বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৪৫ অপরাহ্ন

স্মরণ: অধ্যাপক আবুল কাশেম

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০২৩

শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলার মানুষের সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সূচনাকারী। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা: বাংলা না উর্দু’ শিরোনামের ঘোষনাপত্রে সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্টভাষা করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।
অধ্যাপক আবুল কাশেম বুঝতে পেরেছিলেন রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলার মানুষের সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আন্দোলনের শুরুতে অধ্যাপক আবুল কাশেমের ১৯ নম্বর আজিমপুরের বাসভবনই ছিল তমদ্দুন মজলিসের অফিস।
এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ তাঁর ‘জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫-৭৫ বইয়ে লিখেছেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপকদ্বয় আবুল কাশেম ও নুরুল হক ভূঁইয়া ধূমায়িত অসন্তোষকে সাংগঠনিক রুপদানের প্রচেষ্টায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস গঠন করেন। নবগঠিত তমদ্দুন মজলিসই ভাষা-আন্দোলনের গোড়াপত্তন করে।”
১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা- না উর্দু- শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তমদ্দুন মজলিস। ওইদিন বিকালেই অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রাবাস নূপুর ভিলায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও উর্দু করা হোক’ শীর্ষক এক ঘরোয়া সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করাই ছিল সেমিনারের মূল লক্ষ্য। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে সেমিনারে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, কবি জসীম উদ্দীন, অধ্যাপক কাজী আকরাম হোসেন, অধ্যাপক শামসুল হক, শাহেদ আলী। (সূত্র: আমি যখন সাংবাদিক ছিলাম; সানাউল্লাহ নূরী।)
অধ্যাপক আবুল কাশেম ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শুরু করলেও জন্মভূমি চট্টগ্রামেও তিনি সেই আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। তাঁর সম্পাদিত পুস্তিকা ঢাকার মত চট্টগ্রামেও বেশ প্রভাব ফেলে। অধ্যাপক আবুল কাশেমের হাত ধরেই আন্দোলনে যুক্ত হন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আরেক পথিকৃৎ মাহবুবুল আলম চৌধুরী। সেই স্মৃতি স্মরণ করে মাহবুবুল আলম চৌধুরী লিখেছেন, “চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান অধ্যক্ষ আবুল কাশেম ছিলেন আমার ছোট মামা এলএ চৌধুরীর বন্ধু। এই সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমার ছেলেবেলা থেকেই পরিচয়। ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি আমাকে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য একটি চিঠি দেন। এই চিঠির ভিত্তিতে চট্টগ্রামের তমদ্দুন মজলিসের ফরমানউল্লা খান, মাহফুজুল হক এবং তারেক ইসলামকে নিয়ে আমরা কলেজ হোস্টেলের একটি কামরায় মিলিত হই।”(বই : জাতীয় মুখশ্রী- মাহবুবুল আলম চৌধুরী) ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত প্রথম প্রতিবাদ সভায় অধ্যাপক আবুল কাশেম সভাপতিত্ব করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট সংঘটনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এই ধর্মঘটের ফলে তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ অ্যাকশন কমিটি তাঁদের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়।
১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জনমত গঠন এবং মজলিসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারের উদ্যোগ নেন অধ্যাপক আবুল কাশেম।
তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ও ঢাকার বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচারণা চালানো হয়। এসময় রাজধানীর বাইরে মজলিসের শাখা গঠন শুরু হয়। অক্টোবরে গণসংযোগের পাশাপাশি আইন-পরিষদ ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন মজলিসের নেতারা। প্রচারণায় ঘোষনাপত্র পুস্তিকা ছাড়াও লিফলেট বিতরণ করা হয়। পরবর্তীতে আবুল কাশেমসহ তমদ্দুন মজলিশের নেতারা উপলব্ধি করেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে যে রাষ্ট্রীয় আদর্শের কথা বলা হয়েছিল, পাকিস্তান তখন আর সে আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে না। ১৯৫২ সালে আবুল কাশেম খিলাফতে রব্বানী পার্টি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রামের পটিয়া-বোয়ালখালী নির্বাচনী এলাকা থেকে পূর্ববাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি আইন পরিষদে শিক্ষার সকল স্তরে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করার প্রস্তাব পেশ করেন।
আবুল কাশেম ছিলেন বাংলা সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সম্পাদনায় পত্রিকাটি ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। তমদ্দুন মজলিশের মুখপত্র হিসেবে এই পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের আদর্শ ও লক্ষ্য প্রচারে সক্রিয় ছিল। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি চালু থাকে।
১৯২০ সালের ২৮ জুন মা সালেহা খাতুনের কোলজুড়ে আসেন আবুল কাসেম। চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন পটিয়া উপজেলার বরমা ইউনিয়নের সেবন্দি গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। পিতা মতিউর রহমান ছিলেন গ্রামের সালিশী বিচারক।
১৯৩০ সালে বরমা ত্রাহি-মেনকা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন মেধাবী আবুল কাশেম। পঞ্চম শ্রেণীতে হাজী মোহাম্মদ মহসিন বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে বরমা ত্রাহি-মেনকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪১ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি-তে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে বিএসসি অনার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৪৪ সালে আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিদ্যায় অনার্স ও পরের বছর ১৯৪৫ সালে এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার পদে যোগ দেন। প্রভাষক হিসেবে তিনিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ক্লাস নেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে অধ্যাপক আবুল কাশেম বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ উনিশ বছর এ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অধিকাংশ সময়ই তিনি কলেজ থেকে কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি। এ সময়েই তিনি প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম নামে পরিচিতি পান। অধ্যাপক আবুল কাশেম বাংলায় ৪০টি বই রচনা করেছেন। জড়িত ছিলেন বাংলা একাডেমী, ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ প্রায় অর্ধশতাধিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এই মহান ব্যক্তি ১৯৯১ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
জাতির সেবায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অধ্যাপক আবুল কাশেম ১৯৮৭ সালে একুশে পদক, ১৯৮৯ সালে জাতীয় সম্বর্ধনা স্বর্ণপদক ও ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর) সহ অনেক জাতীয় ও সামাজিক পুরস্কার লাভ করেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com