ভ্রমণ এবং চিত্রগ্রহণ দুটোই যখন কারো প্যাশন তখন সেই জানে কোন পরিস্থিতিতে এর যে কোনো একটি বেছে নিতে হলে কতটা অসহায় লাগে। কখনও অ্যাডভেঞ্চার ট্রিপ, কখনও-বা প্রকৃতির গহীনে গিয়ে কতবার কত অচিন্ত্য সৌন্দর্যের মুখোমুখি হই কিন্তু উপযুক্ত ক্যামেরা বইতে না পারার কারণে সেসব আর বন্দী করে আনা যায় না। ফেরার পর সেই সঙ্গে আনতে না-পারা ক্ষণিক দেখা দুর্লভের জন্য অস্থির লাগে। তাই একটা সর্বোপযোগী ক্যামেরার জন্য জরুরিভাবে হাতে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। ওদিকে মালদ্বীপ ট্রিপের ন্যুনতম প্রস্তুতিও আমার ছিল না। ড্রিম ডেস্টিনেশন থেকে মালদ্বীপের নাম অনেক আগেই কেটে দিয়েছিলাম ব্যয়বহুল হবার কারণে। যদিও, দ্বীপরাষ্ট্রটি অচিরেই ডুবে যাবার দুঃসংবাদে কদাচিৎ আফসোসও হতো। ভাবতাম, মহাসাগরের নীলে তলিয়ে যাওয়া একটা অপরূপ দ্বীপপুঞ্জ হাজার বছর ধরে এই নগণ্যের পদচিহ্ন ধারণ করবে- সেই সৌভাগ্য কি আর হবে না! সুযোগটা হঠাৎই এসে গেলো। একটা মালদ্বীপ ইভেন্টের খবর পেলাম শুধু নারীদের টিম যাবে। এয়ারলায়েন্স, হোটেল ও এজেন্সি অফার একত্রে করে তারা একটা স্মার্ট প্যাকেজ করেছে যেটা ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেই, মানে আমার ক্যামেরার টাকাটার আশেপাশেই আর কি। সাধ্যের মধ্যে মালদ্বীপ, আবার সবাই নারী। এই সুযোগ কি ছাড়তে পারি! তবুও কিছুটা উভয় সংকট। মালদ্বীপ আপাদমস্তক একটা ন্যাচারাল স্টুডিও। সেখানে একটা ভালো ক্যামেরা না হলে চলে! কিন্তু হায়, হয় ক্যামেরা নয় স্টুডিও! অগত্যা, ক্যামেরার মায়া বিসর্জন দিয়ে টাকাগুলো গ্রুপে জমা দিলাম। টিকিট, হোটেল সব হয়ে গেলো অথচ পাসপোর্টের খবর নেই। খবরটা পেয়েছিলাম শেষের দিকে। আমি তখন বাড়িতে। পাসপোর্ট ঢাকার বাসায় আবার সেটার মেয়াদও করোনায় খেয়েছে। অথচ তিন দিন পরেই ফ্লাইট। ছুটলাম ঢাকায়, তারপর পাসপোর্ট অফিসে। জরুরি আবেদন হলেও দুই দিনেই নবায়নের গ্যারান্টি তো নেই। ওদিকে ওয়ান্ডারল্যান্ড টাইপের একটা দেশে যাচ্ছি অথচ একটা ভালো সানব্লক কি সুন্দর ড্রেস, কিছুর যোগাড়পাতি নেই (কোন জন্মেই বা থাকে!)।
যাহোক, এসব ইলি গিলি ছুঃ মন্তরের মধ্য দিয়েই যেন হ্যারি পটারের ঝাড়ুতে চেপে ঝুপ করে গিয়ে পড়লাম অন্তহীন নীলের কোলে। ভারত মহাসাগরের সেই তীব্র নীল চিড়ে রোলার কোস্টারের অনুভূতি আর ঘোর লাগা চোখে বকসাদা বোটে প্রথমে পৌঁছাই আইল্যান্ড মাফুশিতে। মূলত ট্যুরিস্ট আইল্যান্ডগুলো দুই ক্যাটেগরিতে বিভক্ত- পাবলিক ও প্রাইভেট। মাফুশি একটি অলরাউন্ডার পাবলিক আইল্যান্ড; সাশ্রয়ী, জনপ্রিয় ও এশিয়ান ফ্রেন্ডলি হবার