মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:২৩ অপরাহ্ন

মুসলিম নৌশক্তির উত্থান উমাইয়া আমলে

আহমেদ দীন রুমি
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০২৩

শেষ পর্যন্ত রাজি করানো গেছে খলিফাকে। প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন মুয়াবিয়া। সঙ্গে রয়েছেন উবাদাহ ইবনে সামিত, মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ, আবু আইয়ুব আনসারি ও আবু জর গিফারি। অভিযানে অংশগ্রহণ করার জন্য এগিয়ে এসেছেন আরো অনেকে। আক্রা থেকে ভূমধ্যসাগরের জলপথ চিড়ে নৌবাহিনীটি যখন সাইপ্রাস অবরোধ করল, শীত তখন শেষ দিকে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ সাইপ্রাস। স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার সেনাবাহিনীর অপেক্ষায় ছিল নাগরিকরা। কোনো প্রকার সাহায্য না পেয়ে অবশেষে চুক্তি করল আরব বাহিনীর সঙ্গে। মুসলিম বাহিনী তাদের সার্বিক নিরাপত্তা দেবে। বিপরীতে বছরে ৭ হাজার ২০০ দিনার ট্যাক্স প্রদান করবে সাইপ্রাস। অবগত করবে বাইজেন্টাইন বাহিনীর পরবর্তী তৎপরতা। যদি কোনোভাবে বাইজেন্টাইন বাহিনী আক্রমণ করেও বসে, তাদের সহযোগিতা করবে না। ৬৪৯ সালে এভাবেই প্রথমবারের মতো ভূমধ্যসাগরের কোনো অংশ মুসলিম নিয়ন্ত্রণে এল। প্রথমবারের মতো চমক দেখাল নৌবহর। চুক্তিটিকে বিজয়ের সমার্থক হিসেবেই চিহ্নিত গণ্য করে আরব শিবির। এ চুক্তিই উসকে দেয় পরবর্তী অভিযানের বারুদ।
তবে খলিফা উসমানকে রাজি করা সহজ ছিল না। আসলে নদী ও সমুদ্রের সঙ্গে আরবদের সম্পর্ক অতটা ভালো ছিল না। প্রয়োজনও পড়েনি কখনো। ইয়ামেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ স্থলপথ তখন বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্য যথেষ্ট। উটের কাফেলা ভারত মহাসাগরের বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে শামের বন্দরে খালাস করত জলপথের ঝামেলা ব্যতিরেকেই। যাত্রাপথের সুবিধার জন্য গড়ে উঠেছিল গোত্রীয় মৈত্রী। এভাবে ব্যবসা করেই প্রভূত সম্পদ জমিয়েছিলেন মক্কার অভিজাতরা। খুব অল্প মানুষ আবিসিনিয়া কিংবা সিন্ধু অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যের সুবাদে সমুদ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটে ইসলামের আগমনে। নবি কেবল সমুদ্র অভিযানে উৎসাহই দেননি; ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন কয়েকটি অভিযান সম্পর্কে। ফলে মুসলিম শিবিরে নৌবহর নিয়ে বাড়তি আগ্রহ ছিল। বাইজেন্টাইন সম্রাটের নজরকাড়া নৌবহর। তাদের সঙ্গে টক্কর দিতে চাইলে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে নৌবহর ছাড়া সম্ভব না। বিষয়টা সবার আগে টের পান শামের গভর্নর মুয়াবিয়া। খলিফা উমরের আমলে তিনি কয়েক দফা চেষ্টা করেছেন নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠার। সফল হননি। সম্প্রসারণশীল ছোট মুসলিম বাহিনীকে সমুদ্রে পাঠানোটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতেন খলিফা উমর। যথেষ্ট কারণও