিবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি স্বাক্ষর করছে।
বশির সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসন আনার জন্য ইসরাইল কাজ করেছে বলে জনশ্রুতি আছে। সম্পর্কোন্নয়নের কাজ সামরিক সরকারের সাথে হয়েছে, কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষর করবে বেসামরিক সরকার। এই গণতন্ত্রপ্রীতি অনেক প্রশ্নবিদ্ধ। আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কোতে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার নেই। মরক্কোতে রাজার ইশারায় পার্লামেন্ট সদস্যরা নির্বাচিত হন। সেখানেও শেখডোমের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বুঝতে কোনো কষ্ট হয় না, সুদানের সামনে আরো দুর্দিন আসছে।
২০২০ সালের ২৩ অক্টোবর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সুদান ও ইসরাইলের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেন। এই সিদ্ধান্তের কিছু দিন আগে সুদানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ সমর্থনকারী দেশের তালিকা থেকে বাদ দেয়। এ জন্য সুদানকে অফিসিয়ালি প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়েছে ৩৩৫ মিলিয়ন ডলার। সুদানের সাথে বরফ গলে যাওয়া আরব লিগের প্রসিদ্ধ ‘তিন না’, ইসরাইলের সাথে শান্তি নেই, ইসরাইলের সাথে কোনো আলোচনা নেই, ইসরাইলের কোনো স্বীকৃতি নেই, নামে পরিচিত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটিও ভেস্তে যাচ্ছে। এর ফলে আরো আরব ও আফ্রিকান দেশ ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিকীকরণে এগিয়ে আসবে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে অনেক দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায় ইসরাইল- যেহেতু ইসরাইলি পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আফ্রিকা মহাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই মহাদেশীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে তেলআবিব প্রশাসনের অগ্রাধিকার অ্যাজেন্ডায় রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, আফ্রিকার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ইসরাইলের প্রচেষ্টা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন সেই সময়ে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি পেতে আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশক ইসরাইল-আফ্রিকা সম্পর্ক দ্রুত বিকশিত হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালে ইয়ুম কিপুর যুদ্ধ ও আরব দেশগুলোর তেল নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশির ভাগ আফ্রিকান রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। অর্গানাইজেশন অব আফ্রিকান ইউনিটিও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৯০ সালে ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ও ইসরাইলের মধ্যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে তেলআবিব প্রশাসন আবার আফ্রিকার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের দিকে মনোনিবেশ করে। যাই হোক, আফ্রিকা মহাদেশের জন্য উদ্যোগগুলো মূলত বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর যুগে গতি লাভ করেছিল। নেতানিয়াহুর এই প্রচেষ্টার ফলে চাদের সাথে সম্পর্ক হয়, যার সাথে ১৯৭২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ, যিনি নেতানিয়াহুর সক্রিয় আফ্রিকান নীতিতে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তিনিও এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে আহমাদিনেজাদের উত্তরসূরি হাসান রুহানি দীর্ঘদিন পররাষ্ট্রনীতিতে আফ্রিকান অ্যাজেন্ডাকে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছিলেন, যার ফলে মহাদেশে ইসরাইলের উপস্থিতি ও প্রসার সুবিধা পায়।
