সাহিত্য হলো জাতির দর্পণ। জাতির সংস্কৃতি ও সমাজ জীবনের বাস্তব চিত্র সাহিত্যের মাধ্যমে উঠে আসে বলেই সাহিত্যকে বলা হয় জাতির দর্পণ। পৃথিবীতে এমন কোনো মানব জাতির অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না যে জাতির সাহিত্য নেই। তেমনি আমাদেরও আছে সাহিত্য।
আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের ভাষা। আমরা বাংলায় কথা বলি, বাংলায় লিখি। তাই আমাদের সাহিত্যের নাম বাংলা সাহিত্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের ইতিহাস। ভাষা ও সাহিত্যের সাথে একটি বিরাট যোগসূত্র রয়েছে। সাহিত্য ভাষাকে পরিবর্তন করে বদলে দেয়। ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। অন্য সব কিছুর মতো ভাষাও জন্ম নেয়। বিকশিত হয়, কালে কালে রূপ বদলায়।
আজ যে বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, কবিতা লিখি, গান গাই, অনেক আগে এ-ভাষা এ রকম ছিল না। তাই বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস প্রথমত জানতে হবে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে গৌড়ীয় প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব। অন্য দিকে ড. সুনীতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে মাগধী প্রাকৃত থেকে। এ ছাড়া আয়ারল্যান্ডের খ্যাতিমান ভাষাতত্ত্ববিদ জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন মনে করেন, মাগধী প্রাকৃতের কোনো পূর্বাঞ্চলীয় রূপ থেকে জন্ম নিয়েছে বাংলা ভাষা।
বাংলা ভাষার প্রথম বই চর্যাপদ। আমরা অনেকে পড়তে পারব না। অর্থ তো একবিন্দুও বুঝব না। যার অনেক শব্দ আজ আর কেউ ব্যবহার করে না। সে ভাষার বানানও আজকের মতো নয়। কিন্তু চর্যাপদ এ যে বাংলা ভাষা সৃষ্টি হয়, তা তো এক দিনে হয়নি। হঠাৎ বাংলা ভাষা সৃষ্টি হয়ে এসে কবিদের বলেনি, ‘আমাকে দিয়ে কবিতা লেখো’, বাংলা ভাষা আরো একটি পুরনো ভাষার ক্রম বদলের ফল। এই পুরনো ভাষাটির নাম ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা’ মানুষের মুখে মুখে বদলে পরিণত হয়েছে বাংলা ভাষায়। ভাষা বদলায় মানুষের কণ্ঠে। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা দিনে দিনে বদলে একসময় হয়ে ওঠে বাংলাভাষা।
খামখেয়ালে ভাষা বদলায় না। ভাষা মেনে চলে কতকগুলো নিয়মকানুন। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা এক দিন পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় ‘পালি’ নামক এক ভাষার। পালি ভাষায় বৌদ্ধরা তাদের ধর্মগ্রন্থ ও অন্যান্য নানা রকমের বই লিখেছে। পালি ভাষা ক্রমে আরো পরিবর্তিত হয়। তার উচ্চারণ আরো সহজ-সরল রূপ নেয় এবং জন্ম নেয় ‘প্রাকৃত ভাষা’। এ বদল এক দিনে হয়নি। প্রায় হাজার বছরেরও বেশি সময় লেগেছে এর জন্য।
প্রাকৃত ভাষা আবার বদলাতে থাকে, অনেক দিন ধরে বদলায়। তার পর দশম শতকের মাঝ ভাগে এসে এ প্রাকৃত ভাষার আরো বদলানো একটি রূপ থেকে উদ্ভব হয় একটি নতুন ভাষা, যার নাম বাংলা। বাংলা ভাষার উদ্ভব প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা বংশের অন্তর্গত। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শ’ বছর পূর্বে এ মূল ভাষা বংশের অস্তিত্ব ছিল। এ ভাষা আমাদের। ক্রমে এ ভাষা সাহিত্যে নানা পরিবর্তন, শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে। অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকরা বাংলা সাহিত্যে নিজেদের নানামুখী পরিচয় দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে করেছেন গৌরবান্বিত। তাই আজকের বাংলা সাহিত্যে বিশে^র অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হিসেবে বিশ^ সাহিত্যের পরিম-লে পরিচিতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের সম্ভাব্য জন্ম থেকে এ পর্যন্ত সময়কালকে তিন যুগে ভাগ করা হয়েছে। এর প্রথম ভাগ হচ্ছে প্রাচীন বা আদিযুগ। দ্বিতীয় ভাগ মধ্যযুগ ও শেষ ভাগ হচ্ছে আধুনিক যুগ। এ তিন যুগের কবি সাহিত্যিকদের লেখা সাহিত্যই হচ্ছে আমাদের বাংলা সাহিত্য।