কারণে মাফুশি দ্বীপ অবস্থানের জন্য অনেকের প্রথম পছন্দ। চিত্তবিনোদনের সব উপকরণই আছে এখানে। একলা হবার নির্জনতা, একটু সন্ধ্যা-রাতের কলরব, ওয়াটার স্পোর্টস, সাগরের ভিতরে নানা আয়োজন, মজার সামুদ্রিক খাবার; যে যেটা বেছে নেয় আর কি। অতঃপর…যেন এক উপবাসী আত্মার দ্বীপবাস শুরু হলো। খুব দ্রুতই ক্যামেরা, কস্টিউম আর খুচরো কষ্টগুলো আটকা পড়লো অন্য ভুবনের ইন্দ্রজালে।
অন্য ভুবনই বটে। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। যে ভুবনে কয়েকটা দিন কাটিয়েছি হারিয়ে যাওয়া শিশু কিংবা শিল্পী বাবুইটির মত খেয়ালী স্বাধীনতার ডানা ছড়িয়ে। এমন স্বপ্নীল আকাশে এসে পড়লে আসলে সবাই পাখি হয়ে যায়। দেখা যায়- যে রাশভারী গৃহকর্তাটি তার ব্যক্তিত্ব হালকা হবার ভয়ে পরিবারের সামনে অট্টহাসি চেপে, পরে বাথরুমে লুকিয়ে হেসে হালকা হয়ে আসে; সে বেচারাও হাফপ্যান্ট পড়ে ওই যে বালি-পানিতে গড়াগড়ি আর খিলখিল করছে, তাকে আর টেনে ওঠানো যাচ্ছে না।
টিম এক্টিভিটিজ ছাড়া বাকী সময় আমাদের নিজেদের মত করে চলার সুযোগ ছিল। আর সেই ফ্রিডমটাকে নিংড়ে সবাই ঠিকই বের করে নিয়েছে অনাবিল আনন্দ নির্যাস। বেশ রাতে কি মনে হলো, হোটেল থেকে একাই বেরিয়ে ছোট্ট দ্বীপটার এমাথা-ওমাথা ভবঘুরের মতো হাঁটলাম। একখ- আলোকিত ভূ-ভাগে একরত্তি মেয়েটাকে যেন চারিপাশের নীলচে অন্ধকার থেকে স্বাগত জানাচ্ছিল সীমাহীন জলরাশির অবিরাম ফিসফিসানি- মেয়ে, বুকভরে নিয়ে নাও স্বাচ্ছন্দ্যের শ্বাস আর মুক্তির স্বাদ! এখানে ক্রমাগত উৎকণ্ঠার ফোন নেই, কারো কাছে জবাবদিহিতার চাপ নেই, নেই পথিমধ্যে হঠাৎ ঘিরে ধরা শকুনের ভয়। ওই সত্যিকারের একলা চলাটুকু ছিল অসাধারণ, অনেক দামী! দ্বীপের পেছনের দিকটায় স্থানীয়দের বসবাস। দ্বীপবাসীরা যথেষ্ট শিক্ষিত ও স্মার্ট। তাদের সাথে সময় কাটাই, গল্প হয়- তোমরা বাংলাদেশ চেনো? অনেক বৈচিত্রময় আমার দেশ! এই ধরো- তোমাদের মত নীল পানি আর নারিকেল বাগানে ঘেরা একটা দ্বীপ তো আমাদের আছেই। আরো আছে পাহাড়ের রাজ্য, গুটি ছুটে যাওয়া উলের মত প্যাঁচানো শতেক নদী, আছে সুবিশাল সুন্দরবন। আমাদের খ্যাপাটে সমুদ্রটার উত্তাল গর্জন শুনলে তো তোমাদের ঘুম উবে যেত! ওরা কৌতুহলের চোখে বলে- ওয়াও, ইউর কান্ট্রি ইজ সো রিচ! অফকোর্স! বলে আমি প্রকাশ্যেই কলার ঝাঁকাই। দলছাড়া হয়ে পড়লে ছবি তোলার সমস্যায় একটু পড়তে হয় বৈকি। এখানে কক্সবাজারের মত গলায় ঢাউস ক্যামেরা ঝুলিয়ে কেউ ছুটে এসে বলবে না- এই যে পাঁচ টাকা পিস। কসম, ছবি যেডি বাছবেন খালি ওইডিই দিমু। এইবার পানি ছিডান, জোরে ছিডান… সূর্যটারে তালু বরাবর বসান!
