রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৫ অপরাহ্ন

মানিকের দর্পণ উপন্যাসের রাজনৈতিক বাস্তবতা

ড. মুসাফির নজরুল
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক উপন্যাস দর্পণ (১৯৪৫)। উপন্যাসটি রচনার প্রাক্কালে ‘তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্যাসিস্তবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে যোগ দেন ১৯৪৩ সালের গোড়ার দিকে।…১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে মহম্মদ আলি পার্কে যখন চতুর্থ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (এখানেই সর্বভারতীয় সংঘের সঙ্গে নাম মিলিয়ে নামরকণ হল ‘প্রগতি লেখক সংঘ’)। তখন মানিকবাবু সভাপতিম-লীর একজন সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর থেকে সংঘ যতদিন সক্রিয় ছিল ততদিনই মানিকবাবু তার নায়কতা করেছেন।’ (চিন্মোহন সেহানবিশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রগতি লেখক আন্দোলন, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ সম্পাদিত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মশতবর্ষ, উত্তরাধিকার, পৃ. ৪৫৩ [‘পরিচয় ॥ পৌষ, ১৩৫৩; উৎস : মানিক বিচিত্রা] এই সময় পরিসরে রচিত দর্পণ উপন্যাসের প্রতিটি স্তরে মানিক মার্কসবাদী চেতনায় শোষণপীড়িত সমাজের অনবদ্য চিত্র উপস্থাপন করেছেন।দর্পণ উপন্যাসের সূচনা হয় ঝুমুরিয়া গ্রামের বীরেশ্বর মাইতি এবং তার সুন্দরী কন্যা রম্ভাকে নিয়ে। স্বদেশীদের সংস্পর্শে বীরেশ্বর বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ কারণে পুলিশ তাকে কয়েকবার গ্রেপ্তার করে। একবার তার দু’বছর জেলও হয়। বীরেশ্বর যেদিন জেল থেকে বেরিয়ে আসে, সেদিন তাকে নিয়ে গ্রামবাসী বিরাট শোভাযাত্রা করে। গ্রামে এসেই বীরেশ্বর দেখতে পায় Ñ জমিদার হেরম্ব একটা বড় রাস্তা করতে গিয়ে তার অনেক জমি অনাবাদি দেখিয়ে কম দাম দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পুকুর থেকে সে জোরপূর্বক অনেক মাছ তুলে নিয়েছে এবং চাষিদের ওপর অত্যাচার আরম্ভ করেছে। এসব নিয়ে বীরেশ্বরের সমর্থকদের সাথে হেরম্বের বাহিনীর সংঘর্ষ হয় এবং অজ্ঞাত এক ব্যক্তির বন্দুকের গুলিতে বীরেশ্বর মারা যায়। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কৃষ্ণেন্দু। বীরেশ্বরের মৃত্যু সংবাদে সে ঝুমুরিয়ায় যায়। এদিকে বীরেশ্বরের খুন হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ উল্টো বীরেশ্বরের লোকদের আটক করে। এ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে কৃষ্ণেন্দু ঝুমুরিয়ায় একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করে। কিন্তু সে রাতেই কৃষ্ণেন্দু আর বীরেশ্বরের ছোট ছেলে মোহনলালকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বীরেশ্বরের সমর্থরা। এসময় মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে গ্রামে বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। লেখক সেদিনের শোভাযাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : বীরেশ্বরের অপমৃত্যুতেও এমন সাড়া জাগেনি। চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল যথেষ্ট কিন্তু এমন উত্তেজনা দেখা দেয়নি। ও যেন খানিকটা ছিল হেরম্ব ও বীরেশ্বরের ব্যক্তিগত কলহের ব্যাপার। হেরম্ব অত্যাচার করছিল সত্য, বীরেশ্বর একা নিজের জন্য লড়তে যায়নি তাও সত্য, কিন্তু হাঙ্গামাটা হয়েছিল বীরেশ্বরের নিজের জন্যই।” (দর্পণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস সমগ্র দ্বিতীয় খ-, সৈয়দ আজিজুল হক সম্পাদিত, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ : মার্চ ২০১০, প্রাগুক্ত, পৃ .