আফ্রিকার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নত করা ইসরাইলের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? ইসরাইল এমন একটি দেশ যাদের উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ কৃষিপদ্ধতি রয়েছে, তাদের প্রযুক্তি বৈশ্বিক কৃষিবাজারে স্থান পেয়েছে। ইসরাইলি কৃষি খাত, কৃষিপ্রযুক্তি, সেচ ব্যবস্থা এবং গরম ও শুষ্ক জলবায়ুর জন্য উপযুক্ত কৃষিসরঞ্জাম বিশ্বব্যাপী পরিচিত। আফ্রিকা মহাদেশে ইসরাইলি উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার উভয়ের জন্য বিশাল বাজার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
সুদান ২০২০ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায় ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছিল। ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মরক্কো আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ সম্পন্ন করেছে। ২০২১ সালে গোয়েন্দা মন্ত্রী হিসেবে কোহেন সুদানে রাজনৈতিক সফর করেছিলেন। ইসরাইলি সংবাদপত্র হারেৎজ ঘোষণা দেয়- আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দেয়ার পরবর্তী দেশ হবে সুদান। উল্লেখ্য, সুদানের সামরিক বাহিনী ২০২১ সালের অক্টোবরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশটির দায়িত্বে রয়েছে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সেনাঅভ্যুত্থানে ইসরাইলি গোয়েন্দাদের হাত রয়েছে। সেনারা বলছে, তারা বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছুক। বেসামরিক গোষ্ঠীগুলো চুক্তির বিরোধী। তারা চায়, যেকোনো চুক্তি অবশ্যই একটি অর্ন্তর্র্বতীকালীন সংসদে অনুমোদিত হতে হবে যা এখনো গঠিত হয়নি।
আরেকটি বিষয় যা আফ্রিকাকে ইসরাইলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে তা হলো- নিরাপত্তা প্রযুক্তি রফতানি। উন্নত নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা প্রযুক্তির জন্য পরিচিত ইসরাইল ২০২১ সালে প্রতিরক্ষা রফতানি থেকে প্রায় ১১.৫ বিলিয়ন ডলার অর্জন করে। তেলআবিব প্রশাসন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রতিরক্ষা শিল্পের পণ্য রফতানি করে। এই রফতানির মধ্যে সাধারণত নজরদারি সিস্টেম, পরিধি সুরক্ষা ব্যবস্থা, সাইবার নিরাপত্তা সমাধান ও মনুষ্যবিহীন আকাশযানের মতো বিভিন্ন পণ্য অন্তর্ভুক্ত। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিরাপত্তা ইস্যুতে লড়াই করা আফ্রিকান দেশগুলো ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তা ছাড়া, জাতিসঙ্ঘে প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোর এক-চতুর্থাংশ আফ্রিকান রাষ্ট্র। ফিলিস্তিনি সমস্যা যে দিকেই মোড় নিক না কেন, আফ্রিকার দেশগুলোর কূটনৈতিক সমর্থন পাওয়া তেলআবিবের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য।
ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে এই সফরের সময় উভয় পক্ষ চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করেছে। সুদানের সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান বিষয়গুলোতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সুদান সরকারি বিবৃতিতে জানায়- নিরাপত্তা, কৃষি, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, পানি ও শিক্ষা খাতে সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
ইসরাইল আফ্রিকান ইউনিয়নের সাথে শক্তিশালী সম্পর্কের পাশাপাশি আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে দৃঢ় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রাখতে চায়। ঐতিহাসিকভাবে ইসরাইল আফ্রিকান ইউনিয়নের পূর্বসূরি অর্গানাইজেশন অব আফ্রিকান ইউনিটির অংশ ছিল। ২০০২ সালে যখন আফ্রিকান ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির চাপে ইসরাইল সংস্থাটিতে তার পর্যবেক্ষকের মর্যাদা হারায়। ২০০৩ ও ২০১৬ সালে তেলআবিব প্রশাসন পর্যবেক্ষকের মর্যাদার জন্য আফ্রিকান ইউনিয়নের কাছে একটি অফিসিয়াল আবেদন করেছিল। তবে ফিলিস্তিন প্রশ্নের কারণে এসব আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। ২০২০ সালে আব্রাহাম চুক্তির পর তৃতীয়বারের মতো পর্যবেক্ষকের মর্যাদার জন্য আফ্রিকান ইউনিয়নের কাছে আবেদন করে। ২০২১ সালের ২২ জুলাই আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের প্রেসিডেন্ট চাদিয়ান মুসা ফাকি মাহামত ইসরাইলকে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার নেতৃত্বে আফ্রিকার ১৩টি দেশ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। প্রতিক্রিয়ার কারণে আফ্রিকান ইউনিয়ন এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করে।
