বাংলাদেশের ইসলামী ধারায় পরিচালিত ব্যাংকগুলো সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। তারল্য সংকট ও জালিয়াতির ঘটনা তার মধ্যে অন্যতম। এ কথা স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকসহ সার্বিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর পেছনে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন বৈশ্বিক সংকট, করোনা মহামারীসহ নানা জটিলতা এবং অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক ও সরকারি নীতিগুলোর ভূমিকা রয়েছে। যেহেতু ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা গতানুগতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, তাই এখানে ব্যাংকিং দক্ষতার পাশাপাশি নৈতিক প্রশিক্ষণ ও ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ আনুগত্যশীল ও বিশ্বাসীরা ছাড়া এর পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা খুবই দুরূহ। সেটি ব্যাংক পরিচালনা পরিষদ থেকে শুরু করে ব্যাংকের একজন প্রহরীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ এখানে পেশাসংশ্লিষ্ট বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি ব্যক্তির মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ লালন ও নিজের মধ্যে প্রয়োগের মাধ্যমে পরকালীন প্রতিদান প্রাপ্তির বিষয়টিও ব্যাংকিং সফলতার পেছনে অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। সেক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক খাতকে গতানুগতিক ব্যাংকের মতো করে পরিচালিত করলে এখানে দিন দিন আরো ঝুঁকি বাড়ার শঙ্কাই প্রবল। এক্ষেত্রে ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছ ও গতিশীল ব্যাংকগুলোকে যতটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রভাবমুক্ত রাখা যাবে ততই রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ যেকোনো প্রতিষ্ঠানকেই রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি তার নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম ও কাঠামোর আলোকে চলতে দেয়া দরকার, না হয় সেসব প্রতিষ্ঠান তাদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়ে এবং অপ্রয়োজনীয় কিংবা ব্যক্তিবিশেষকে নিয়মবহির্ভূত সুবিধা দিতে গিয়ে নানা অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়, যেটি যেকোনো শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই রাতারাতি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে যথেষ্ট। যেহেতু আমরা আগেই বলেছি যে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নেই। তার পরও বিভিন্ন সময় নানা সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায় যে দেশের সিংহভাগ ইসলামিক ব্যাংকগুলো একটি নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত হচ্ছে। যদি এ তথ্য সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যাংক পরিচালনা করলেও অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এটি পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য সম্ভাব্য যেকোনো ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি পরিচালনাগত কর্তৃত্ব ও প্রভাব বিস্তারের কারণে সেখানে নানা অনিয়ম তৈরির সমূহ সম্ভাবনাও থেকে যায়। তবে এটি সত্যিই পরিতাপের যে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মুসলিম এবং ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে মূলত মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস অনেকাংশেই প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে থাকে। অথচ এখন পর্যন্ত এখানে কোনো ইসলামী ব্যাংকিং আইন বা নীতিমালা তৈরি হয়নি। অথচ মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার আলাদা আইন ও নীতিমালা লক্ষ করা যায়। স্বাতন্ত্রিক নীতিমালা না থাকলে অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ, তারল্য সংকটের সম্ভাবনাসহ জনআমানতের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় স্বাতন্ত্রিক আইন ও নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের দৃষ্টি দেয়া দরকার। একসময় দেখা যেত ইসলামী ব্যাংকগুলো বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডকে তারল্য উদ্বৃত্ত নিয়ে মধুর সংকটে পড়তে হতো। তাদের এত বেশি তারল্য উদ্বৃত্ত ছিল যে শরিয়াভিত্তিক বিনিয়োগ খাত পাওয়া নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হতো। অথচ সমসাময়িক পরিস্থিতি একেবারেই বিপরীতমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য সুবিধা নিয়ে ইসলামী ব্যাংককে গ্রাহক চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে। যেটি পরোক্ষভাবে ইসলামী ব্যাংকের প্রতি সাধারণ গ্রাহকের আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করছে।