ছিল ভাবার পেছনে। প্রথমত, আরবদের সমুদ্রকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি। দ্বিতীয়ত, বাহরাইনের গভর্নর আল-আলা আল-হাদরামির সময়ে পারস্য উপসাগরে নৌ-অভিযানের প্রচেষ্টায় ব্যর্থতা। খলিফা উমরের পর দায়িত্ব গ্রহণ করেন উসমান। এ সময় পুনরায় নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ নিয়ে হাজির হন মুয়াবিয়া। প্রথম দিকে অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত সাইপ্রাস অভিযানের অনুমতি দেন খলিফা। ৬৪৯ সালের সফল অভিযান আরব সাম্রাজ্যের জন্য সমুদ্রপথকে নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত করে। সিরিয়ার দায়িত্বে থাকা মুয়াবিয়া ভূমধ্যসাগরকেন্দ্রিক রাজনীতি বুঝতে দেরি করেননি। ফলে সাইপ্রাসের চুক্তি তাকে নতুনভাবে পরিকল্পনা চালাতে অনুপ্রাণিত করে। তার নজির দেখা যায় ৬৫৪ সালে। মুসলমানরা একদিক থেকে ভূমধ্যসাগারের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে ছড়িয়ে পড়ছে। ভূখ-ের অধিকাংশই আগে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত ছিল। অল্প অল্প করে উত্তর আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোকে হাতছাড়া হতে দেখে টনক নড়ে সম্রাট হেরাক্লিয়াসের। হারানো অংশকে উদ্ধার করতে আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন ৫০০-৬০০ রণতরী। অভিযানের গুঞ্জন শুনেই নড়েচড়ে বসেন মুসলিম জাহানের খলিফা। বাইজেন্টাইন বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে একত্র হন দুই নৌ কমান্ডার। প্রথমজন মিসরের নৌবহরের প্রধান আবদুল্লাহ ইবনে সাদ, দ্বিতীয়জন শামের নৌবহরের প্রধান বিসর ইবনে আরতাহ। ক্রমেই অনিবার্য হয়ে উঠতে থাকে সংঘর্ষ। আলেকজান্দ্রিয়ার পশ্চিমে মারসি মাতরুহ শহরে মুখোমুখি হয় বাইজেন্টাইন ও আরব শিবির। মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে তখন আমর ইবনে সুফিয়ান। বাইজেন্টাইন বাহিনী নৌযুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই পারদর্শী। বিপরীতে আরবরা স্থলপথে পারসিক ও বাইজেন্টাইন পরাশক্তিকে দাপটের সঙ্গে পরাজিত করতে পারলেও সমুদ্রযাত্রায় ছিল অনভ্যস্ত। সৈন্যের সংখ্যায়ও এগিয়ে ছিল বাইজেন্টাইন। ফলে বিজয় প্রায় অনুমান করেই রেখেছিল তারা। অথচ বিজয় ধরা দেয় আরবদের হাতে। অপ্রস্তুত বাইজেন্টাইন শিবির পরাজয় নিশ্চিত জেনে সিসিলিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সে সূত্র ধরেই সিসিলি অধিকার করে নেয় মুসলিম বাহিনী। তারপর সময়ের ব্যবধানে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় সাইপ্রাস, ক্রিট, কর্সিকা ও সার্দিনিয়ায়। যা-ই হোক, ভূমধ্যসাগরে আরবদের প্রথম পরিচালিত এ নৌযুদ্ধকে বাইজেন্টাইন ঐতিহাসিক থিওফেনিস তুলনা করেছেন ইয়ারমুকের যুদ্ধের সঙ্গে। মুসলিম ইতিহাসিকরা একে লিপিবদ্ধ করেছেন ‘জাত আস-সাওয়ারি’ যুদ্ধ নামে।