ইসরাইল যখন ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আফ্রিকান ইউনিয়নের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের পরিষদের ৩৬তম সাধারণ অধিবেশনের জন্য অপেক্ষা করছিল, যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তখন একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইথিওপিয়ায় নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত শ্যারন বার-লিকে বহিষ্কার করা হয়, কারণ তিনি স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা পূরণ করেননি। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রবেশ ব্যাজসহ স্বীকৃত পর্যবেক্ষকের মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও আফ্রিকান ইউনিয়ন হল থেকে রাষ্ট্রদূত শ্যারন বার-লিকে অপসারণের বিষয়টি ইসরাইল কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ইসরাইল দাবি করে, ওই ঘটনাটি দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলজেরিয়ার কারণে হয়েছে।
ইসরাইলের আফ্রিকান নীতি কিছু বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক অভিনেতাদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিকীকরণের জন্য মার্কিন সমর্থন মরক্কো ও সুদানের মতো আফ্রিকান দেশগুলোতে প্রভাব ফেলেছে। অন্য দিকে, আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র ও তেলআবিবের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস আরব লিগের চাপ থেকে মুক্ত আফ্রিকান সদস্য রাষ্ট্রগুলোকেও ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক হওয়ার অনুমতি দেয়। অন্য দিকে, ফিলিস্তিন প্রশ্নই ইসরাইলকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আফ্রিকার অনেক দেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধা দিচ্ছে। অবশেষে ইরান, যার সাথে ইসরাইলের খুব উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, আফ্রিকার সাথে সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে সক্ষম। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান ফেব্রুয়ারির শুরুতে মৌরিতানিয়ার রাজধানী নোয়াকচোট সফর করে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তা এই অঞ্চলের প্রতি ইসরাইলের নীতির বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তিতে উৎসাহিত ইসরাইল আগামী সময়ে আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর সাথে তার সম্পর্ক উন্নত করার জন্য আরো সক্রিয় নীতি অনুসরণ করবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্রপাতের পর আফ্রিকায় অনেক বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির প্রতিযোগিতা বেড়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। ইসরাইল মনে করে, অন্যান্য পক্ষের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতা না করে মহাদেশে নিজস্ব স্থান তৈরি করার চেষ্টা চালানো উত্তম। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, গত বছরের শেষের দিকে দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে চরম ডানপন্থী সরকারের প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় ফিরে এসে, আরব ও মুসলিম বিশ্বে ইসরাইলি সম্পর্ক বিস্তৃত করাকে পররাষ্ট্রনীতির প্রধান কাজ বলেছেন। নেতানিয়াহু বারবার সৌদি আরবকে আব্রাহাম চুক্তিতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সৌদি আরবের শীর্ষ কূটনীতিকরা বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের সাথে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান না হলে তারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না।
সুদানে জাতিগত বিদ্বেষ, কোন্দলের কারণে অনেক সুদানি দেশত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছে মিসর, পার্শ্ববর্তী দেশ এমন কি ইসরাইলেও। ইসরাইলে প্রায় ৩০ হাজার সুদানি বসবাস করে কিন্তু ইসরাইলে ঢোকা সহজ নয়। গুলাগুলির কারণে অনেকে মারা যায়।