ইসলামী ব্যাংকগুলো নিয়ে এ পর্যন্ত যত একাডেমিক গবেষণা হয়েছে, তার বেশির ভাগই উদ্বৃত্ত তারল্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকগুলো এখন তারল্য সংকট মোকাবেলা করছে। একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য সংকট দেখা দেয়ার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে, যেমন রাজনৈতিক প্রভাব, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, জবাবদিহি না থাকা, এককভাবে কাউকে ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেয়া এবং সর্বোপরি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমস্যাও তারল্য সংকটের পেছনে দায়ী থাকতে পারে। উল্লিখিত বিষয়গুলো সংঘটিত হয়েছে কিনা সেটা সরকার বা ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা খুঁজে বের করবেন হয়তো। তবে আমরা যে বিষয়টি উল্লেখ করতে পারি তা হলো সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ইসলামী ব্যাংকের তারল্য ব্যবহার করা, বিশেষ করে সুকুক সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে তারল্য বিনিয়োগ। বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ গ্রহণ ও করণের ক্ষেত্রে সুকুকসহ বিভিন্ন ইসলামী আর্থিক খাতগুলো ভূমিকা পালন করলেও বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য এটি একেবারেই নতুন ক্ষেত্র। এখানে এখনো মৌলিক অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। তাই তড়িঘড়ি করে সুকুক বাস্তবায়ন না করে আরো সময় নিয়ে আইনি, বিশেষজ্ঞ লোকবল, বাজার যাচাই ও গ্রাহককেন্দ্রিক দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করার প্রয়োজন ছিল। তবে যেহেতু এরই মধ্যে সুকুক বাস্তবায়ন অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে এর সুফল যাতে সাধারণ মানুষও ভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থা করে দেয়া অর্থ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর অন্যতম দায়িত্ব। এককভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাতে এর পুরো নিয়ন্ত্রণ ও সুফল ভোগ করতে না পারে সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তারল্য সংকটের অন্যতম কারণ হচ্ছে খেলাপি ঋণ। ঋণ দেয়ার আগে ঋণগ্রহীতার যাবতীয় তথ্য বিস্তারিতভাবে যাচাই-বাছাই না করা ও আইনি কাঠামোকে গুরুত্ব না দিয়ে ঋণ দিলে সে ঋণ উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। যেটি এরই মধ্যে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমগুলোয় উঠে এসেছে। তাই তারল্য সংকটের ঝুঁকি পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকেই নিরাপত্তাহীন করে তোলে। কারণ তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকের মনে যদি তার আমানত ফেরত পাওয়া বা সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রতি আস্থার সংকট দেখা দেয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই গ্রাহক তার আমানত তুলে নেবে, যা ব্যাংককে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বা দেউলিয়াত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অন্তত ব্যাংক খাতের এ জাতীয় যেকোনো অনিয়মকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবে এ তারল্য সংকটসহ আরো অন্যান্য ব্যাংকিং অনিয়মের পেছনে দুর্বল শরিয়া বোর্ড, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের শরিয়া আইনের প্রতি অনীহাও অনেকাংশে কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে গভীর শরিয়া জ্ঞান রাখেন এমন গ্রহণযোগ্য প-িত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি পূর্ণ স্বাধীন শরিয়া বোর্ড থাকলে সেখানে অনিয়মের মাত্রা অনেকাংশেই কমে আসবে বলে আশা করা যায়। বর্তমানের বিভিন্ন ব্যাংকে যারা শরিয়া স্কলার হিসেবে কর্মরত আছেন, দেখা যায় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগই স্বীকৃত ব্যাংকিং শরিয়া স্কলার নন বা ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো অধ্যয়ন নেই। এ সবগুলোই ব্যাংক খাতের ভঙ্গুর কাঠামোর পেছনে দায়ী। এখন শুধু ইসলামী ব্যাংক আইন করলেই হবে না, বরং একটা দীর্ঘমেয়াদি কৌশল অবলম্বন করতে হবে। যদি আগেই আইন করা থাকত তাহলে কারা সঠিক এবং কারা যোগ্য তাদের যাচাই করা যেত। কারা ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হতে পারবে তা স্পট থাকত, কারা ইসলামী ব্যাংকের এমডি হতে পারবে তাও স্পষ্ট থাকত। হঠাৎ করে প্রথাগত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে একজন সফল ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যকর করা যাবে না। এখানে মানসিকতার বিষয়টাও জড়িত। যে ব্যক্তি পুরো পেশা জীবনে পুরোপুরি সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ছিলেন তার পক্ষে ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনা করা অত্যন্ত দুরূহ। এজন্য ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কিত ব্যবস্থাপক ও লোকবল তৈরি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ইসলামী ব্যাংকগুলো ধারাবাহিকভাবেই তাদের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল। ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য স্বাতন্ত্রিক ইসলামিক ব্যাংকিং আইনের অনুপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও সরকারের বিভিন্ন নিয়ম মেনেই পরিচালিত হচ্ছিল। তারা গাইডলাইনগুলো অনুসরণ করে চলত। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের আলোকে যতটুকু জানা যায়, ব্যক্তি বিশেষ মালিকানায় যাওয়ার পর থেকেই ইসলামী ব্যাংকগুলোয় অবিশ্বাস্য রকম পরিবর্তন আসতে শুরু করে, যেখানে আর্থিক ও ব্যাংকিং নিয়মের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত থাকার বিষয়টি বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার হয়তো ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তন আনতে চেয়েছে। কিন্তু নতুন মালিকানায় আসা কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের সম্পদের ওপর যেভাবে একক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ করেছে তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাংকের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ও ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকও পরিপূর্ণভাবে দায়ভার এড়াতে পারে না। তদারকির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা দৃশ্যমান। বড় বড় আকারের ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনেই দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারত, যার বৈধতা আইন ও চার্টারে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, তাহলে অবস্থা আরো স্থিতিশীল ও আস্থাশীল থাকত। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে আজকের এ সংকট সৃষ্টিই হতো না। গত কয়েক বছরে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির যে অবনতি তা বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখের সামনেই ঘটেছে। তারা কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। প্রথাগত ব্যাংকগুলো এত দ্রুত খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েনি যত দ্রুত ইসলামী ব্যাংকগুলো পড়েছে। এখানে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে আরো সতর্ক ও ধীরস্থির হওয়া দরকার ছিল, যেহেতু এটি পুরো রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ভালো-মন্দের সঙ্গে জড়িত সেহেতু এর স্পর্শকাতরতার বিষয়টির প্রতি নজর দেয়া দরকার ছিল। সেদিকে যথাযথ নজর হয়তো দেয়া হয়নি বলেই ইসলামী ব্যাংকগুলো একটা অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি ও ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা দৃশ্যমান। তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনেকাংশেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকগুলো কী অবস্থায় আছে, তা আমরা কেউ জানি না। তথ্যগুলো তাদের কাছেই আছে। তারা জানে ঋণ কত আর অর্থ কীভাবে কোথায় গেছে। আমাদের ব্যাংকিং সিস্টেম এখনো অনেকটা ডিসিপ্লিনড। কিন্তু তথ্যগুলোকে নন ট্রান্সপারেন্ট করে রাখা হয়েছে। তথ্যগুলো ?উন্মুক্ত থাকলে আমরা সমস্যা বুঝে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করতে পারতাম। এক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংকের রক্ষিত অর্থ জনগণের অর্থ এবং এটি জনগণের বিশ্বাসের ওপর ভর করে চলে। তাই এখানে গোপনীয়তার বিষয়ে আরো শিথিলতা দরকার। আমি একটা সরল উদাহরণ দিই যে ইসলামী ব্যাংক বারবার একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছে যে এক লোক যার কোনো লাইসেন্স নেই তিনি ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ব্যাংক ব্যবস্থায় বিশ্বাস একটা বড় ব্যাপার। ইসলামী ব্যাংক ওই ব্যক্তির সঙ্গে বহুদিন ধরে ব্যবসা করে আসছে বলে তাদের বিশ্বাস ছিল তিনি অর্থ ফেরত দিতে পারবেন। কিন্তু এত অর্থ একসঙ্গে দেয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে যাচাই-বাছাইয়ের পর একটি দৃষ্টিভঙ্গি দেয়া দরকার ছিল। যেটি হয়েছে বলে মনে হয় না।
আমাদের দেখার বিষয় হচ্ছে আসলে কোন অংশটি আক্রান্ত হচ্ছে। মোট ব্যাংকিংয়ের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক ৩০ শতাংশ। কোনো নির্দিষ্ট দল বা মতের লোকেরা ইসলামী ব্যাংক ব্যবহার করছে না। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব ঘরানার মানুষই ইসলামী ব্যাংকিংয়ে যুক্ত। তবে বর্তমান সংকটে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের চেয়ে বড় আমানতকারীদের ঝুঁকি বেশি। কারণ সরকার বলেছে ব্যাংক আমানতের বিপরীতে ১ লাখ টাকার সুরক্ষা ইন্স্যুরেন্স করা আছে। সেক্ষেত্রে বড় আমানতকারী যাদের ৫০ লাখ বা ১ কোটি টাকা আছে তারা অর্থ তুলে নিচ্ছেন। কারণ তাদের আমানতের বিপরীতে ইন্স্যুরেন্সের সুরক্ষার পরিমাণ খুবই প্রশ্নবিদ্ধ ও অবিশ্বাস্য রকমের কম। কারণ তারা জানেন যে যদি ইসলামী ব্যাংকে ধস নামে তবে তারা আগামী ৫-১০ বছরেও অর্থ পাবেন না। তাদের অর্থ আটকে যাবে। এ কারণেই ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল অর্থ বেরিয়ে গেছে এবং তারা তারল্য সংকটে পড়েছেন।