আততায়ীর হাতে খলিফা আলি নিহত হওয়ার পর ক্ষমতায় আসেন মুয়াবিয়া। ৬৬৮ সালে তিনি বসফরাস প্রণালির তীরবর্তী ক্যালসিডন অবরোধ করেন। ঠিক পরের বছর মুসলিম বাহিনী বসফরাস অতিক্রম করে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে আঘাত হানার জন্য। যদিও আমোরিয়ামের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয় এ অগ্রযাত্রা। উমাইয়া আমলে বেশ কয়েকবার পরিচালিত হয়েছে নৌপথ অভিযান। দুইবার মুসলিম বাহিনী বাইজেন্টাইন রাজধানীর খুবই নিকটবর্তী স্থানে হাজির হয়েছিল। প্রথমবার ৬৬৯ সালে ও দ্বিতীয়বার ৭১৭ সালে। ৬৬৯ সালে বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া। তার সঙ্গে ছিলেন ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর, ইবনে জুবায়ের এবং আবু আইয়ুব আনসারি। ৭১৭ সালে ছিলেন মাসলামা বিন আবদুল মালিক। প্রথমদিকে মাত্র একটি জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র ছিল মিসরে। মুয়াবিয়া সিরিয়ার গভর্নর থাকাকালে আক্রায় আরেকটি কেন্দ্র স্থাপন করেন। বিপুলসংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয় কারখানায়। মুসলমানরা ভূমধ্যসাগরের পূর্ব ও দক্ষিণ তীরে অবস্থান শক্ত করতে থাকে। সেই সঙ্গে শক্ত হতে থাকে ভূমধ্যসাগরের বুকে নজরদারি। অধিগ্রহণ করে নিতে থাকে একের পর এক দ্বীপ। তাতে গড়ে উঠতে থাকে সেনাছাউনি। দুই দফা অভিযান পরিচালনা করে রোডস দ্বীপ দখল করে নেন জানাদা ইবনে আবি উমাইয়া। অবশ্য তার আগে সমরনেতা হিসেবে ক্রিটস ও রোডসে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন মুয়াবিয়া। মুয়াবিয়ার আমলে ভূমধ্যসাগরে তৎপরতায় গুরুত্বপূর্ণ নৌকমান্ডার হিসেবে বিবেচিত জানাদা। ঐতিহাসিক ইয়াকুবির মতে, জানাদাই অভিযান পরিচালনা করেন টারসাসে। ৬৭৬ সালের দিকে বেশ বড়সড় অভিযান পরিচালনা করেন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। অধিকার করে নেন কনস্টান্টিনোপলের নিকটবর্তী ইরওয়াদ দ্বীপ। বাইজেন্টাইন সম্রাট চতুর্থ কনস্টান্টাইনের সময় আরো একবার রাজধানী অবরোধের চেষ্টা করা হয়। নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াজিদ। তবে এবারো ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হয়। আরব নৌবহর তখন মরমর সাগরের তীরবর্তী সিজিকাস উপদ্বীপে নোঙর করেছিল। কনস্টান্টিনোপলে অভিযান পরিচালনা করা আরব নৌসেনাদের জন্য সিজিকাস ক্রমেই সরব কেন্দ্রে পরিণত হয়। ৬৭৭ সালে বাইজেন্টাইন নৌবাহিনীর মুখোমুখি হয় মুসলিম নৌবহর। তবে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। ঠিক পরের বছরই অবরোধ তুলে নিয়ে ফেরত আসতে হয় উমাইয়া নৌসেনাদের। ৬৮০ সালে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর আরব নৌবহর বসফরাস ও ইজিয়ানের তীর থেকে সরে আসে। তবে ততদিনে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ফলে দীর্ঘ সময়ের জন্য থেমে যায় এশিয়া মাইনর ও ইজিয়ান সাগরে অভিযান। তবে ভূমধ্যসাগরের তীরগুলোর পূর্ব ও দক্ষিণ উপকূলের পাশাপাশি অধিভুক্ত দ্বীপগুলোতে থাকে সরব উপস্থিতি। আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের সময়ে জাহাজ কারখানা