মিসরে সুদানের হাজার হাজার উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছে। সুদানে গৃহযুদ্ধের কারণে এসব জনগণ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত আতিক্রম করেছে। কিন্তু তারা মিসরে জাতিগত বৈষম্য ও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের সংখ্যা অনেক, দুই মিলিয়নের বেশি। সুদানি উদ্বাস্তুরা মিসরের সরকার ও সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছে। ১৯৯০ সালে হঠাৎ বেশি উদ্বাস্তু মিসরে যায়, ফলে মিসরে ঘরভাড়া বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান বেড়ে যায়। বর্ধিত ঘরভাড়া সুদানি উদ্বাস্তুদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কায়রোর শহরতলী ও দূরবর্তী স্থানে অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকে। অনেকে একই বাড়ি ভাগাভাগি করে দিনাতিপাত করে। সুদানি সংস্কৃতিতে ঘন ঘন পড়শিদের বাড়িতে যাওয়া ও দেখা-সাক্ষাৎ করার নিয়ম রয়েছে। এই প্রথার ফলে বাড়ির মালিকরা তিক্ত বিরক্ত হয় এবং অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম দেয়।
সুদানের শিশুরা মিসরে ২০০০ সাল থেকে বিনামূল্যে প্রাথমিক লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। এ সুবিধা পাওয়ার জন্য রেসিডেন্সি পারমিট ও একামা প্রয়োজন। তা ছাড়া কালো চামড়ার কারণে তাদের অনেক অবমাননাকর মন্তব্য শুনতে হয়। ডেনিশ এম্বাসি এসব ছেলেদের জন্য দুপুরে খাবার পরিবেশন করছে। কেননা, এসব ছেলেমেয়ে অভুক্ত অবস্থায় স্কুলে আসে। তবে মাধ্যমিক স্তরে সুদানি উদ্বাস্তুদের জন্য কোনো বিনামূল্যের লেখাপড়ার সুযোগ নেই। সুদান ও মিসরের সাথে সম্পর্ক মোটেও ভালো নয়। ইসরাইল আরব আফ্রিকান দেশগুলোর ভেতরকার বিরোধ কাজে লাগিয়ে স্বভাবিকীকরণের ভেলা ভাসিয়ে দিয়েছে। আব্রাহাম চুক্তির অগ্রগতি ও আলোচনা দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যেভাবে একটির পর একটি আফ্রো-আরব দেশ যোগ দেয়ার চেষ্টা-ফিকির করছে তাতে আব্রাহাম চুক্তি বা সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্ব যেন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরব বিশ্ব এখন ভুলে যাচ্ছে পূর্ব জেরুসালেমের কথা, পশ্চিম তীর দখল করার কথা। ভালো সম্পর্ক করতে গিয়ে প্রতিদিন গাজায় যে হারে মানুষ মারা হচ্ছে তাতে মনে হয় যেকোনো সময় গাজারও পতন হয়ে যাবে। মিসরের মতো অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোও যেন গাজাকে হিসাব থেকে বিয়োগ দিয়ে রেখেছে!
নেতানিয়াহু জানেন, ফিলিস্তিনি ভূখ-ের আনুষ্ঠানিক সংযুক্তিকরণে তাড়াহুড়া করার দরকার নেই, কারণ একটি বোঝাপড়া রয়েছে যে, দু’টি রাষ্ট্র কখনোই বাস্তবে পরিণত হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় নেতানিয়াহু ইসরাইলের ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ ও সংযুক্তি পরিকল্পনার জন্য সময় কিনছেন। এদিকে, দ্বি-রাষ্ট্র দৃষ্টান্তের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোর ফিলিস্তিনিদের জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচারের কিছুই করা হবে না। জিওনিজমের বিষয়গুলো পাঠ করলে বোঝা যাবে, কোনো ইসরাইলি সরকার ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রে সম্মত হবে না এবং আব্রাহাম চুক্তি দ্রুত নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে। কারণ দ্বি-রাষ্ট্রীয় রাজনীতির কোনো বৈধতা নেই। আব্রাহাম চুক্তিকে স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়েছে, কারণ দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনিদের একটি মানবিক প্রকল্প হিসেবে বজায় রাখতে চাইবে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তার দাতাদের প্রতি দায়বদ্ধ, এটি কখনো ফিলিস্তিনিদের জন্য ভালো নয়। ইয়াসির আরাফাত টিকতে পারেনি কিন্তু মাহমুদ আব্বাস টিকে রয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব দাতারা প্রচুর অর্থ দেয়। আব্বাসের বর্তমান সম্পদ ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। সুদান সম্পর্ক চূড়ান্তরূপ ধারণ করলে আরো আফ্রিকান দেশ সম্পর্কোন্নয়নের জন্য তাড়াহুড়ো করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার