আমাদের এ পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রাণীর একত্রে বসবাস। সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর এই একত্রে বসবাসকেই জীববৈচিত্র্য বলে। বিজ্ঞানের ভাষায় জীববৈচিত্র্য বলতে উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীবসহ পৃথিবীর গোটা জীব সম্ভারের অন্তর্গত বংশানু তথা জিন ও সেগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বাস্তুতন্ত্রকে বোঝায়। আবার জীববিজ্ঞানীদের মতে, জীববৈচিত্র্য হলো স্থলে-জলে সব স্থানে সব পরিবেশে অবস্থানরত সবধরনের জীব ও উদ্ভিদের বিচিত্রতা। এ পৃথিবীতে প্রতিটি জীবই পরিবেশের জন্য কোনো না কোনোভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটি প্রজাতিকে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে ভিন্ন প্রজাতির ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। জীববৈচিত্র্য প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা ও প্রাণিকুলের বিলুপ্তি ঠেকাতে সাহায্য করে। ইসলামে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ব্যাপারে জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। জীবজগৎ-বিষয়ক কুরআনের আয়াত ও হাদিস বিশ্লেষণে দেখা যায়- আল্লাহ তায়ালা পুরো সৃষ্টিজগৎকে ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। যেমন পবিত্র কুরআনে তিনি ইরশাদ করেন- ‘আমি পৃথিবীকে সমতল করে বিছিয়ে দিয়েছি তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং সব বস্তু সুপরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি। তাতে ব্যবস্থা করে দিয়েছি তোমাদের জীবিকার ও তাদের জীবিকারও, যাদের রিজিকদাতা তোমরা নও। এমন কোনো জিনিস নেই, আমার কাছে যার ভা-ার রক্ষিত নেই। আমি তা প্রয়োজনানুসারেই সরবরাহ করে থাকি। আর আমি বৃষ্টিস ারী বায়ু প্রেরণ করি এরপর আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তা তোমাদেরকে পান করতে দিই। অথচ তোমরা তো সেই ভা-ারের মালিক নও।’ (সূরা হিজর : ১৯-২২) মানুষ তার খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান ইত্যাদির জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। শুধু খাদ্য-বস্ত্র ও বাসস্থানই নয়; বরং বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি থেকে ওষুধ, ফুল, ফল, মাছ, গোশত, দুগ্ধ, চামড়া ও মধু পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে সূরা আবাসায় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘মানুষ তার খাবারের জিনিসগুলোর প্রতি লক্ষ করুক- আমি আশ্চর্য উপায়ে পানি বর্ষণ করেছি এরপর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙ্গুর, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর, বিপুল বৃক্ষরাজির নিবিড় বন, ফলফলাদি ও ঘাস। (এভাবে আমিই ব্যবস্থা করি) তোমাদের ও তোমাদের গবাদিপশুর জীবন ধারণের সামগ্রী। (আয়াত : ২৪-৩২) যেকোনো দেশের জীববৈচিত্র্য সে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ আমাদের বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭০ সালের পর থেকে প্রতি বছর গড়ে দেশে ৪ শতাংশ হারে উভয়চর প্রাণী হ্রাস পাচ্ছে। যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের প্রত্যক্ষ কতগুলো হুমকির মধ্যে অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, জনসংখ্যার চাপ, বায়ু ও পানিদূষণ, প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত সংগ্রহ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার, প্লাস্টিকজাতীয় পণ্যের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থার পরিবর্তন, ইলেকট্রনিকস বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা এবং মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ ইত্যাদি অন্যতম।
ইসলামে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবার্তা রয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মানুষকে অশান্তি সৃষ্টি না করার জন্য জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। যেমন- সূরা আরাফের ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘শান্তি স্থাপনের পর তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ এ ছাড়াও সূরা রুমে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উৎসাহিত করতে রাসূল সা: বলেন, ‘যদি নিশ্চিতরূপে জানো যে, কিয়ামত এসে গেছে তখন তোমার হাতে যদি একটি চারাও অবশিষ্ট থাকে তবে সেটিও রোপণ করবে। (মুসলিম) অযথা পশু-পাখি শিকার করাও ইসলামে নিন্দনীয়। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘কোনো প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানিও না।’ (মুসলিম) অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি অহেতুক কোনো চড়ুই পাখি মেরে ফেলল কিয়ামতের দিন পাখিটি আল্লাহর কাছে এই বলে নালিশ করবে যে, হে আল্লাহ! অমুক ব্যক্তি আমাকে অহেতুক হত্যা করেছে। (নাসায়ি) অতএব জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে শিক্ষাব্যবস্থা ও গবেষণার মাধ্যমে গণসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তাই জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষায় আমাদের সবাইকে জনসচেতনতা তৈরিতে একত্রে কাজ করতে হবে এবং ইসলামের নির্দেশনাবলি যথাযথ পালনে সচেষ্ট হতে হবে।