স্থাপিত হয় তিউনিসে। তার সময়েই ইরাক থেকে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত হন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। প্রশাসক হিসেবে নানা বিষয়ে সমালোচিত ছিলেন হাজ্জাজ। তবে তার সময়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সমুদ্রপথের বাণিজ্যে সম্প্রসারণ। আরবরা ক্রমেই উৎসাহিত হতে থাকে সমুদ্র বাণিজ্যে। তাদের বাণিজ্যিক নৌবহর ছড়িয়ে ছিল সিংহল দ্বীপ পর্যন্ত। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা যেতে পারে সিন্ধুর অভিযানের ইতিহাস। জলদস্যুদের দ্বারা বাণিজ্যিক জাহাজ লুণ্ঠিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায়ই হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধু অভিযানে পাঠান মুহম্মদ বিন কাসিমকে। ৯৩ হিজরি সালে সিন্ধু অভিযানের সময় মুহম্মদ বিন কাসিমের সেনাবাহিনী শিরাজের স্থলপথ দিয়ে এলেও সেনাদলের অপর অংশ খাদ্যশস্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে সমুদ্রপথে। থাট্টার দেবল বন্দর অধিকার করে তারা সামনে অগ্রসর হতে থাকে। এগিয়ে যাওয়া সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা হয়েছে সমুদ্রপথেও। তারও পরে ১০৭ হিজরিতে জুনাইদ ইবনে আবদুর রহমান আল-মুররী সিন্ধুর শাসক নিযুক্ত হন। রাজা জয়সিয়ার সঙ্গে নৌযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। এভাবে মন্ডল ও বাহরোচ অধিকৃত হয়। ঠিক সে সময়েই সেনাদলের অন্য অংশ হাবিব ইবনে মুররার নেতৃত্বে উজ্জয়িনী জয় করে। অবশ্য বাহরোচ ও থাট্টাতে এর আগেও ছোট পরিসরে অভিযান প্রেরিত হয়েছিল খলিফা উসমানের আমলে। উমাইয়া আমলে নৌবহরকে ঢেলে সাজালেন হাজ্জাজ। বড় ধরনের সংস্কার আসে জাহাজের কাঠামোতেও। এতদিন নদীতে চলাচলকারী জাহাজের কাঠ রশি দিয়ে বাঁধা থাকত। ভূমধ্যসাগরে চলাচলকারী জাহাজের কাঠ থাকত লোহার বা কাঠের পেরেকে সংযুক্ত। দ্বিতীয় প্রকারে জাহাজ তৈরির রীতিই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যেন পানি উঠতে না পারে, তার জন্য আলকাতরার ব্যবহার শুরু করেন। সরু গলুইয়ের নৌকার পাশাপাশি প্রাধান্য পায় সমান্তরাল নৌকা। আক্রার জাহাজ নির্মাণ কারখানাটি আবদুল মালিক পর্যন্তই চালু ছিল। খলিফা হিশাম কারখানাটি আক্রা থেকে সুরতে স্থানান্তরিত করেন। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের সময় পর্যন্ত সুর ছিল খেলাফতের প্রধান জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্রগুলোর একটি। মুয়াবিয়া নিজে কেবল নৌ-অভিযানের অগ্রপথিক ছিলেন না, সূচনা করেছিলেন জাহাজ নির্মাণের। ক্ষমতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বতন্ত্র নৌবিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। রণবহর, নৌসেনা, নৌযুদ্ধের প্রয়োজনীয় উপকরণের সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা ছিল এ বিভাগের অধীনে। মুয়াবিয়া মৃত্যুর আগে সতেরোশ সশস্ত্র রণতরী রেখে যান।
