আমেরিকার ফ্রিডম হাউজ বৈশ্বিক নাগরিক স্বাধীনতা তিনটি শ্রেণীতে প্রকাশ করে। ‘মোটেও স্বাধীন নয়’, ‘আংশিক স্বাধীন’ ও ‘স্বাধীন’। এতে বাংলাদেশ অবস্থান করছে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ‘আংশিক স্বাধীন’। এ বছর প্রকাশিত তালিকায় প্রাপ্ত স্কোর গতবারের চেয়ে এক বেড়ে ৪০ হয়েছে। ‘স্বাধীনতা’ সামান্য কিছুটা বাড়ার অর্থ বা বাস্তবতা কী? আমরা দেখেছি এক সময় বিরোধীরা কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারত না। পারলেও সেটি পুলিশের কঠোর নিয়ম কানুন মেনে করতে হতো। এ ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় গত বছর দেখা গেছে। বিরোধীরা পুলিশের অনুমতি নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে মিছিল সমাবেশ করেছে। বর্তমান সরকারের সময় বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম হওয়ার যে অবাধ সংস্কৃতি চালু হয়। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার পর বাহিনীটির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অনেকটা কমেছে। স্কোরের সামান্য উন্নতি এ কারণে হলেও মানুষের সামগ্রিক স্বাধীনতায় কোনো উন্নতি হয়নি।
ফ্রিডম হাউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধী দল ও এর সাথে যুক্ত বলে যাদের ধারণা করা হয় তাদের, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজকে অব্যাহত হয়রানির মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা সুসংহত করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। একজন সাধারণ পর্যবেক্ষক যদি সাদা চোখে বাংলাদেশের নাগরিক স্বাধীনতার চিত্র দেখেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই মন্তব্য করবেন, আগের তুলনায় নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত ছাত্রী ফুলপরীকে নির্যাতনের চিত্রটি এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। সমাজ রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে এ ধরনের নানা ঘটনা ঘটছে। এতে ভুক্তভোগী সাধারণ নাগরিক। যারা ক্ষমতাসীন দল করেন না বা তাদের সমর্থনপুষ্ট নন। বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অধিকার একেবারে সামান্য। সাধারণ নাগরিকরা অধিকার হারাতে হারাতে কোণঠাসা অবস্থায় পৌঁছেছে। ফুলপরীকে সৌভাগ্যবান বলতে হবে, তিনি আপাতত আইনের আশ্রয় পেয়েছেন। দেশে নাগরিকদের জীবনে বহু ঘটনা ঘটেছে রাষ্ট্রের কোনো অবস্থান থেকে তারা কোনো সুরক্ষা পাননি। একজন যদি নিজের জীবনের নিরাপত্তা পায় ও স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারে তাহলে ব্যক্তি মানুষটিকে গণতন্ত্রের সুফলভোগী বলা যায়। অন্যদিকে সে যদি শঙ্কা বোধ করে এবং উদ্বেগের কথাও অবাধে প্রকাশ করতে না পারে তাহলে সেই সমাজকে কোনোভাবে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। কোন দেশে মানুষ যদি বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো ঘটনার শিকার হয় তাহলে দেশটির মানুষের স্বাধীনতা নাজুক অবস্থায় চলে যায়। একটি দেশে গণতন্ত্র কতটা কার্যকর রয়েছে তা বিচার করা হয় এসব নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের নিরিখে। আমেরিকার ফ্রিডম হাউজ প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের এ অধিকার চর্চা নিয়ে সূচক তৈরি করে। গত দশ বছর ধরে স্বাধীনতার অবনতি হচ্ছে বিশ্বের দশটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনায় দুর্বলতা আছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তারা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম বন্ধ করে নাগরিক স্বাধীনতার উন্নতি করা যায় না। বাংলাদেশের বর্তমান ব্যবস্থা তার উদাহরণ। এখানে নাগরিক জীবনের সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ‘বিচার’। মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা যথাযথ না হওয়ায় সমাজের বৃহত্তর অংশ বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। ক্রমাগত এ বঞ্চনা বেড়ে চলেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এখানে দুর্নীতি অবাধে ঘটছে এবং বিরাজনীতিকরণের মধ্যে দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী প্রয়াস দুর্বল করা হয়েছে। দুর্নীতিবাজরা সমাজে এখন বুক চিতিয়ে বিচরণ করে। অন্যদিকে দুর্নীতিবিরোধী কমিশন ব্যবহৃত হয় রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে। এ কমিশনের ভিতরেও রয়েছে দুর্নীতি। আবার কেউ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চাইলে সংস্থাটি নিজেই তাকে থামিয়ে দেয়, কখনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে এমন অভিযোগও আছে। ফ্রিডম হাউজের সূচকের চেয়েও জনগণের উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের ভালো ভবিষ্যতের জন্য নাগরিকের হারানো অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আমরা মনে করি, উল্লেখিত বিষয়গুলো হাল্কা ভাবে নেয়া ঠিক হবে না। সরকারের দায়িত্ব তদন্ত করে সমস্যা সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আশা করি, সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করবে এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে কসুর করবে না। এতে সরকারের ভাব মর্যাদা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল হবে এবং সাথে সাথে দেশের মানুষের মনেও স্বস্তি ফিরে আসবে।