বিদ্যমান সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য প্রথমেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক কাজটিই করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইসলামী ব্যাংকের তারল্য অবস্থা ভালো দেখানো এবং স্থিতিশীল রাখা যদিও পরে ইসলামী ব্যাংক সে টাকা ফেরত দিয়েছে। তারল্য অবস্থা ভালো থাকার কারণে তাদের বছর শেষে ব্যালান্স শিট ভালো দেখাতে পেরেছে। ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ধরে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যা করেছেন অন্য দেশ হলেও এটাই করত। এটা করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায়ও ছিল না। কিন্তু বড় বিষয় হচ্ছে, আমরা এমন অবস্থায় কেন ও কীভাবে উপস্থিত হলাম। এ সমস্যা যখন শুরু হয়েছে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সচেতন হতো তাহলে এ হযবরল পরিস্থিতি তৈরি হতো না। মূলত কয়েক বছর ধরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা যথোপযুক্ত নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গোচরেই যখন এসব অনিয়ম হয়েছে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় এড়ানো অনেকটাই দুরূহ।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ২৫-৩৫ শতাংশ আমানত সংগ্রহ এবং সম্পদ সঞ্চালন হয় ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। যেহেতু দেশের আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে বড় একটা অংশ ইসলামিক ব্যাংকিং বা ফাইন্যান্সিয়াল পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে, সেক্ষেত্রে এখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরো আন্তরিকতার সঙ্গে গুরুত্ব দেয়ার সুযোগ ও প্রয়োজন দুটোই রয়েছে। তবে জাতীয় অর্থনীতিতে ইসলামিক ফাইন্যান্সের অবদান নিয়ে এখনো মানসম্মত কোনো গবেষণা খুব একটা চোখে পড়ে না, যার কারণে অর্থনীতিবিদদের কাছে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যও নেই। তাই রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির অগ্রিম গতি-প্রকৃতি ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনের জন্য বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের জিডিপিসহ সার্বিক অর্থনীতিতে ইসলামিক ব্যাংক ও অন্যান্য ইসলামিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবদান, সম্ভাবনা এবং নানা অভ্যন্তরীণ ও বহির্জাগতিক প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণার বিকল্প নেই। অন্যদিকে প্রবাসী রেমিট্যান্স আয় এবং রফতানি আয় দীর্ঘ সময় ধরেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মূলত দেশীয় অর্থ জোগানের এ দুই খাতের অভাবনীয় অগ্রগতির পেছনে ইসলামী ব্যাংকগুলোর অবদান অনেক বেশি। মোট প্রায় ৪০ শতাংশ রেমিট্যান্স আসে মূলধারার ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। রফতানি আয় ও আমদানি পণ্যের এলসি খুলতে এখনো আস্থার জায়গা দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মুহূর্তে ইসলামী ব্যাংকিং আইন তৈরি করা জরুরি। এরপর ইসলামী ব্যাংকিংয়ের গভর্ন্যান্স বোর্ড অব স্ট্রাকচার তৈরি করা। পাশাপাশি আইনে স্পষ্টভাবে শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য হওয়ার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা উল্লেখ থাকতে হবে। বর্তমানে যেসব সদস্য রয়েছেন তাদের যদি সেই মান বা যোগ্যতা না থাকে তাহলে তাদের পরিবর্তন বা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে আশার দিক হচ্ছে, বাংলাদেশেও যথেষ্ট ভালো মানের শরিয়াহ স্কলার রয়েছেন, যারা ইসলামিক আইন ও ব্যাংকিং ফাইন্যান্স সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা রাখেন। সেসব স্কলারকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো উদার ও আন্তরিক হওয়া দরকার। এটিই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, নীতিনির্ধারক ও গ্রাহক সবার কল্যাণের জন্যই করা উচিত। একটা উদাহরণ দিই, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন একটা শরিয়াহ বোর্ড তৈরি করেছে। যেখানে দু-একজন ব্যতিরেকে অধিকাংশ সদস্যেরই ইসলামী ফাইন্যান্স সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত জ্ঞান নেই। তাই সব ক্ষেত্রেই আমি ইসলামী ফাইন্যান্স শিক্ষার কথা বারবার বলছি। ইসলামে যে ভালো একটি অর্থ ব্যবস্থা রয়েছে, সেটি শুধু আমরা বলছি না, অমুসলিমরাও বলছে। এমনকি ভ্যাটিকান পর্যন্ত এটা প্রচার করছে ও স্বীকৃতি দিচ্ছে। ড. এম কবির হাসান: অধ্যাপক, ইকোনমিকস ও ফাইন্যান্স বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিন্স