প্রাচীন যুগের যাত্রাটা কবে শুরু হয়েছিল তা আজো অনাবিষ্কৃত হলেও কোনো কোনো ঐতিহাসিকরা বলেন, দশম শতকের মধ্যভাগ, কেউ বলেনÑ ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ, কেউ বলেনÑ ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়। মূলকথা হচ্ছে দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল হলো বাংলা সাহিত্যের আদিযুগ। এ যুগের নিদর্শন চর্যাপদ ওই সময়ের মধ্যেই রচিত হয়েছিল, এ সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি হলেন, কবি লুইপাদ, কবি চাটিল্লপাদ, কবি ভুসুকপাদ, কবি কাহৃপাদ, কবি ডাম্বিপাদ, কবি শান্তিপাদ প্রমুখ। আদি যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ থেকে আমরা ২৩ জন কবিকে পেয়েছি। এদের সবাই ছিলেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য, তাদের বিশ^াস, তাদের অনুমান, তাদের আদেশের কথা তাদের পদ বা কবিতায় তারা লিপিবদ্ধ করেছেন। রহস্যময় বাংলা ভাষায় পদগুলো রচিত হলেও চর্যাপদ যে বাংলা ভাষার সম্পদ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাঙালির চিরায়তে দুঃখ-দারিদ্র্যের ছবি চর্যাপদেও পাওয়া যায়।
প্রাচীন যুগের পর মধ্যযুগ হলেও কোনো কোনো ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের মাঝখানে আরো একটি যুগ বা কাল ছিল। সেটি হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ। সেই সময়টা হচ্ছে ১২০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত। এ সময়কে অন্ধকার যুগ এ জন্য বলা হয় যে, এ সময়ে কোনো সাহিত্য রচিত হয়নি। আবার কেউ কেউ বলেন বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ বলতে কোনো যুগ নেই। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ওই দেড়শ’ বছরকে অন্ধকার যুগ বলে চিহ্নিত করতে চাইলেও তারা সফল হতে পারেননি। ওই সময়ে ওলি-আউলিয়া ও নবী-রাসূলদের নিয়ে মুসলমান পুঁথিকর্মীরা সবচেয়ে বেশি পুঁথি রচনা করেছেন বলে কথিত আছে। ছয়ফল মুলুক বদিউজ্জামালের পুঁথিও এ সময় রচিত হয়েছে এবং প্রকাশিত হয়েছে ১২-৩৫ সালের দিকে।
মধ্যযুগ যে সময়েই শুরু হোক না কেন, ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে যে এর সমাপ্তি ঘটেছে এতে কারো দ্বিমত নেই। মধ্যযুগের অন্যতম নিদর্শন বাংলা পুঁথিসাহিত্য। এ সময় প্রচুর গীতিকাব্য, কাহিনীকাব্য রচিত হয়েছে। এ সময়ের কবি হলেনÑ বড়ু চ-িদাস, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয় গুপ্ত, চ-িদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞান দাস, গোবিন্দ দাস, ভারত চন্দ্র, আলাওল, শাহ মুহাম্মদ সগীর, কাজি দৌলত প্রমুখ। মধ্যযুগের নিদর্শন ‘মঙ্গলকাব্য’, ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ ইত্যাদি। কবি বড়ু চ-িদাস, মধ্যযুগের প্রথম কবি। তার কাব্যের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। এটি মধ্যযুগের প্রথম নিদর্শন। বৈষ্ণব ধর্মমত নিয়ে লেখা হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলী নামে একধরনের পদ বা কবিতা। এতে চ-িদাস বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস প্রমুখের মতো অনেক কবি খুব উজ্জ্বল প্রতিভার পরিচয় দান করেছেন।
