সাধারণ ক্ষমার আওতায় মিয়ানমারের বিভিন্ন কারাগার থেকে মোট ২ হাজার ১৫৩ জন রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিচ্ছে ক্ষমতাসীন জান্তা। গতকাল বুধবার দেশটির সর্বোচ্চ নির্বাহী সংস্থা মিলিটারি কাউন্সিল থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেল এমআরটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে এই বন্দিদের। বিভিন্ন থানায় মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদিদের তালিকা পাঠানো হয়েছে চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে; বুধবার থেকে শুরু হয়েছে মুক্তিদান প্রক্রিয়া। সামনের আরও কয়েকদিন এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।
ক্ষমতাসীন জান্তার একটি সূত্র মার্কিন সংবাদমাধ্যম এপিকে জানিয়েছে, এ দফায় যেসব কয়েদিকে মুক্ত করা হচ্ছে— তারা সবাই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর সরকারবিরোধী অহিংস আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। সরকারবিরোধী বিক্ষোভে সংশ্লিষ্টতার কারণেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন মিয়ানমারের সরকারপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সে বৈঠকে বান কি মুন বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে অবশ্যই দেশটিতে চলমান রাজনৈতিক সংঘাতের সমাধান করতে হবে এবং সুচিসহ সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিতে হবে।
তারপর সোমবার মিয়ানমার সফরে যান দেশটির সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীক অংশীদার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিউইন গ্যাং। পরের দিন মঙ্গলবার মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জেনারেল মিন অং হ্লেইংসহ মিলিটারি কাউন্সিরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সেই বৈঠকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির ঘোষণা দিল জান্তা। ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে মিয়ানমারে সরকার গঠন করে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। তবে নির্বাচনের পর পরই ভোট কারচুপির অভিযোগ তোলে দেশটির ক্ষমতা কাঠামোর প্রভাবশালী অংশ সামরিক বাহিনী।
সামরিক বাহিনীর এই অভিযোগ আমলে নিয়ে কারচুপির অভিযোগ তদন্ত করেছিল দেশটির তৎকালীন নির্বাচন কমিশন, কিন্তু তদন্তে এই অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
নির্বাচনে কমিশনের তদন্ত শেষ হওয়ার কিছুদিন পর, ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুচির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকারকে হটিয়ে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। অভ্যুত্থানের পর থেকে যে মিলিটারি কাউন্সিল দেশটির প্রধান নির্বাহীর ভূমিকায় আছে, সেই কাউন্সিলের প্রধানও তিনি।
অভ্যুত্থানের পর পরই গ্রেপ্তার হন সুচি ও তার দল এনএলডির প্রথম ও মধ্যমসারির অধিকাংশ নেতা-কর্মী। সুচির বিরুদ্ধে দুর্নীতির বেশ কয়েকটি অভিযোগ এনেছে জান্তা। রাজধানীর নেইপিদোর আদালতে সেসব অভিযোগের বিচার চলছে। সব অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে অন্তত ১০০ বছর কারাবাসের সাজা হতে পারে ৭৫ বছর বয়সী এই নেত্রীর। তার এনএলডির নেতাকর্মীরা মিয়ানমারের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি আছেন।
এদিকে, সামরিক বাহিনীর অভুত্থানের পরপরই বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল দেশটির গণতন্ত্রপন্থী জনগণ। রাজধানী নেইপিদোসহ বিভিন্ন শহরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। আন্দোলন দমন করতে সে সময় হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি করে সামরিক বাহিনী। বুধবার সেসব বন্দিদের মধ্যে থেকেই মুক্তি দেওয়া হচ্ছে ২ হাজার ১৫৩ জনকে। ক্ষমতা দখলের পর গত দু’বছরে বিভিন্ন সময়ে হাজার হাজার কারাবন্দিদের মুক্তি দিয়েছে জান্তা। কিন্তু রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান এই প্রথম ঘটল। তবে সৌভাগ্যবান এই বন্দিদের মধ্যে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির প্রথম সারির নেতা-কর্মীরা আছেন কিনা— তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।