শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৮ পূর্বাহ্ন

শিল্প খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে

মুঈদ রহমান
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০২৩

কোনো দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নির্ভর করবে সেদেশের জাতীয় রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। যদি রাজনীতিতে জনগণের কল্যাণ-ভাবনা নিহিত থাকে, তবে সেদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ ভোগ করার সুযোগ পাবে। আর যদি রাজনীতি হয় কায়েমি গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, তাহলে উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে একটি ক্ষুদ্র শ্রেণি। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক কর্মকা- বা কর্মসূচি কতটা জনবান্ধব সে প্রশ্ন তো থেকেই যায়। তারপরও বলছি, শুধু যদি কায়েমি স্বার্থেও রাজনীতি পরিচালিত হয়, তাতেও অর্থনীতির দিকে নজর দিতে হবে। কেননা, উৎপাদন ব্যবস্থা সচল থাকলেই কেবল শোষণ করার সুযোগ থাকে, উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত করে মুনাফা করা যায় না। সুতরাং, বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি যদি জনবান্ধব না হয়ে গোষ্ঠীবান্ধবও হয়, তারপরও দেশের শিল্প খাতের দিকে নজর বাড়াতে হবে। কোনো শাসকগোষ্ঠী যদি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তে বৈষম্যমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠাতেও নিষ্ঠাবান হয়, সেটিও শিল্পায়নের মাধ্যমেই করতে হবে। অর্থনীতির বাইরে এখন রাজনীতিই বেশি দৃশ্যমান। যতই জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলের মধ্যে বিরোধ ততই বাড়ছে। এর মধ্যে অসহায় হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। দ্রব্যমূল্যের চাপে তাদের জীবন যায় যায়; বেকারত্বের অভিশাপে যুবকদের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশা। কিন্তু সরকার ও বিরোধীদের বক্তব্য-বিবৃতিতে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কোনো উপস্থিতি আমরা লক্ষ করছি না। গণতন্ত্রের নামে বুর্জোয়াদের মধ্যে কেবলই ক্ষমতার লড়াই চলছে। জনদুর্ভোগের কারণে সরকারের প্রতি মানুষের অসন্তুষ্টি বাড়ছে বটে, তবে বিরোধী দলকেও সেভাবে আস্থায় নিতে পারছে না। অন্যদিকে বুর্জোয়াদের বাইরে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির বিকাশও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। তাই সহজেই বলা যায়, দুর্ভোগ থেকে জনগণের আশু মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। এ কথা মেনে নিয়েই বলছি, বুর্জোয়াদের এ আস্ফালনকে, এ উচ্ছ্বাসকে টিকিয়ে রাখতে হলে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে। এটি তাদের স্বার্থেই করতে হবে। কিন্তু সেদিকেও খুব একটা নজর আছে বলে মনে হয় না। গত ৫ মার্চ যুগান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর শিরোনামটি ছিল, ‘অনিশ্চিত গন্তব্যে শিল্প খাত’। নির্বাচনি হাওয়ায় বিষয়টি কতটা গুরুত্ব পাবে তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে নীতিনির্ধারকদের সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করছি। আমাদের অর্থনৈতিক সংকট কেবল করোনা বা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে নয়; বরং ২০২০ সালের আগে থেকেই অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নানা সমস্যা বিরাজ করছিল। দেশে সর্বপ্রথম করোনা শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। তারপর থেকে এর প্রকোপ শুরু হয়। এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা এখনো চলমান। এ তিন বছরে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। অতিমারি ও যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পাশাপাশি বৃদ্ধি পায় শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের দাম। স্বাভাবিকভাবেই এ অপ্রত্যাশিত দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যায়। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণভাবে স্থানীয় মুদ্রায় ডলারের দাম বেড়ে যায়। স্থানীয় মুদ্রা হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন দাঁড়ায় প্রায় ২৬ শতাংশে। একদিকে আমদানি ব্যয়বৃদ্ধি, বিপরীতভাবে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমতে থাকায় ডলার সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। দেশের ডলার সংকটের প্রায় পুরো প্রভাব পড়ছে শিল্প খাতে, এমনকি তা এ খাতের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের দেশে ডলার সংকটের শুরুটা মূলত ২০২১ সালের আগস্ট থেকে। এরপর সংকট আরও ঘনীভূত হতে হতে ২০২২ সালের মে মাসে তা প্রকট আকার ধারণ করে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে আমদানিতে কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ আরোপের বাইরে কিছু করার ছিল না। এ পণ্য আমদানিতে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ শুরু হয় ২০২২ সালের জুলাই থেকে। সেপ্টেম্বরে এসে ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকও জরুরি কিছু পণ্য বাদে সব ধরনের পণ্য আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান বন্ধ করে দেয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আমদানির এলসি খোলা কমেছে ২৫ শতাংশ। আমদানি বেড়েছে ৩ শতাংশ। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়ার প্রভাব আগামীতে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং এর ফলে রপ্তানি আয় আরও কমে যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য গত জানুয়ারি মাসে ১০২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়। পরবর্তী সময়ে ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ৯০ কোটি ডলারে। ধারণা করা হচ্ছে, মার্চে এ এলসির পরিমাণ আরও কমে গিয়ে ৭১ কোটি ডলার হতে পারে। আগে রপ্তানির অর্থে কাঁচামাল আমদানি করেও বাড়তি কিছু থাকত। এখন বাড়তি কিছু তো থাকছেই না, অধিকন্তু রপ্তানিকারকদের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিতে হচ্ছে। ফলে রপ্তানির টাকা দিয়ে আমদানির ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে একমাত্র নির্ভরতা রেমিট্যান্স। এই রেমিট্যান্স প্রবাহের গতিও সন্তোষজনক নয়, কারণ এ খাতেও চলছে মন্দা। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছিল ১৫ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর রেমিট্যান্স কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা হলো ১৫ শতাংশ কমার পর ৪ শতাংশ বৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, রপ্তানি ছাড়াও শিল্পের অন্যান্য খাতেও কাঁচামালের সংকট চলছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি করে পূর্ণাঙ্গ পণ্য তৈরি করে। এসব মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ৩৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, আমদানি কমেছে ১৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে রড ও ইস্পাতের মতো ভারী শিল্পও রয়েছে। এ ভারী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির পরিমাণ কমেছে ৭০ শতাংশ, এলসি খোলা কমেছে ৬০ শতাংশ। ফলে এসব শিল্প এখন কাঁচামাল সংকটে ভুগছে। ওষুধ শিল্পও সংকট থেকে মুক্ত নয়। এ খাতে আমদানি কমেছে ১২ শতাংশ আর এলসি কমেছে ২২ শতাংশ। আর্থিক সংকট আঘাত হেনেছে উৎপাদনের ওপর। উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে শিল্পের উৎপাদনে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে শিল্পোৎপাদনের সূচক বেড়েছিল ৫০৬ পয়েন্ট। চলতি অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে উৎপাদন সূচক বেড়েছে ৪৯৬ পয়েন্ট। উল্লিখিত সময়ে শিল্পের প্রধান ১১টি খাতের মধ্যে ৬টিতে উৎপাদন কমেছে। এর মধ্যে পোশাক খাতে কমেছে ২ দশমিক ২১ শতাংশ, বস্ত্র খাতে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, খাদ্যে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ, অধাতু খনিজ পণ্যে ২ দশমিক ০৮ শতাংশ, রাসায়নিক পণ্যে ৫০ এবং মেটাল পণ্যে কমেছে ১৬ শতাংশ। তাছাড়া ছোট শিল্পে গত অর্থবছরের এপ্রিল-জুনের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে উৎপাদন কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। একদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। গত বছরের জুন থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম তিন দফায় ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। দুদফায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ১০০ থেকে ৩০০ শতাংশ। আর এক দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ। যেহেতেু এসব পণ্য শিল্পোৎপাদনের অপরিহার্য উপকরণ, তাই উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। আর এর প্রভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এ বেড়ে যাওয়ার পরিমাণটা উল্লেখযোগ্য। শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যভেদে দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ। একদিকে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ঘটেছে, অন্যদিকে কমে গেছে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, ভোক্তার ব্যয় বেড়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবিএস বলছে, ভোক্তার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। একই সূত্র বলছে, এর বিপরীতে ভোক্তার আয় বেড়েছে ৭ শতাংশ। এ হিসাবকে মেনে নিলেও বলতে হয়, আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে, যা সামগ্রিক চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে খাদ্য, শিল্প ও বিলাসী পণ্যে। এর ফলে উদ্যোক্তারা উৎপাদিত পণ্য কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বিক্রি করতে পারছেন না। সুতরাং, রাজনীতির মাঠ যতই সরগরম হোক, অর্থনীতির উষ্ণতা কমতির দিকে। মুখের বুলি দিয়ে রাজনীতির কাজ করা যায়; কিন্তু অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে কার্যকর কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হয়। আমার মনে হয় না ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের সেদিকে বিশেষ নজর আছে। আমরা ডলার সংকটের অজুহাতে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কঠোর করেছি; তিন বছরে মাত্র সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণপ্রাপ্তির মিনতিতে আইএমএফকে তুষ্ট করতে দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছি। অথচ গড়ে প্রতিবছর যে ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে, তার কোনো সুরাহা করতে পারছি না। এ কারণে চলমান রাজনীতির ওপর মানুষের তেমন আস্থা নেই বলেই মনে হয়। তবে একথা ঠিক, মন্দার দীর্ঘসূত্রতার কারণে দেশের শিল্প খাতে যদি কোনো বিপর্যয় নেমে আসে, তাহলে ক্ষমতাসীনরাও স্বস্তিতে থাকতে পারবেন না, অন্যদিকে কেউ ক্ষমতায় গিয়েও টিকতে পারবেন না। তাই সবাইকে শিল্পের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার প্রয়াস নিতে হবে। লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com