মধ্যযুগ ছিল এক বৈচিত্র্যধর্মী সময়। এ সময় জীবনী কাব্য, অনুবাদ কাব্য, নাথ সাহিত্য, পুঁথি সাহিত্য ও কবিদের বিকাশ ঘটে। সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, হিন্দি প্রভৃতি সাহিত্য অপেক্ষা উন্নত ধরনের সাহিত্য বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। এ সময়ের সব কাব্যে ধর্মের বিষয় প্রধান্য পেয়েছিল। কিন্তু মুসলমানদের হাতে যেসব কাব্য রচিত হয়েছিল, তাতে মানব মনের আনন্দ-বেদনার সুন্দর পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী কবিদের রচিত সাহিত্যে তাদের দেব-দেবীর কথা বলা হয়েছে। অথচ মুসলমান কবিরা তাদের রচিত সাহিত্যে মানুষের কথা বলেছেন। এভাবেই মধ্যযুগের সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে।
আধুনিক যুগে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য। মধ্যযুগ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে শুধু কবিতা। ১৮০১ সাল থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে গদ্য রচনার প্রচলন শুরু হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকরা সুপরিকল্পিতভাবে বিকাশ ঘটান বাংলা গদ্য সাহিত্যের। তাদের প্রধান ছিলেন উইলিয়াম কেরি। কেরির সহযোগিতায় ছিলেন রামরাম বসু। উনিশ শতকের প্রথম পাঁচ শতক কেটেছে সদ্য জন্ম নেয়া গদ্য সাহিত্য চর্চায়। বিভিন্ন লেখক নিজ নিজ ভঙ্গিতে রচনা করেছেন গদ্য। ফলে গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ প্রভৃতি ব্যাপকভাবে রচিত হতে থাকে। এ সময়ে বিশ^ সাহিত্যের ইংরেজি সাহিত্যসহ বিভিন্ন ভাষাভাষি সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটতে থাকে বাঙালিদের। সেসব সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হতে থাকে। এ সময়ের সাহিত্য মানুষের জীবন খুব সার্থকভাবে প্রতিফলিত হয়। বাংলা সাহিত্যে এ যুগের উল্লেখযোগ্য কবি সাহিত্যিকরা হলেনÑ রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার দত্ত, প্যারীচাঁদ সিংহ, কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, কায়কোবাদ, কাজী নজরুল ইসলাম,
শামসুর রাহমান, আল মাহমুদসহ আরো অনেকে।
আধুনিক যুগের গদ্য লেখক হলেনÑ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাজা রামমোহন রায়, তিনিই সর্বপ্রথম সাধুভাষায় বেদান্ত গ্রন্থ রচনা করেন ১৮১৫ সালে। গদ্যের মাধ্যমে সাহিত্যে আসে বৈচিত্র্য। প্রথম উপন্যাস লেখেন প্যারীচাঁদ মিত্র, টেকচাঁদ ঠাকুর, উপন্যাসের নাম ‘আলালের ঘরে দুলাল’। আধুনিক কালের একজন মহান প্রতিভার অধিকারী মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
তিনি ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য রচনা করেন। তার হাতে আমরা প্রথম মহাকাব্য পাই, পাই সনেট, ট্র্যাজেডি। পাই কৃষ্ণকুমারী নাটক। পাই প্রহসন, নাম বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই বলে সভ্যতা। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তাও ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবির্ভাবে বাংলা সাহিত্য সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেছে। তিনি মুক্তক ছন্দের প্রবক্তা। বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য হাজারো বছরের বেশি হলেও বিগত দেড় শ’ বছর ধরে এর বিস্ময়কর উন্নতি সাধিত হয়। প্রমথ চৌধুরী ১৯১৪ সালে চলিত ভাষার সংগ্রাম শুরু করেন, যা বর্তমান সময়ে ব্যাপক প্রচলিত। আধুনিক বাংলা ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলা সাহিত্য তার উৎকর্ষের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যগুলোর অন্যতম বলে বিবেচিত হয় আধুনিক যুগে। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অসংখ্য কৃতিমান কবি সাহিত্যিকগণ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। আধুনিক যুগের কবিদের হাতেই আবিষ্কৃত হয়েছে কবিতার লিখিত ব্যাকরণ।
সেই হাজার বছর পূর্বের বাংলা ভাষা আর বর্তমান আধুনিককালের বাংলা ভাষায় কত পার্থক্য। সে সময়ের কবিদের কবিতায় ব্যবহৃত ভাষা আর এ সময়ের কবিদের ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে অনেক পার্থক্য। আগামীতে আরো পার্থক্য আসতেই পারে।