৫৫০)এদিন দুপুর থেকেই দলে দলে লোক জড়ো হতে থাকে বটতলার মাঠে। ঝুমুরিয়ার ইতিহাসে এত বড় লোক-সমাগম ইতঃপূর্বে হয়নি। উত্তেজিত মানুষের ভিড়ের মধ্যে রম্ভাও আসে ভৈরবীর বেশে। এখানে হিন্দু-মুসলমান কোনো বিভেদ নেই। সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণের দৃশ্যে পুলিশের দারোগাও নির্বাক হয়ে যান। তাই ‘অবস্থা গুরুতর, নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে’Ñ বলে তিনি হেরম্বের কাছে একটি চিঠি লেখেন। অবশ্য চিঠি পড়ে হেরম্ব আত্মতৃপ্তি অনুভব করে। এই হাঙ্গামাই তার কাম্য। রম্ভা এ উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র। সে তার পিতা বীরেশ্বরের মতোই তেজস্বী। বয়স হলেও সে যে-কোনো পাত্রকে বিয়ে করতে আগ্রহী নয়। এক পর্যায়ে কৃষ্ণেন্দুর উদ্যোগে রামপালের সঙ্গে রম্ভার বিয়ে হয়। কৃষ্ণেন্দু, মমতা, হীরেন, আরিফ ও দীনেশসহ মজুর-মিস্ত্রিরা বিয়ের বরযাত্রী হয়ে ঝুমুরিয়ায় আসে। বিয়ের পর রম্ভা নতুন জগত ও পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়। রম্ভার কাছে বস্তির জগত একেবারেই আলাদা। স্থানের সংকীর্ণতা আর আলো-বাতাসের অভাবে তার দম আটকে আসে। একদিকে নর্দমা ও পঁচা আবর্জনার দুর্গন্ধ, অন্যদিকে ‘হৃদয়হীন অদ্ভুত খাপছাড়া’ মানুষের কোন্দল, উদাসীনতা, ছলচাতুরি, হীনতা, দীনতা, নির্মম পাশবিকতা তাকে চিন্তিত করে তোলে। সে রামপালকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে বলে। ঝুমুরিয়ার খোলা মাঠঘাট উন্মুক্ত প্রান্তরের জন্য তার মন কাঁদে। রম্ভা ধীরে ধীরে রামপালের ওপর হতাশ হয়ে পড়ে এবং রামপালের আলিঙ্গনকে সে ‘মাতালের মাতলামি’ হিসেবে দেখে। রম্ভা কোনো অন্যায় মেনে নিতে রাজি নয়। এ জন্য পিতার মৃত্যুতে ভাইদের নিস্পৃহতায় সে হতবাক হয়। পিতার মৃত্যুশোক তার কাছে ক্ষোভে পরিণত হয়। তাই পিতৃহত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে সে অগ্রভাবে অবস্থান নেয়।লোকনাথ ঝুমুরিয়ার ধনাঢ্য ব্যক্তি ও শিল্পপতি। সে কলকাতায় বসবাস করে। তার গ্রামের বাড়িঘর দেখাশুনা করে দূরসম্পর্কের ভাতিজা শশাঙ্ক। লোকনাথের কারখানার শ্রমিক নাথু করাতিকে অন্যায়ভাবে মারধর করে তার ভাগ্নে উমাপদ। এ নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি হলে লোকনাথ তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয় এবং উমাপদকে অন্য কাজে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। আরিফ এ উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র। সে শিক্ষকদের কাছে ‘ফিউচার ব্রিলিয়ান্ট’ হিসেবে সমাদৃত। হঠাৎ করেই ডক্টরেট ডিগ্রির চেয়ে দেশের স্বাধীনতা তার কাছে গুরুত্ব পায়। এজন্য সে গবেষণা বন্ধ করে রাজনীতিতে যোগ দেয়। আরিফের সঙ্গে মমতার সম্পর্ক বাল্যকাল থেকে। মমতা স্বদেশী আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত। মমতা পার্টির কাজের প্রয়োজনে বস্তিতে গিয়ে বসবাস করতে চায়। কিন্তু বস্তিবাসী তাকে সহজে মেনে নিতে পারে না। মমতা আরিফের কাছে মুসলমান হওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করলে আরিফ তাতে সম্মতি দেয়। মমতা বলেÑ ‘তা হলে চটপট আমাকে মুসলমান করে নাও। তারপর চলো আমরা একবার ঝুমুরিয়া যাই।’ (দর্পণ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪৯) দু’দিন পরে আরিফ ও মমতা একসঙ্গে ঝুমুরিয়া স্টেশনে পৌঁছায়। একপর্যায়ে কয়েকটি বক্তৃতার জন্য আরিফকে পুলিশ আটক করে। মমতা এ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান নারী চরিত্র। উপন্যাসে হীরেনের সাথে তার বিয়ে হয়। ‘হীরেন ও মমতার বিয়ে হয় আশ্বিনের গোড়ায়, পুজোর দিন সাতেক আগে। লোকনাথের বাড়িতে খুব ধুমধামের সঙ্গে পুজো হয়। শিল্পচাতুর্যে অপরূপ দামি প্রতিমা আসে। এবার বিয়ের সমারোহ শেষ হতে না হতে পুজোর সমারোহ আরম্ভ হওয়ায় আনন্দ-ক্লান্ত উৎসব শ্রান্ত বাড়ি-বোঝাই মানুষগুলির কাছে বিজয়া যেন মুক্তির স্বস্তি নিয়ে এল। লোকনাথের কারখানাগুলির সমস্ত লোকেরা এবং মমতার নিজে গিয়ে নিমন্ত্রণ করে আসা মজুর ও ধাঙড়রা সবসুদ্ধ তিন দিন পাত পেতে গেল। (দর্পণ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪৮) একপর্যায়ে মমতা ও আরিফের সম্পর্কে হীরেন সন্দেহপ্রবণ হয় এবং তার এক প্রশ্নের জবাবে মমতা বলেÑ ‘আরিফ আমার ছেলেবেলার বন্ধু, সকলের চেয়ে ঘনিষ্ঠ, আপন বন্ধু, তার বেশি কিছু নয়। তুমি কি মনে কর ওকে ভালবাসলে ওর বদলে তোমায় বিয়ে করতাম?’ (দর্পণ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৬) মমতাকে হীরেন ঘরোয়া ও স্বামীভক্ত হিসেবে পেতে চেয়েছে। উপন্যাসে হেরম্ব খলচরিত্র ও ধনিকশ্রেণির প্রতিনিধি। ঝুমুরিয়া থেকে দুই ক্রোশ দূরে তার ‘নয়নাভিরাম প্রাগৈতিহাসিক জন্মচিহ্নের মতো’ একটি শালবন রয়েছে। এখানে সাঁওতাল মেয়ে-পুরুষেরা হেরম্বের ঠিকারিতে বন কাটতে আসে। একদিন হেরম্ব এক সাঁওতাল মেয়ের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে সাঁওতালরা ক্ষিপ্ত হয়। নিরূপায় হয়ে হেরম্ব ঝুমুরিয়া ফিরে যায়। ফসল কাটার সময় সে অনেক চেষ্টা করেও লোক জোগাড় করতে পারে না। তার ধারণা Ñ বীরেশ্বরের জন্যই শ্রমিকরা কাজে আসে না। হেরম্ব এজন্য প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে এবং মিথ্যা মামলা দিয়ে বীরেশ্বর ও জালালুদ্দিনকে হয়রানি করে। জেলেখানায় নিউমোনিয়ায় জালালুদ্দিনের মৃত্যু হয়। ঝাড়–দার সুখলাল নি¤œশ্রেণির চরিত্রের প্রতিনিধি। তার প্রতি লেখকের মমত্ববোধ অকৃত্রিম। কর্ম নিয়ে তার মধ্যে কোন দ্বিধা-সংকোচ নেই। দর্পণ উপন্যাসটি মানিক সমাজের দর্পণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ‘উপন্যাসটির নাম দর্পণ। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের দর্পণ। একদিকে লোকনাথ, উমাপদ, হেরম্ব, হীরেন, শশাঙ্ক, দিগম্বরী আর অন্যদিকে কৃষ্ণেন্দু, রম্ভা, বীরেশ্বর, মহীউদ্দিন ও শম্ভুর দর্পণ। অত্যাচারী ধনী হেরম্বদের বিরুদ্ধে অত্যাচারিত ঝুমুরিয়া গ্রামবাসীর বিক্ষোভের দর্পণ। এককালে আদর্শবাদী, হতাশায় ¤্রয়িমান ঘুষখোর দারোগা শৈলেন দাসের দর্পণ। বস্তিজীবনের, বাºীপাড়ার, দেহ বেচা রূপজীবী অশিক্ষিত নি¤œস্তরের মানুষদের দর্পণ।’ (সরোজমোহন মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন ও সাহিত্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮৯)। এ উপন্যাসে লেখকের মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপন্যাসের মাধ্যমে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনকে একীভূত করেছেন। শহরের শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে গ্রামের কৃষকসমাজের মেলবন্ধনে যে আন্দোলনকে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া যায় Ñ তা লেখক সার্থকভাবে চিত্রিত করেছেন। পরিশেষে বলা যায়, দর্পণ উপন্যাসে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা দেখানো না হলেও এ ধরনের সমাজব্যবস্থার বীজ রোপণ করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com