২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) তাদের ক্ষমতার এক বছর পূর্ণ করলো। যেহেতু পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন থেকে ১২ মাসেরও কম সময় দূরে বাংলাদেশ, তাই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে ইসি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তার একটু মূল্যায়ন হওয়া দরকার। জাতীয় নির্বাচনটি হতে হবে সকল রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন বিতর্কে জর্জরিত ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিরোধীরা। বেশির ভাগ উদার গণতন্ত্র আবার নতুন নির্বাচন দাবি করতে থাকে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুক্তি হলো, সাংবিধানিক সংকট এড়াতে এই নির্বাচন জরুরি ছিল। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর দুই শক্তিধর মিত্র চীন ও ভারত এই নির্বাচন নিয়ে আপত্তি জানায়নি। ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন বর্জন না করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিরোধী দল। কিন্তু নির্বাচন ছিল ব্যাপক মাত্রায় জালিয়াতির অভিযোগে পূর্ণ। ওই নির্বাচনে মোট যে পরিমাণ ভোট পড়েছে তার মধ্যে কমপক্ষে শতকরা ৯৬ ভাগ ভোট পায় আওয়ামী লীগ। বহুবিধ অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্য এবং পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ব্যালটবাক্স ভরার অভিযোগ আছে। ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। এসব ছিল ভয়াবহ আকারে। নির্বাচন হয়েছে এমন ৫০ টি আসনের মধ্যে ৪৭টিতেই ভয়াবহ অনিয়ম দেখতে পায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল।
তবে আগের নির্বাচনগুলো থেকে আসন্ন নির্বাচন আরও অনেক জটিল পরিস্থিতিতে হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রভাবশালী উন্নয়ন অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভিজাত বাহিনী র্যাব, এর ৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশের এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেদিন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেই একই দিন উত্তর কোরিয়া এবং চীনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তারপর গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক সময়ে বড় বড় উদার গণতন্ত্রের দেশ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন অংশীদাররা প্রকাশ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার প্রয়োজনীয়তার কথা প্রকাশ্যে বার বার বলছে। এ বছরের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাউন্সেলর ডেরেক চোলেট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ডেরেক পরে আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যদি আরও অবক্ষয় হয়, তাহলে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা সীমাবদ্ধ হতে পারে।
অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দেশজুড়ে ধারাবাহিক প্রতিবাদ বিক্ষোভ আয়োজন করে যাচ্ছে বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। তবে আওয়ামী লীগ পরিষ্কার করে বলেছে, তাদের এই দাবি মেনে নেয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই। তাদের যুক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলের জন্য জায়গা করে দেয়। তারা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলে। ওই সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধাক সরকার বাংলাদেশে ২০০৬ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যাচ্ছে, যা দৃশ্যত মসৃণ কাজ নয়। এক্ষেত্রে তারা বড় তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
প্রথমত: সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে নিজেকে নিরপেক্ষ হতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। প্রধানমন্ত্রী বার বার প্রকাশ্যে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। তবে কাজে৭ তা প্রমাণ দেখাতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের ৬টি আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে ভোটকেন্দ্রগুলো দখলে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের ভয় দেখাতে। রহস্যজনক কারণে নির্বাচনের আগে বিরোধী দলীয় একজন প্রার্থী নিখোঁজ জন। নির্বাচনের পরে তাকে পাওয়া গেছে। এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষ সাংগঠনিক ক্ষমতা বা স্বাধীনতা প্রদর্শন করতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত: দৃশ্যত নির্বাচন কমিশন তার পদ্ধতিগত বাধ্যবাধকতার নৈতিক দিকটির পরিবর্তে কার্যক্রম পরিচালনায় অনড় বলে মনে হচ্ছে। বর্তমানে তারা একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। কিন্তু আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং সবার অংশগ্রহণমূলক করার বিষয়ে অতোটা করছে না। অনেকবার নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে খুব আগ্রহী নয়, যেহেতু বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। নির্বাচন কমিশনের এমন মনোভাব তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে না।
চূড়ান্ত দফায়, নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ভোটারের আস্থা ফেরানো। বাংলাদেশে নির্বাচন হলো একটি উৎসবের ইভেন্ট। এতে ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। প্রচারণায় উৎসবের আমেজ দেখা দেয় দেশজুড়ে। ভোট প্রক্রিয়া যখন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় তখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোটার ভোট দিতে যান। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ভোটাররা ব্যাপক জালিয়াতি এবং নির্বাচনের ফল ফিক্সিংয়ের করণে ভোট দেয়ায় দৃশ্যত তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ফল হিসেবে সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুব কম। একটি কেন্দ্রে শতকরা মাত্র ১৬ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক কম হতে পারে। একই দৃশ্যপট তৈরি হয় ২০২০ সালের মেয়র নির্বাচনে। বাংলাদেশের দুটি বৃহৎ শহর ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এই ভোট হয়। সেখানে শতকরা ৩০ ভাগেরও কম ভোটার ভোট দিয়েছেন। ভোটারদের এই উদাসীনতা শুধু নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই হুমকির মুখে ফেলবে এমন নয়। একই সঙ্গে ভোটের এই চিত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে আসবে। তারা আগামী নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে দাবি করার ক্ষেত্রে বৈধতার প্রশ্ন আসবে। নির্বাচন কমিশনের উচিত ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে অধিক পরিমাণে প্রচারণা চালানো। বিএনপি ও অন্য বিরোধী দলগুলোকে আগামী নির্বাচনে ফিরিয়ে আনা উচিত হবে। নির্বাচন নিয়ে সংকট এড়াতে এসব অত্যাবশ্যক।
(লেখক নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অলোর ডিপার্টমেন্ট অব কালচার স্টাডিজ অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং বর্তমানে পোস্ট ডক্টরাল গবেষক। ২০২১ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটিতে গ্রিফিথ বিজনেস স্কুলে থেকে আন্তর্জাতিক অ্যালামনাস এওয়ার্ড পান। তার এ লেখাটি অনলাইন দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)