ইসলাম মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণের চেয়ে বিশ্বাস ও মনের অবস্থাকে বেশি মূল্যায়ন করে। অন্তরের ঈমান, পরিশুদ্ধতা ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার বিচারেই পরকালে মানুষ তার কাজের প্রতিদান পাবে। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই নিয়তের ওপর সব কাজের ফলাফল নির্ভর করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১)
মানবমনের গুরুত্ব : মানুষের বাহ্যিক আমলের গ্রহণযোগ্যতা তার বিশ্বাস ও মনোবৃত্তির ওপর নির্ভর করে। পরকালে কেবল পরিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারীরাই মুক্তি পাবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি কোনো কাজে আসবে না; সেদিন উপকৃত হবে কেবল সে, যে আল্লাহর কাছে আসবে বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে।’ (সুরা : আশ-শুআরা, আয়াত : ৮৮-৮৯)
মানবমনের অবস্থা:পবিত্র কোরআনে মানবমনের বিভিন্ন অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি কোরআন বর্ণনাও করেছে এগুলোর মধ্যে কোনটি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি সংশোধনযোগ্য। নিম্নে এমন কয়েকটি অবস্থা তুলে ধরা হলো।
১. বিশ্বাসী মন : আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন তার অন্তরকে বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত করেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখো যে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসুল আছেন; তিনি বহু বিষয়ে তোমাদের কথা শুনলে তোমরাই কষ্ট পেতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তোমাদের অন্তরে ঈমানকে শোভিত করেছেন। কুফরি, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে করেছেন তোমাদের কাছে অপ্রিয়। তারাই সৎপথ অবলম্বনকারী।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ৭)
২. বিনীত মন : যাদের হৃদয় বিনীত তাদের জন্য আল্লাহর ঘোষণা হলো, ‘যারা না দেখে দয়াময় আল্লাহকে ভয় করে এবং বিনীত চিত্তে উপস্থিত হয়, তাদের বলা হবে, শান্তির সঙ্গে তোমরা তাতে প্রবেশ করো, এটা অনন্ত জীবনের দিন।’ (সুরা : কাফ, আয়াত : ৩৩-৩৪)
৩. সুস্থ মন : সুস্থ হৃদয়ের অধিকারীদের আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি কোনো কাজে আসবে না; সেদিন উপকৃত হবে কেবল সে, যে আল্লাহর কাছে আসবে বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে।’ (সুরা : আশ-শুআরা, আয়াত : ৮৮-৮৯)
৪. প্রশান্ত মন : যে মনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস যত দৃঢ়, তা তত বেশি প্রশান্ত। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ২৮)
৫. বিগলিত মন : আল্লাহ তাঁর ভালোবাসায় বিগলিত অন্তর ভালোবাসেন। আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় ভক্তি-বিগলিত হওয়ার সময় কি আসেনি, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে?’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ১৬)
৬. ভীত মন : আল্লাহর ভয় মুমিনকে পরিশুদ্ধ জীবনযাপনে সাহায্য করে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাদের প্রতিপালকের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে—এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে, তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী হয়।’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৬০-৬১)
৭. দৃঢ় মন : আল্লাহ ও পরকালের বিশ্বাসে মুমিনদের অন্তর দৃঢ় থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘রাসুলদের যেসব বৃত্তান্ত আমি তোমার কাছে বর্ণনা করছি, যা দ্বারা আমি তোমার অন্তরকে দৃঢ় করি, এটার মাধ্যমে তোমার কাছে এসেছে সত্য এবং মুমিনদের জন্য এসেছে উপদেশ ও সাবধানবাণী।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১২০)
৮. অসুস্থ মন : অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের অন্তর থাকে অসুস্থ। ফলে তারা ঈমানের স্বাদ পায় না। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের অন্তরে ব্যাধি আছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন ও তাদের জন্য আছে কষ্টদায়ক শাস্তি। কেননা তারা মিথ্যাবাদী।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১০)
৯. অমনোযোগী মন : দ্বিন ও ভালো কাজের ব্যাপারে অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের অন্তর অমনোযোগী থাকে। ফলে তারা সত্য থেকে বি ত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখনই তাদের কাছে তাদের প্রতিপালকের কোনো নতুন উপদেশ আসে, তারা তা শ্রবণ করে কৌতুকচ্ছলে, তাদের অন্তর থাকে অমনোযোগী।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ২-৩)
১০. মোহরাঙ্কিত মন : পাপের আধিক্যের কারণে আল্লাহ কোনো মানুষের অন্তরে মোহর মেরে দেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাদের হৃদয় ও কানে মোহর করে দিয়েছেন। তাদের চোখের ওপর আবরণ আছে এবং তাদের জন্য আছে মহাশাস্তি।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৭)
১১. আচ্ছাদিত মন : পাপের আবরণে আচ্ছাদিত মনে ঈমানের আলো প্রবেশ করে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা বলেছিল, আমাদের হৃদয় আচ্ছাদিত, বরং কুফরির জন্য আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেছেন। সুতরাং তাদের অল্পসংখ্যকই ঈমান আনে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৮৮)
১২. জংধরা মন : অবিরাম পাপের কারণে মানুষের অন্তরে জং ধরে যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘কখনো না, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের হৃদয়ে জং ধরিয়েছে।’ (সুরা : মুতাফফিফিন, আয়াত : ১৪)
১৩. অন্ধ মন : কখনো মানুষের হৃদয় অন্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘বস্তুত চোখ তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হয়েছে তাদের বক্ষস্থ হৃদয়।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪৬)
১৪. কঠোর মন : আল্লাহ কঠোর মনের মানুষদের অপছন্দ করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এর পরও তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেল, তা পাথর বা তার চেয়ে কঠিন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৭৪)
১৫. ভঙ্গুর মন : কখনো কখনো মানুষের মন ভেঙে যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের ঘর যা তারা নির্মাণ করেছে তা তাদের অন্তরে সন্দেহের কারণ হয়ে থাকবে—যে পর্যন্ত তা তাদের অন্তর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১১০) আল্লাহ সবাইকে সুস্থ মনের অধিকারী করুন। আমিন।