শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৬ পূর্বাহ্ন

সর্বজনীন কল্যাণ ও রমজান

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০২৩

‘তোমরা রোজা রাখ, কেননা এতে তোমাদের জন্য রয়েছে অশেষ কল্যাণ।’ কল্যাণের এই ব্যাপ্তি বহুমুখী। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে এর বিস্তৃতি। ব্যক্তিগতভাবে রোজাদার চারিত্রিক ও নৈতিক কল্যাণের সাথে সাথে মনোদৈহিক উৎকর্ষের মানবিক গুণাবলি বিকাশের চমৎকার সুযোগ লাভ করে রোজার মধ্যে। আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা, কাজকর্ম, লেনদেন, সামাজিকতা সব কিছুর মাঝেই রয়েছে এক কল্যাণমুখী চেতনা। মৌলিক মানবিক গুণাবলি বিকাশের এ এক অপূর্ব সুযোগ সম্ভার। সহানুভূতি, সহযোগিতার বৈশিষ্ট্য বিকাশের এ এক অপূর্ব সুযোগ। সমাজের সর্বত্রই দেখা যায় কল্যাণমুখী আবহ। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই মানবকল্যাণের স্বর্গীয় চেতনার রেশ। আমরা সবাই এই চেতনার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যেমন নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারি, তেমনি সমৃদ্ধ করতে পারি পরিবার ও সমাজকে।
পরিবারকে সমৃদ্ধ করা যায় পরিবারের সবার সাথে সমভাবে কাজ ভাগ করে নিয়ে। বাসার কাজের লোকের পরিশ্রমের সময় কমিয়ে দিয়ে তাদের সাথে নৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করা যায়। পরিবারের সবাই একসাথে রোজার আয়োজনে, ইফতার ও সাহরির ব্যবস্থাপনায়, নামাজের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে এক চমৎকার পরিবেশ তৈরি করতে পারি। পারি একে অপরকে সহযোগিতা করতে। একে অপরের কাজে সহযোগিতা করতে।
ব্যবসায়ী ভাইয়েরা সঠিক ওজন দিয়ে নির্ভেজাল দ্রব্য সরবরাহ এবং বিক্রয় করে রোজাদারদের বোঝা লাঘব করতে পারেন সহজেই। বেশি লাভের আশায় মজুদদারি অথবা হঠাৎ করেই বাজার থেকে দ্রব্যাদি উধাও করে না দিয়ে, ভেজালের আশ্রয় না নিয়ে এক দিকে যেমন বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে পারেন, তেমনি মানবিক মূল্যবোধের পরিচয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের সময় কিছুটা কমিয়ে দিয়ে সহজ করা যায় রোজাদার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রোজাকে।
সহযোগিতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত কল্যাণমুখী সমাজের ডাক নিয়ে আসে রমজান। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই কল্যাণের ধারা বিস্তৃত। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এক দিকে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অনিদ্রা, বদহজম, হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যকর পদ্ধতি রোজা। এসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সাথে সাথে শরীরের ওজন হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণ, মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রমজান স্বাস্থ্যকর জীবনের চালকের অনন্য ভূমিকা পালন করে।
একই সাথে মিথ্যা বলার অভ্যাস পরিত্যাগ রোজাদারকে নৈতিক মানদ-ে উজ্জীবিত করে। করে তোলে বিনম্র, বিচক্ষণ, সপ্রতিভ। চরিত্রে ফুটে ওঠে সরলতা, বিনয়, ভদ্রতা। অভাবী বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর, তাদের প্রতি সহমর্মিতা বোধের সাথে সাথে সহযোগিতা ও সহানুভূতির যে চেতনা রমজান তৈরি করে তার কোনো তুলনা নেই। অন্য কোনো ধর্মবিশ্বাসে একজন মানুষকে সোনার মানুষের পরিণত করার এ ধরনের ব্যবস্থা আছে বলে জানা নেই। এভাবে রমজান একজন রোজাদারকে খাঁটি মানুষে পরিণত করে যার মধ্যে একই সাথে এক দিকে থাকে শারীরিক সুস্থতা, তৈরি হয় কর্মস্পৃহা। তেমনি অপর দিকে সত্যবাদিতা, আমানতদারিতার চেতনা তৈরি হওয়ার সাথে সাথে তাকে করে তোলে বিনয়ী ও সত্যবাদী। পরিবারের অধিকর্তা হিসেবে এ ধরনের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকের কল্যাণে পরিবারে তৈরি হয় প্রশান্তির আবহ। পরিবারের ছোট্ট শিশুটির প্রতি তিনি যেমন যতœবান ও বন্ধুভাবাপন্ন, তেমনি পরিবারের সবার প্রতি থাকে তার সদাচারের তীক্ষ্ম দৃষ্টি। গৃহকর্মী ও পরিবারের সাথে জড়িত অন্য সবাই তার প্রতি থাকে নির্ভার। এ ধরনের ব্যক্তি যখন সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব পান সমাজটিতে তখন অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, ভেজাল, মুনাফখোরির পরিবর্তে বিরাজ করে আইনের শাসন, সুবিচার ও সদাচার। ন্যায়পরায়ণতাই হয়ে ওঠে জীবনের মাপকাঠি। সমাজ থেকে উধাও হয় ভেজাল আর মজুদদারি। মুনাফাখোরদের অপ্রতিহত অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পায় ভোক্তা জনগণ। দূষণ থেকে মুক্তি পায় পরিবেশ, পানি ও বায়ু। সুস্থ জীবনের পরিবেশ গড়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এর কল্যাণকর ভূমিকা দেখা যায়। আন্তর্জাতিক পরিম-ল অস্ত্রের ঝনঝনানি, ক্ষমতার মদমত্ততা, পরদেশ দখলের পাঁয়তারামুক্ত হয়ে সহযোগিতা, সমানাধিকার, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং অন্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। মানবিক মূল্যবোধের প্রাধিকার থাকায় কাউকে গৃহহীন হতে হয় না, উদ্বাস্তুর খাতায় নাম লিখিয়ে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে রাস্তায় বেরোতে হয় না। সমগ্র মানবসত্তা একইভাবে মূল্যায়িত হয়। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ সমাজ চেতনায় আন্তর্জাতিক পরিম-ল উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। রমজানের লক্ষ্য এটিই। ব্যক্তিজীবন থেকে পারিবারিক জীবন, সমাজজীবন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে কল্যাণমুখী জীবনধারার পরিবেশ তৈরির লোক তৈরি করাই রমজানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ ছাড়া পরকালীন কল্যাণের অঙ্গীকার তো রয়েছেই। কল্যাণময় পৃথিবী ও পরকালীন কল্যাণের অভিধায় অভিষিক্ত রমজান। আর এ জন্যই আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন- ‘তোমরা রোজা রাখ, কেননা এতে তোমাদের অশেষ কল্যাণ রয়েছে, যদি তোমরা তা বুঝতে পারো।’ (সূরা আল বাকারাহ : ১৪৩)। লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ Email- shah.b.islam@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com