তার পদক্ষেপ বিস্তৃত করেই পরবর্তী বংশধরে নৌবহরের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়। অধিকৃত হতে থাকে নতুন নতুন এলাকা। ইয়াজিদের সময় মুসলিম অভিযান পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই নৌবাহিনীর বিস্তৃতি জরুরি হয়ে পড়ে। মিসর থেকে মরক্কো পর্যন্ত চালু হয় নৌ-তৎপরতা। এ সময়ের দুজন নৌ-কমান্ডার আবদুল্লাহ ইবনে কায়স হারিসি ও জানাদা ইবনে আবি উমাইয়া। হিশামের সময় বহর ইবনে হিজাব পুরনো জাহাজ কারখানাগুলো পুনর্র্নিমাণে হাত দেন। রোমানরা সাকালিয়ার অধিকারে রেখেছিল। হিশামের সময়েই ১২২ হিজরিতে হাবিব সাকালিয়া আক্রমণ করেন। সেখানকার বিখ্যাত নৌবন্দর সারকাওসা বিজিত হয়। যদিও হাবিবের ইচ্ছা ছিল পুরো দ্বীপাঞ্চলটি অধিকার করার। কিন্তু আফ্রিকায় বারবার বিদ্রোহ দমনের জন্য তাকে দ্রুত সেদিকে মনোনিবেশ করতে হয়। হিশামের পরে ক্ষমতায় এসে ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক আরেক ধাপ এগিয়ে যান। ভূমধ্যসাগরে আফ্রিকান উপকূল রক্ষা তার উদ্দেশ্য ছিল। তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেলারিক দ্বীপগুলো দখল নেয়া। কারণ সেখান থেকেই রোমানরা আঘাত করে চলছিল একের পর এক। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার চিন্তা মাথায় নিয়েই সংস্কার আনেন তিনি। উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে অভিযান পরিচালনাকারী উমাইয়া জেনারেল মুসা বিন নুসায়ের কার্তাজেনায় কাজ শুরু করেন অস্ত্রাগার (আর্সেনাল) স্থাপনের। ইংরেজি আর্সেনাল শব্দটি মূলত আরবি দার-আল সিনা থেকে উদ্ভূত। মুসা পরবর্তী সময়ে মেয়রকা ও মিনোর্কা দ্বীপ দুটি অধিকার করেন। অভিযান পরিচালনা করেন সার্দিনিয়া, সিসিলি ও তাঞ্জিয়ারেও। মুসা ও তারিক বিন জিয়াদের মাধ্যমে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ অধিকৃত হলে নৌ-কর্মকা- সেদিকেও বিস্তৃত হয়। স্থাপিত হয় বাণিজ্যিক বন্দর। পরবর্তী সময়ে উমাইয়া খেলাফত স্পেনে প্রতিষ্ঠিত হলে নৌবাহিনীই হয় তাদের অন্যতম প্রধান শক্তি। দুর্র্ধষ ভাইকিংদের সঙ্গে সংঘর্ষের সূত্র ধরে সেভিয়াতে অস্ত্রাগার স্থাপন করেছিলেন স্পেনের উমাইয়া শাসক আবদুর রহমান।
উমাইয়া যুগের নৌ-কর্মকা-ের বড় একটা অধ্যায় জুড়ে রয়েছে কনস্টান্টিনোপল জয়ের আকাঙ্ক্ষা। বাইজেন্টাইন সাম্রাজের রাজধানীকে সবসময় সুরক্ষিত মনে করা হতো। বিপরীতে রাসুলের ভবিষ্যদ্বাণী জড়িত থাকায় কনস্টান্টিনোপল অভিযান সবসময়ই মুসলিম শাসকদের কাছে মর্যাদাপূর্ণ বিবেচিত হয়েছে। বাইজেন্টাইনের সঙ্গে সংঘর্ষ হলেও মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন রাজধানী কনস্টান্টিনোপল অবরোধ ছিল। উত্তর আফ্রিকায় চলমান সংঘাতের সূত্র ধরে ওয়ালিদের সময়ে প্রস্তুতি নেয়া হয় বাইজেন্টাইনের রাজধানী অবরোধের, তাতে পূর্ণ রূপ দেন খলিফা সোলাইমান। সোলাইমান নিজেকে নবির ভবিষ্যদ্বাণীতে উদ্ধৃত কনস্টান্টিনোপল জয়কারী খলিফা মনে করতেন। কনস্টান্টিনোপলের রাজনীতিও স্থির ছিল না। ৭১১ থেকে ৭১৭ সালের মধ্যে তিনজন সম্রাট উৎখাত হন অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। উমাইয়া বাহিনী এগিয়ে যায় আনাতোলিয়ার দিকে। আরবদের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে না পেরে সম্রাট দ্বিতীয় আনাস্তাসিয়াস রাজধানী সুরক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ৭১৭ সালে আরব বাহিনী ১ লাখ ২০ হাজার সৈন্য ও ১৮০০ রণতরী নিয়ে অবরোধ করে বসে রাজধানী। অবরোধে নেতৃত্ব দেন মাসলামা। তার আগে অবশ্য সার্দিস ও পারগামুম অধিকারে এসেছে মুসলিম বাহিনীর। পরবর্তী নির্দেশনা পাওয়ার আগে পর্যন্ত খলিফা সুলাইমান মাসলামাকে কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করে সেখানেই অবস্থান করতে বলেছিলেন। এ সময়টাতে আরব বাহিনীকে একই সঙ্গে দুই প্রতিপক্ষের মুখে থাকতে হয়েছে। এক পাশে বাইজেন্টাইন ও অন্য পাশে বুলগেরীয় সৈন্য। হঠাৎ মুসলিম শিবিরে দেখা দেয় মহামারী। বিপরীত পক্ষ থেকে আক্রমণ ও ঝড়ের কবলেও পড়তে হয়েছিল। মুসলিম বাহিনীর সাহায্যে পুনরায় ৬০০ রণতরী পাঠানো হয়। ক্যালসেডনে অবতরণ করে রণতরীগুলো। তাদের অধিকাংশই ছিল মিসরীয়। বিপুল পরিমাণ সৈন্য ও শক্তি ক্ষয়ের পরও চলছিল অবরোধ। খলিফা দ্বিতীয় উমর বাস্তবতা উপলব্ধি করে অবরোধ প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। তবে মুসলিম ঐতিহাসিকদের থেকে দুটি ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়, কনস্টান্টিনোপলের প্যাট্রিশািন লিও আগের চুক্তি ভঙ্গ করে ও মুসলিম সেনাপতি মাসলামার সঙ্গে প্রতারণা করে। দ্বিতীয়ত, মাসলামা ফিরে আসার আগে কনস্টান্টিনোপলের ভেতরে প্রবেশ করেন। সে সময় সেখানে স্থাপিত হয় প্রথম মসজিদ। উমাইয়া শাসনকে মনে করা হয় মুসলিম আধিপত্যের বিস্তারের যুগ। তার প্রমাণ দেখা যায় নৌবাহিনীর উত্থানে। সে সময় প্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক, যোগাযোগ ও অভিযান পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে আল-উবুল্লা, বাহরাইন, বসরা, দিব্বা, দেবল, জুলফার, মাকরান, রিশার ও সোহারের মতো বন্দর। একইভাবে পশ্চিম দিকে আধিপত্য বিস্তারের নিমিত্তে সরব ছিল আক্রা, আইলা, আসকালান, বৈরুত, সাইপ্রাস, জাফা, সুর ও তিউনিসের মতো বন্দরগুলো। গড়ে উঠেছে জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র, পরিচালনা দপ্তর এবং নৌযুদ্ধের প্রয়োজনে সামরিক দুর্গ। প্রায় শূন্য থেকে গড়ে ওঠা নৌবাহিনী ক্রমেই ভূমধ্যসাগরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। স্থলে প্রতাপশালী আরবরা জলেও পরিণত হয়েছে পরাশক্তিতে। রাজধানী সিরিয়া থেকে উমাইয়া শাসনের সমাপ্তি ঘটে ৭৫০ সালে। কিন্তু নৌবাহিনীতে তাদের যে অবদান তার ফলাফল আস্বাদন করেছে পরবর্তী মুসলিম পরাশক্তিগুলো। ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরে আব্বাসীয় শাসন, আফ্রিকায় আগলাবি শাসন, আন্দালুসিয়ায় উমাইয়া শাসন এবং তুরস্কে উসমানি শাসনে বিস্তৃত করেছে সেই ঐতিহ্য। আহমেদ দীন রুমি: লেখক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com