এমন ছবির মত দ্বীপে হোটেল রুমে কেই বা বসে থাকে! বীচের আশেপাশে পর্যটকরা সাধারণত সূর্যস্নান, গতানুগতিক স্নান, কায়াকিং, বোটিং, স্পোর্টিং নয়তো আপনমনে নিজের শখ নিয়ে অবসর কাটায়- নিরুপদ্রব শান্তির কয়েকটা দিন! তাই কচ্ছপের মত উপুড় হয়ে থাকা স্বল্পবসনা শ্বেতাঙ্গীনির আরাম নষ্ট করে বলা যায় না- এক্সকিউজ মি, বালি থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আমাকে একটা ছবি তুলে দেন না! চমৎকার কোনো লোকেশনে আশেপাশে কাউকে না পেয়ে নিজের অনেক ছবি নিজেরই তুলতে হয়েছে। বাট এটা একটা দারুণ দিক। যার যার মত সবাই নিজেকে নিয়ে মত্ত। এই ফ্রি মুভমেন্ট কমফোর্টটা কোনো ভ্রমণে যে কতটা প্রশান্তির, তা কোনো নারীই বলতে পারবে।
সবচেয়ে ভালো লেগেছে যেটা- পর্যটকদের সেফটি অ্যান্ড প্রাইভেসিকে প্রচন্ড গুরুত্ব দেওয়া হয় এখানে। কোনো শপ বা রেস্টুরেন্ট থেকে হাঁকাহাঁকির কারবার নেই। সামনে মেন্যু রাখা আছে। সেটা নিয়ে কথা বলতে ডাকলেই কেবল ওরা এগিয়ে আসবে। এলকোহল নিষিদ্ধ এই দ্বীপে তাই নেই অনাকাঙ্ক্ষিত কোলাহল বা পরিবেশ নষ্ট হবার সুযোগ।
পর্যটন নীতি ও কৌশলের দিক দিয়ে মালদ্বীপ প্রচন্ড পেশাদার, নিয়মনিষ্ঠ এবং সুনিয়ন্ত্রিত। বহিরাগতদের বিচরণক্ষেত্র বা দৃষ্টিসীমানার মধ্যে তারা কোথাও কোনো ত্রুটি রাখেনি। সব কিছু পরিকল্পিত ও পরিপাটিভাবে গোছানো। এই নীলাভূমিতে কেউ একবার গেলে তাকে ফিরতে হবে শুধু মেমোরি কার্ড আর হৃদয়ভর্তি একরাশ সুখস্মৃতি নিয়ে। সব কিছুর পরেও… বেশি ভালো কি আসলেই ভালো? মধ্যবিত্তের নাগালে কি সত্যিই চলে এসেছে অধরা মালদ্বীপ? কোনো শখের বন্ধকী রেখে অথবা মাস কয়েক সংসারের টানাপোড়েনকে জিম্মি করে এই দ্বীপদর্শন আসলে কতটুকু সমীচীন… জানানোর চেষ্টা করবো পরবর্তী লেখাতে। আপাতত আমার নি¤œ মধ্যবিত্ত ক্যামেরায় তোলা শুধু পাবলিক আইল্যান্ডের কিছু ছবি দিলাম, ছবির সাথে হালকা ডেসক্রিপশন। যারা আতকা এত্ত নীলের মধ্যে আমাকে দেখে ভিরমি খেয়েছিল, আশা করি পটভূমি শুনে তারা এখন একটু স্বস্তি পাবে। তবে ভ্রমণ কিন্তু এভাবেই করতে হয়। অতিরিক্ত পরিকল্পনায় ভেস্তে যাবার আশঙ্কা বেশি। দেখা যায় ঘটি-বাটি, ছুটি, সঙ্গী, সুযোগ এসব মিলাতে মিলাতে ওদিকে ফাইন্যান্স, রোমান্স, মুড সবই একসময় সুইং করা শুরু করে। পেন্ডিং হানিমুন বা এনিভার্সরিতে করা প্রমিজ নিয়ে ঝগড়াটা একসময় মুখস্থ হয়ে যায় বাচ্চাদেরও! তাই কিছু মিছু এডজাস্ট করে হলেও সুযোগ বুঝে সাধের জায়গায় চট করে ঘুরে আসলে সেই স্মৃতি আর জীবনীশক্তি নিয়ে কাটিয়ে দেয়ওা যায় ধেয়ে আসা আরো অনেকগুলো বাজে-ব্যস্ত দিন। হ্যাপি ট্রাভেলিং! । রাইজিংবিডি.কম ছবি: লেখিকা